মনিরুল ইসলাম মুন্না
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি ও সিআরবি শিরীষতলা দুই জায়গাতেই বর্ষবরণের আয়োজন হবে এবার। ডিসি হিলে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা গতকাল মঞ্চ ভাঙচুরের কারণে পন্ড হয়ে যায়। ফলে সেখানে আর আয়োজন হচ্ছে না। আবার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সকালে বের করা হবে শোভাযাত্রা। এজন্যে চারুকলার শিক্ষার্থীরা তৈরি করছে বর্ণিল নানা প্রতিকৃতি। গতকাল রবিবার আয়োজকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
জানা গেছে, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক ও উচ্চারক আবৃত্তিকুঞ্জের সভাপতি ফারুক তাহেরের নেতৃত্বে নববর্ষ উদযাপন পরিষদ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের দুই দিনের অনুষ্ঠান করছে সিআরবি শিরীষতলায়। গতকাল বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ১৪৩১ সালকে বিদায় জানানো হয় সেখানে। আর আজ সোমবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। শিরীষতলায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে আলোচনা অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, গান, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও এবার ব্যতিক্রম হিসেবে থাকবে কাবাডি প্রতিযোগিতা।
বর্ষবরণ উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব ফারুক তাহের জানান, বাংলা নববর্ষ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। প্রতি বছরের মতো এবারও এ উপলক্ষে আমরা শিরীষতলায় নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এসব কর্মসূচিতে অংশ নেবে। থাকবে স্বনামধন্য শিল্পীদের নানা পরিবেশনা। ইতিমধ্যে আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
এদিকে, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এবারও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সকালে বের করা হবে শোভাযাত্রা। এজন্যে চারুকলার শিক্ষার্থীরা তৈরি করছে নানা প্রতিকৃতি। নগরীর বাদশা মিয়া রোডস্থ চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে শোভাযাত্রাটি আলমাস মোড়, কাজীর দেউড়ি, জামালখান প্রেস ক্লাব হয়ে আবারও একই রুটে চারুকলায় গিয়ে শেষ হবে।
ডিসি হিলে বর্ষবরণ আয়োজন বাতিল : গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের আড়ালে ‘ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসনের’ অভিযোগে নগরীর ডিসি হিলে বর্ষবরণ মঞ্চ ভাঙচুর করেছে একদল যুবক। এ ঘটনার পর ডিসি হিলে বর্ষবরণের আয়োজন বাতিল ঘোষণা করেছে আয়োজক সংগঠন ‘সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ’। গতকাল রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মিছিল নিয়ে এসে আয়োজকদের সামনে ডিসি হিলের মঞ্চে ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় হামলা থেকে বাঁচতে আয়োজক সংগঠনের উপস্থিত সদস্যরা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান। ঘটনাস্থল থেকে ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ।
জানা গেছে, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার চিহ্নিত দোসরদের নেতৃত্বে বাংলা নববর্ষ অনুষ্ঠান উদ্যাপন আয়োজনের প্রতিবাদে’ মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মস‚চি অনুষ্ঠিত হয়। মূলত জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস), বিএনপির সহযোগী সংগঠন মিলে এই কর্মসূচির আয়োজন করে। জেলা প্রশাসক বরাবর দেওয়া স্মারকলিপিতে এই সংগঠনগুলোকে নববর্ষের অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
যারা এসব অভিযোগ তুলেছেন, তারাই সন্ধ্যায় ভাঙচুর চালিয়েছেন বলে আয়োজকদের অভিযোগ।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাসাসের সদস্যসচিব ও নববর্ষ উদ্যাপন মঞ্চের সংগঠক মামুনুর রশিদ (শিপন) সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে চায়। যারা ডিসি হিলে অনুষ্ঠান করছে, তারা দোসর। আমরা মানববন্ধন করে ডিসিকে স্মারকলিপি দিয়েছি। ভাঙচুরের বিষয়ে অবগত নই।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল ‘স্বৈরাচারের দালালরা, হুঁশিয়ার সাবধান’ ¯েøাগান দিয়ে মিছিল নিয়ে ডিসি হিলের ভেতর ঢুকে পড়ে। তারা মঞ্চে উঠে মঞ্চসজ্জায় ব্যবহৃত কাঠের স্থাপনা ভেঙে ফেলে। মঞ্চসহ আশপাশে লাগানো ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এ সময় মিছিলকারীরা ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ডিসি হিলে বর্ষবরণের কোনো অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করেন।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও ভাঙচুরকারীরা আগেই সেখান থেকে সরে যান। এ অবস্থায় আয়োজক সংগঠন সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের সংগঠকরা বৈঠকে বসে বর্ষবরণের কর্মসূচি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন।
জানতে চাইলে সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ আলী টিটো বলেন, ‘আমরা পহেলা বৈশাখের আয়োজনের সর্বশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ৪০-৫০ জনের একটি দল মিছিল নিয়ে এসে ভাঙচুর শুরু করে। তারা এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল যে, আমরা প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হলাম। মঞ্চের সবকিছু তারা ভেঙে ফেলেছে, ব্যানার সব ছিঁড়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় আমাদের নতুন করে মঞ্চসজ্জা করার আর সময় নেই। আমরা এত নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে প্রোগ্রাম করতে রাজি নই। সেজন্য সবার সম্মতিক্রমে প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আব্দুল করিম বলেন, ‘কয়েকজন লোক হঠাৎ মিছিল নিয়ে এসে মঞ্চে ভাঙচুর করেছে। সেখানে আমাদের পুলিশ সদস্যরা ডিউটি করছিলেন। তারা ভাঙচুরে বাধা দেন। পরে আমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছয়জনকে আটক করেছি।’
এর আগে সকালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ‘সম্মিলিত বাংলা নববর্ষ উদযাপন মঞ্চ, চট্টগ্রাম’ নামে একটি সংগঠন মানববন্ধন করে। এতে অভিযোগ করা হয়, চট্টগ্রামের ডিসি হিল ও সিআরবিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে শেখ হাসিনার দোসরদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় ছয়জনকে আটক করেছি। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে কেউ আহত হয়নি। কেবল ব্যানার ছিঁড়েছে। তবে মূল মঞ্চের কিছু হয়নি। এ ঘটনায় আটকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসনের আয়োজন : বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদ্নযাপন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম কর্তৃক বিভিন্ন কর্মস‚চি গ্রহণ করা হয়েছে। জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সকাল ৮টায় জাতীয় সংগীত ও ‘এসো হে বৈশাখ’ গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হবে কর্মস‚চি। পরবর্তীতে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে বৈশাখের শোভাযাত্রা এবং সকাল সাড়ে ৮টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক আয়োজন ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। বিশেষ অতিথি থাকবেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু।