বাঙলা নববর্ষ কি শুধুই উৎসব?

1

আজহার মাহমুদ

নবর্বষ মানে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া। এটা প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। সারা বিশ্বে ইংরেজি নববর্ষের সময় একসাথে উদযাপন করা হয়। তবে আমরা বাঙালিদের নববর্ষ সেটা নয়, যদিও আমাদের কালচার, সিস্টেম সব ইংরেজি পঞ্জিকাকেন্দ্রিক। তবে জাতি হিসেবে আমরা বেশ সমৃদ্ধ।
বাঙালি জাতির একটা আলাদা পঞ্জিকা রয়েছে, আমাদের রয়েছে একটা নিজস্ব নববষ। বাংলা সনের পহেলা বৈশাখ আমাদের সেই উৎসব হয়। জাতি হিসেবে এটাই আমাদের নতুন বছর হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের কাছে আজ এটা কেমন কেমন হয়ে গেছে। কারণ আমাদের কাছে পহেলা জানুয়ারি মানেই নতুন বছর! আমরা আজ অন্যের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতিতে নিয়ে এসেছি।
আমাদের সন বাংলা, আমাদের মাস বাংলা কিন্তু আমরা চলি ইংরেজি অনুযায়ী। অনেককেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আজ বাংলা সনের কত তারিখ, দেখবেন সে আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তারিখ-তো দূরের কথা কত সন সেটাই বলতে পারবে না। কিন্তু সবাই আবার বর্ষবরণ করে। এসব নিয়েই আমরা মূলত বাঙলা নববর্ষ আর পহেলা বৈশাখ পালন করি।
আমরা বাংলা সন অনুযায়ি চলি না, বলি না, করি না। অথচ আমরা এসা হে বৈশাখ এসো হে….. করে গাইতে থাকি। এসব কি লোক দেখানো নয়? কাউতে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলা নববর্ষ কখন? সে পহেলা বৈশাখ না বললেও ১৪ এপ্রিল ঠিকি বলবে। কারণ বাংলা মাস, বাংলা তারিখ এসব আমাদের কাছ থেকে এখন অযথা, অহেতুক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমরা শুধু এখন লোক দেখানো একদিনের উৎসব করি। প্রকৃত বাঙালি হয়ে উঠতে পারছি না।
পহেলা বৈশাখ আমাদের বছরের প্রথম দিন। অনেকেই বলেন আমরাতো নতুন বছরে পদার্পন করেছি জানুয়ারিতেই। অথচ সেই ইংরেজি সালটা কিন্তু আমাদের নয়। এই পহেলা বৈশাখটাই আমাদের। এটাই আমাদের বাংলা সনের শুরু। তাই সারা বছরের সকল জীর্নতা ক্লান্তি দূর করে পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের জন্য নিয়ে আসে আনন্দ আর ভালোবাসা। পহেলা বৈশাখ হচ্ছে লোকজের সাথে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধন। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীন জীবন যেটাই বলা হোক না কেন, এই নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্রিত করে জাতীয়তাবোধে। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশে বিদেশে বসবাসরত প্রতিটি বাঙালি এই দিন নিজ সংস্কৃতিতে নিজেকে খুঁজে পায়। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রতিটি বাঙালির কাছে শিকড়ের মিলন মেলায়। ধর্ম, বর্ণ সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিনত হয় উৎসবে। এই উৎসবের রং-ই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার জন্য এদেশের মানুষ সব সময়ই আন্তরিক, অকৃত্রিম ও অগ্রগামী।
দীর্ঘ প্রস্তুতির বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে অনেক আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সব পেশার মানুষ। বৈশাখী মেলা হালখাতা অনুষ্ঠান কিংবা নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয় এই নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানাতে। বাংলার পটশিল্পীরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসে। পটশিল্পে জায়গা করে নেয় আমাদের গ্রামীণ জীবনের নানা কথা। লোকজ ব্যবহারিক তৈজসপত্রের বিভিন্ন অংকন শিল্প আমরা খুঁজে পাই এই পটচিত্রের মাধ্যমে। শিল্পী তার রঙ্গীন আল্পনায় স্বপ্ন দেখে আগামী দিনের। নিজ সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জাতির প্রজন্ম।
নগরকেন্দ্রিক ব্যস্ততাকে পিছে ফেলে সমস্তশ্রেনী পেশার মানুষ এই দিনটিকে সাদরে বরণ করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা সকল অপসংস্কৃতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বাঙালি সংস্কৃতির জন্য যা ছিল একটি বিশাল অর্জন। এছাড়া রমনার বটমূলসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় সংগীত, নৃত্যকলা কিংবা আবৃতি। এই শিল্পগুলোর প্রতিটিই স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়কে। বরণ করে নেয় নিজ পরিচয়ের নববর্ষকে।
নববর্ষের এই উৎসব নারী পুরুষ সকলের। উৎসবে যোগ দেয়ার স্বাধীনতাও সবার সমান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নারী হয়রানি এবং নির্যাতনের বিষয়গুলো প্রায় বছরেই উঠে এসেছে উদযাপনকালে, উৎসবস্থলে। এমন পরিস্থিতি চব্বিশের এই নতুন বাংলাদেশে না হয় সেই প্রত্যাশা রাখছি।
এবারের নববর্ষের শুভক্ষণে মুছে যাক বিগত বছরের জরা এবং গ্লানি, যার মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন এবং জুলাই বিপ্লবের ঘটনাগুলো। সকলের প্রতি আহবান, যার যার অবস্থান থেকে, বছরের প্রথম দিনটি থেকেই সকল প্রকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ি। এছাড়াও একটা সুন্দর বাংলাদেশ কীভাবে পেতে পারি সেটাও এবারের পহেলা বৈশাখে আমাদের সকলের ভাবতে হবে। শুধু আনন্দ নয়, দেশের কথাও ভাবতে হবে আমাদের। একটি জাতি যখন তার নিজ সংস্কৃতিতে বলিষ্ঠ হয় তখন তাকে কোনো অপসংস্কৃতি, কু-সংস্কার গ্রাস করতে পারেনা। তাই নিজ সংস্কৃতির সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা শিল্পগুলোর নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। যে কোন জাতির কাছেই তার নিজ সংস্কৃতিই সেরা এবং আপন। বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেদের সংস্কৃতির রক্ষায় এবং বিস্তারে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ছায়াতলে অবস্থান নিতে হবে। অন্যান্য সংস্কৃতির সাথেও আমরা পরিচিত হব, তবে তার আড়ালে যেন ঢেকে না যায় আমাদের স্বকীয়তা। কিন্তু বর্তমানে আমরা যেন সে পথেই হাটছি। বাঙালি হিসেবে নিজ সংস্কৃতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থাকাও জরুরি। অন্যথায় পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা বাঙালির যেকোনো উৎসব হবে অর্থহীন। বাঙালির প্রাণ পহেলা বৈশাখকে আরও অর্থবহ করতে হলে প্রয়োজন বাঙালির স্বকিয়তা ধরে রাখা। তবেই বাঙালির প্রাণ বাঁচবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক