ড. সেলিম জাহাঙ্গীর
[সুফি ও তাসাউফ দর্শনের অভ‚তপূর্ব নান্দনিক প্রকাশের বেমেছাল আকর্ষণীয় নবতর অধ্যায়ের কথকতা]
প্রবেশক-
সময়কাল: ষষ্ট শতাব্দী। স্থান : মধ্যপ্রাচ্যের আরবভূমি।
আজ থেকে ১৪৫৩ বছর পূর্বে আমাদের মাতৃভূমি বাংলা থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরত্বে পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক নবী আখেরুজ্জমান হযরত আহমদ মুজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা স. (৫৭০-৬৩২) এর জন্ম, বিকাশ, ধর্ম প্রচার মোটামুটি সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরবভূমি।
হাজার বছর পূর্বে, হাজার মাইল দূরত্বের এই বঙ্গে মহানবী (স.) এর মহিমান্বিত নূরের প্লাবিত প্রভাব যে মৌলিকভাবে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার হাত ধরে সৃজনশীল কবি-সাহিত্যিক- লেখক- গীতিকার- সুরকার শিল্পীদের কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় ও মাত্রিকতায় উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবিত করেছিল হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য- সংস্কৃতির ইতিহাস তার আকর্ষণীয় উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগটা ছিল মূলত মুসলিম কবি- সাহিত্যিকদের অভাবনীয় অপূর্ব সৃষ্টিতে ঋদ্ধ। সুফি ঘরানার প্রতিশ্রুতিশীল জাত গবেষক মুন্সী আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আহরণ না করলে এই অনন্য সাধারণ সৃষ্টিশীলতার ইতিহাস ধামা চাপা পড়েই থাকতো। যে রকম অবলুপ্ত বা অবলুপ্ত প্রায় অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য আজও উদ্ধারের অপেক্ষায়।
১৪ শতকের বাংলা সাহিত্যের আদি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’ হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান নিস্তরঙ্গ ধারায় এক চাঞ্চল্যকর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচক। এই
অনন্য সৃষ্টিশীলতায় ‘রাসুল (স.) প্রশস্তির ধারায় ‘নাতে রাসুলের সূচনার প্রতিনিধিত্বমূলক চুম্বকসার বর্ণনায় এই সত্যটি ফুটে উঠেছে ভোরের আলোর ভৈরবী রাগে
(ক) জীবাত্মায় পরমাত্মা মোহাম্মদ নাম/ প্রথম প্রকাশ তথি হৈল অনুপাম/জথ ইতি জীব আদি কৈলা ত্রিভুবন/ মোহাম্মদ হোন্তে কৈলা তা সব রতন\
(খ) এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবীকুল/ মোহাম্মদ তান মধ্যে আদ্যমূল\
(গ) অনন্ত ছজিদা মোর সর্বঅঙ্গ ভরি/ অনেক প্রনাম তান পদ অনুসারি\
মোহাম্মদ সগীর দাসক দাস তান/ তাহা হোন্তে বড় ভাগ্য মোক নাহিআন\’
(মুহাম্মদ এনামূল হক রচনাবলী বাএ ২ খন্ড. পৃ. ৬০৭, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মহানবী (স.) ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ. ২৬৬)
বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য সাহিত্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দের (১৯৪৩-২০১০) অভিব্যক্তিতে এই শাশ্বত সত্যটি ফুঠে উঠেছে ঐতিহাসিক বাস্তবতায়- “বস্তুত হজরত মুহাম্মদ (স.) ই বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক আলোচিত ও প্রশংসিত একক ব্যক্তিত্ব। এবং যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাঙালি মুসলমান থাকবে, ততদিন বাংলা ভাষায় হজরত মুহম্মদ (স.) এর কীর্তি গাথা চলতেই থাকবে। (আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলী, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৩২১)
ক্রম সম্প্রসারমান ধারায় রাসুল প্রশস্তির এই প্রাণময় গতিময় অভীপ্সার ধারা ১৬ শতকের কবি দৌলত কাজী বাহরাম খাঁর “লায়লী মজনু” কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে প্রায় একই সমতলে-
প্রনামহুঁ তান সখা মোহাম্মদ নাম/ এ তিন ভুবনে নাহি যাহার উপাম\
নুর নবী কান্ডারী আছ এ যে ই না এ/ সাগর তরঙ্গ ভয় নাহিক তথাএ\
সর্বাংশে ভরসা মোর চরণে তোমার /ইহলোক পরলোক তুম্মি মাত্র সার\ (-লায়লী মজনু, আহমদ শরীফ সম্পাদিত, পৃ. ৮১)
১৬ শতকের সমাপ্তি লগ্নের কবি শেখ চান্দ এর ‘তালিব নামা’ কাব্য গ্রন্থে এ ধারায় অনুরণন শুনা যায় এভাবে-
বন্দন নূর মোহাম্মদ হাবিব আল্লার/ চৌদ্দ ভুবনের পীর মহিমা অপার।
আউয়ালে আখেরে করি একিদা নূরের/ গুনা মাফ করাইব চৌদ্দ ভুবনের \
কেহ তান কহিতে না পারে গুন সীমা। পৃথিবীতে দিতে নারে তাঁহার মহিমা \ (বাঙলার সুফী সাহিত্য, আহমদ শরীফ, পৃ. ৭৭
‘সুরতনাম’ ও নুর জামাল কাব্যের লেখক ১৬ শতকের কবি হাজী মুহম্মদ তাঁর সুরতনামা (ড. আহমদ শরীফের ভাষায় “বাঙলার সুফী শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। (বাঙালি ও বাঙলাসাহিত্য, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩২)
মারফত-তাসাউফের আলোকে রাসুল মাহাত্ম্য প্রতিফলিত হয়েছে এভাবে-
আপনা খোয়াস্ত আল্লা করিলা যেখন/ আপনারে আপে ব্যক্ত করিতে কারন।
জাত হোন্তে করিলেক সিফত বাহির/ বীজ হোন্তে বৃক্ষ যেন হইল জাহির।।
জাত সিফতে সেই নূর অনুপম/ নূর মোহাম্মদ তান রাখিলেক নাম।
(বাঙলার সুফী সাহিত্য, ড. আহমদ শরীফ, পৃ. ১২৩)
সতের শতকের কবি মুহাম্মদ খান। কাশীরাম দাসের ‘বাংলা মহাভারতের’ প্রতিদ্ব›দ্বীরূপে রচিত মহাকাব্যিক উপাদানের লক্ষনাক্রান্ত মক্তুল হোসেন কাব্যে রাসুল প্রশস্তি ফুটে উঠে প্রভুর দর্পনের অনুপম উপমায়- নিরঞ্জন চিনিবারে নবী মাত্র লক্ষ্য/ নহে প্রভু চিনিবারে করিয়াছ সক্য।
দর্পনে দেখিও যেন আপনা বদন/ নবীকে ভাবিরে পাই প্রভু নিরঞ্জন\
(রাসুলের শানে কবিতা, আসাদ বিন হাফিজ, মুকুল চৌধুরী সম্পাদিত, পৃ. ১৩০)
সতের শতকের কবি মীর মুহম্মদ সফী। প্রখ্যাত মুসলিম কবি সৈয়দ সুলতানের পৌত্র এবং ‘নুর জামাল’ কাব্য গ্রন্থের কবি হাজী মুহম্মদ এর এই আধ্যাত্মিক শিয্যের “নুর নামা” কাব্য গুপ্ত তথ্যে ঠাঁসা এক অনুপম সৃষ্টি; স্রষ্টার কুদরতির প্রতিফলিত রূপ-
নূর মোহাম্মদ জান মিত্র নিরঞ্জনী তান নামে তরিবেক এতিন ভ‚বন।
আর্শ কোর্সি লৌহ্ আদি যত কুদরতি/ উদ্ধারিব যত জীব সেই নাম গতি।
(বাংলার সুফি সাহিত্য, আহমদ শরীফ, পৃ. ১৫৩)
সতের শতকের কবি দৌলত কাজী। ‘সতী ময়না লোর চন্দ্রানী কাব্যের লেখক এই সুফি কবি ত্রিভুবনের সর্বত্র অবলোকন করলেন নূরেরই ঝলোয়া-
আহাম্মদ আল্লার রসুল সখাবর/ যাঁর নূরে ত্রিভ‚বন করিছে প্রসর।
শ্যাম তনু জ্যোতির্ময় সর্বাঙ্গ দাপনি/ নবুওত পৃষ্ঠে যেন জ্বলে দিনমনি।
(রাসুলের শানে কবিতা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৮)
যুগপৎ গ্রীক ট্রাজেডী ও শেকসপীয়ারন ট্রাজেডীর শোচনীয় বিষন্নতায় মূর্তমান প্রতীক মহাকবি আলাওল (১৬০৭-১৬৭৩) এর কাব্য জীবন অনুপম সৃষ্টিশীলতার জীবন ছিল সম্পূর্ণ বিপরিত অবস্থানে চিরায়ত শাশ্বত ধারায় সতত স্মরণীয় বরণীয়। আলাওল সমগ্র আবিস্কারক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ যাঁকে ‘সপ্তদশ শতাব্দীর রবীন্দ্রনাথ (অভিভাষন সমগ্র: আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ঈসমাইল খান সম্পাদিত, পৃ. ৭২) বলে অভিষিক্ত করেছেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যাঁকে মধ্যযুগের অবিসংবাদিত অপ্রতিদ্ব›দ্বী কবি প্রতিভা (বাংলা সাহিত্যের কথা, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৩৩) বলে পরিচিহ্নিত করেছেন বাংলা সাহিত্যের সেই অমূল্য রতন মহাকবি আলাওলের মহিমান্বিত নবী প্রেমের প্রতিফলিত রূপ হিসেবে তাসাউফজগতের সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ বেশ কিছু চুম্বকসার বিষয় উঠে এসেছে বোদ্ধা পাঠক শ্রেণীর হৃদয় ছোঁয়া বর্ণনায়- ১। সৃষ্টিমূল ২। চন্দ্র দ্বিখন্ড করণ ৩। ছায়াহীন কায়া ৪। মেরাজ ইত্যাদি।
১। নিজ সাখা মোহাম্মদ প্রথমে সৃজিলা। সেই জ্যোতিমূলে ত্রিভুবন নিরমিলা। (আলাওল রচনাবলী, বা. এ পৃ. ৫)
২। কে বুঝিতে পারে তান মহিমা প্রচন্ড/অঙ্গুলি ইঙ্গিতে যাঁর চন্দ্র দ্বিখন্ডিত। (আলাওল রচনাবলী, ঐ, পৃ. ১৯৭)
৩। ছায়াহীন কায়া না পরশে মক্ষিকাএ/ বাক্যধারী হই সর্পে যার গুন গাএ। (প্রাগুক্ত, পৃ.৫)
৪। কোটি পরে কোটি গিরি গিরির উপর/ শূন্য পৃষ্টে আরোহন হইলা সত্ত¡র।
ষট দিক তেজিয়া হইয়া অঙ্গহীন/ সমুদ্রে মিশিলে যেন কেবা পাত্র চিন
দুই ভাব খন্ডি মাত্র রহিল একতা/ নাসুতা খন্ডিল যদি কথাত ব্যগ্রতা। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৩)
ক. বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষ প্রান্তে আবিভর্‚ত কবি হেয়াত মামুদ (জ. ১৬৮০) পূর্বসুরী আলাওলের মত তাঁর কাব্য সমগ্রও নবী বন্দনায় মুখরিত। জঙ্গনামা, সর্বভেদবাণী, হিতজ্ঞান বাণী, আম্বিয়া বাণী চারটি কাব্য গ্রন্থের সর্বত্র এ সত্যটি প্রতিফলিত।
ক) বন্দো নবী মুহাম্মদ যে হইল আহাম্মদ / আহাদ হইতে উপাদান। এক নূর দুই ঠাঁই কইল পরম সাঁই/ নূর মহাম্মদ সেহি জান।
খ) যথা নবী থাকে যায় আচ্ছাদিয়া মেঘ ধায়/ মাথার উপর ছত্র ধরি।
অন্ন পানি খায় নবী সৌচে যায় দেখে সবি/ নাহি তার মলের প্রকাশ।
সেহিতো খোদার ছাঞি কায়ে এছ ছায়া নাই/ যেমন ছায়ায় ছায়া নাশ\
গ) বোরাকের পৃষ্টে চড়ি গেল সপ্ত স্বর্গ ছাড়ি/ চক্ষের নিমিষে মেহেরাজ
খোদার দিদার করি পুনহ আইল ফিরি/ দীর্ঘ পথ পলকের মাঝ\
(কবি হেয়াত মামুদ, মাযহারুল ইসলাম, পৃ. ৪৯৩)
বঙ্গবিখ্যাত পুঁথি সাহিত্যিক সৈয়দ হামজা (১৭৩৩-১৮০৩)্ মধুমালতী, আমীর হামজা ও হাতেম তাই এর লেখকের নানামাত্রিক বর্ণনায় রাসুল প্রশস্তি ফুটে উঠেছে দৃশ্যকাব্যের মতোই-
ক) একেলা আছিল যবে সেই নিরঞ্জন/ আপনার নূরে নবী করিল সৃজন।
দুনিয়া করিল পয়দা তাহার কারন/ আসমান জমিন আদি চৌদ্দ ভ‚বন।
সেই যে নবীর নূরে তামাম আলম/ বেহেস্ত দোজখ আর লওহ কলম।
পয়গম্বর এক লাখ চব্বিশ হাজার/ তার দিকে মুহাম্মদ সবের সরদার\
খ) ইসা, মুসা, নূহ নবী যত পয়গম্বর সবি,/ কহিবেন কি হবে আমার।
তবে দ্বীনি পয়গম্বরে, ওম্মত লোকের তরে, /কাঁদিয়া হইবে জার জার। (রাসুলের শানে কবিতা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৪-১৪৫)
“বিষাদ সিন্ধুর রূপকার, বঙ্কিম যুগের অপ্রতিদ্ব›দ্বী মুসলিম লেখক মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) ৩৬টি গ্রন্থের লেখক, যার মধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থের সংখ্যা ডজন খানেক। এসলামের জয়, মোসলেম বীরত্ব, মদিনার গৌরব এবং মৌলুদ শরীফ এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলা গজল এর সূচনাকারী হিসেবে মীর মশাররফ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়। ঊনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলমান গদ্য সাহিত্যিকের মৌলুদ শরীফ প্রাধান্যে উল্লিখিত কাব্য সমুহের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে রাসুল মাহাত্ম্যের কথকতা-
(ক) হযরত আদমের জন্মের আগে/ নবীর নাম আরশের উঠে শিরোভাগে\
কেবল আদম জন্ম প্রথম হয়েছে। যখনই পেয়েছে জ্ঞান তখনই দেখেছে\
সেই নূর মুহম্মদ নবী আমাদের/ যাঁর নামে হব পার পাইব আখের\
খ) মাটিতে বসিলে পরে, শব্দ হয় উচ্চস্বরে/তব পৃষ্ঠে নূর মোহাম্মদী।
সম্মানে স্থাপিত হয় সে জন্য সালাম কয়/ আকাশ পাতাল পরবতাদি\
গ) এয়া নবী! সালাম আলায়কা/ এয়া রসুল সালাম আলায়কা।
কায়মনোবাক্যে আশেকে রাসুল (স.) তাঁর ঐকান্তিক নিবেদনে স্থান কাল পাত্র ছাপিয়ে বঙ্গনামক ভ‚খন্ডের আপামর আশেকে রাসুলদের একান্ত মনোবাসনারই প্রতিধ্বনি ঘটিয়েছেন নান্দনিক অভিব্যক্তিতে-
কোথায় আরবভ‚মি, কোথা বঙ্গ কোথা তুমি/ নতশিরে নমি আমি; মোহাম্মদ এয়া রাসুলোল্লাহ।
গাইব তোমার গান, হৃদে বল করদান/ দাও পদে বিন্দুস্থান; – মোহাম্মদ এয়া রাসুলুল্লাহ।
দিও অন্তে পদাশ্রয়, ওহে নবী দয়াময়/ করযোড়ে কবি কয়; মোহাম্মদ এয়া রসুললোল্লাহ\
(মশাররফ রচনা সম্ভার, বাংলা একাডেমী, ৩য় খন্ড, পৃ. ৪০০, ৪১৮, ৪৩৬, ৩৯৮)
ব্যক্তিগত দুঃখবোধ এবং অতৃপ্তিকে কাব্যে রূাপায়নে, নিজের দুঃখবোধ ও আকাঙ্খাকে বৃহত্তর পাঠক আকঙ্খায় পরিগনিত করার কৌশলী শিল্পী দাদ আলী (১৮৫২-১৯৩৬) মক্কাশরীফে গিয়ে মদিনায় পৌছতে না পারার অতৃপ্তি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কাব্যে-
ক) অদৃষ্টের ফেরে যেতে মদিনায়/ পীড়া রূপ রিপু বাধা দিল তায়।
তাই আশা মনে নবী গুনগানে/ জুড়াইব হৃদি, আরো শ্রোতাগনে।
শুনাইব নবী গান তব তানে\
খ) তোরে অভয় দিতে সে গোরেতে/ ডাকলে কেউত না আসিবে\
কেবল সেই পাপীর বন্ধু গুনের সিন্ধু/ মোহাম্মদ (স.) তোয় তরিবে।
গ) আজি তাঁর জন্ম দিন, মউলুদ পাঠ কর/ সবে মিলি আজি “সাল্লে আলা” হার গলে পর। ধর স্বর ধর তান/ গাও নবী-গুনগান\
গাও সবে গাও, কাঁপাইয়া দশ দিশি
শুনুক না সে হুর মালা এক বসি\
(কবি দাদ আলীর জীবন ও কাব্য, সিদ্দিকুর রহমান, বাংলা একাডেমী, পৃ. ১১৩, ১২৩, ১৪৪)
বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরনের সময়কালের সূচনালগ্নের কবি শেখ ফজলুল করিমের (১৮৮২-১৯৩৬) ১১ সর্গে বিভক্ত রাসুল প্রশস্তির এক অনবদ্য সৃষ্টি তাঁর ‘পরিত্রান’ কাব্য। প্রচলিত ধারায় একই বৃত্তের বাইরে অবস্থান করে, সম্পূর্ণ উর্ধে উঠে প্রিয় নবীর বিশেষত্ব ও হুলিয়া মোবারকের (শারীরিক বর্ণনা) আনুপূর্বিক বর্ণনায় তাঁর স্বকীয়তা সুস্পষ্ট। প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনাকে আপনার মতো করে মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণনার এই দৃশ্যকাব্যরূপ মুন্সীয়ানা সত্যিই অনন্য-
অমীয় – জড়িত, জ্ঞান প্রপুরিত, কেমন মধুর তব ভাষা,
বপু- জ্যোতির্ম্যয়, দীর্ঘ চক্ষুদ্বয়, সুশোভিত, সুগঠিত নামা।
বদন মন্ডলে শ্মশ্রæ সুশোভিত, রূপের তুলনা নাহি হয়,
জ্যোতিময় ঊষা, পুর্ণিমার নিশা, তুলনায় তব সম নয়।
যে শুনে বচন, মুগ্ধ সেইজন, প্রান-মন দেয় সমপিঁয়া।
আজানু লম্বিত বাহু সুগঠিত, বিকচ কমল শ্রী পদযুগল,
রজত খুদিয়া, স্কন্ধ নিরমিত, প্রসন্ম ললাট নিরমল।
নিকটে যে এস, কিবা যেন পায়, মলিনতা হয় দূর তার,
হাসি হাসি মুখ, হরি লয় দুখ, ঢালি দেয় শান্তি ভক্তি আর।
(শেখ ফজলুল করিম রচনাবলী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ. ৭)
নজরুল যুগে স্বতন্ত্র সত্তায় উদ্ভাসিত কবি শাহাদাৎ হোসেনের (১৮৯৩-১৯৫৩) স্বতন্ত্র সত্তায় স্বকীয় সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়ায় নবী প্রেমের উদ্দীপনা এক আকর্ষনীয় নতুনমাত্রা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে-
ক) বিস্ময় হত নর নারী সব চেয়ে রহে অনিমেষে/ সহসা দরদ ফুটিল কণ্ঠে অজ্ঞাতে অবশেষে;
লক্ষ কণ্ঠে উঠিল ধ্বনিয়া আলাইকাস সালাম/ ইয়া রসুল সাল্লাল্লাহো আলায়কাস সালাম।
‘নাত’ শিরোনামে মাত্র পাঁচ লাইনের আরেক অনন্য সৃষ্টি পাঠক হৃদয়ে অনুরণন তোলে বিনা তারে বীণার ঝংকারের অনুরণনে-
আরবের নবী/ কোরানের কবি/ কোকাফ আধারে জাগ্রত রবি
লহ তসলিম হুজুরে সালাম/ সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম
(শাহাদাৎ হোসেনের ইসলামী কবিতা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ. পয়ত্রিশ ১.
‘বিশ্ব নবী’ এর লেখক, ইসলামী রেনেসাঁর কবি গোলাম মোস্তফার গদ্য রাসুল মাহাত্ম্যের শাশ্বত দলিল ‘বিশ্বনবীর’ পাশাপাশি কাব্যেও ফুটে উঠেছে নবী বন্দনার নানা মাত্রিক কথকতা। আরবের ঘোর অন্ধকার সময়ে প্রিয় নবীর কল্পনাতীত সদাচরন নিয়ে যা লিখেছেন তার চুম্বকসার কিছু অংশ।
ক) অন্যায় অবিচারে ধরাবাসী লিপ্ত/ রক্তের লালসায় তনুমন দীপ্ত,
ভাই-ভাই ঠাঁই ঠাঁই হয়না মীমাংসা/ মারামারি কাটাকাটি ঈর্ষা জিঘাংসা
ভিক্ষুকে টেনে নেয় আপনার বক্ষে/ ছোট বড় ভেদ জ্ঞানে নাহি তার চক্ষে/ মানুষের আত্মারে করেনা সে ক্ষুদ্র/ হোক না সে বেদুঈন হোক না সে শুদ্র।
খ) নিখিল বিশ্বের চির সুন্দরের শাশ্বত প্রতীক হিসেবে মহানবী (স.) এর তুলনারহিত বিশেষত্বের বর্ণনা- (চলবে)
নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি আমার মোহাম্মদ রাসুল/ কুল মখলুকাতের গুলবাগে যেন একটি ফোটা ফুল।
নূরের নবী যে আমার নবী/ পূন্য করুনা ও প্রেমের ছবি।
মহিমা গায় তার নিখিল কবি, কেউ নয় তার সমতুল।
গ) নবীজিকে বুকে ধারণ করে রাখার বেমেছাল পবিত্র ভ‚মি পবিত্র মদিনা মনোয়ারার অভিব্যক্তি-
অগো মদিনা মনোয়ারা/ কে বল তুমি মরুভ‚মি, কে বলে তুমি সবহারা।
মরুভ‚মি নওকো তুমি, তুমি যে গুল বাগিচা।
খ) কাসিদা রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি গোলাম মোস্তফা শুরু থেকে আজ অবধি নবী প্রেমিকদের হৃদয় দখল কের আছেন মর্যাদাপূর্ণভাবে।
এই কাসিদা দিয়েই আমরাও জানাই প্রিয় নবীকে হাজারো সালাম-
ইয়া নবী সালাম আলাইকা/ ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা
ইয়া হাবীব সালাম আলাইকা/ সালাওয়া তুল্লা আলায়কা।
নবী না হয়ে দুনিয়ার/ না হয়ে ফেরেশতা খোদার
হয়েছি উম্মত তোমার তার তরে শোকর হাজার বার\
( কাব্য গ্রন্থাবলী গোলাম মোস্তফা, রাসুলের শানে কবিতা, পূর্বোক্ত, নির্বাচিত ইসলামী গান পূর্বোক্ত)
কাজী নজরুল ইসলাম
(১৮৯৯-১৯৭৬)
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কালানুক্রমিক ধারায় রাসুল (স.) প্রশাস্তির হৃদয়ছোঁয়া প্রকাশ বিকাশের ক্ষেত্রে ‘বিশ্ব নবীর’ লেখক কবি গোলাম মোস্তফার এক বছর পরেই ‘রাসুল প্রসস্তির বুলবুল’ কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল এবং গতি সঞ্চারক অনন্য প্রতিভা হিসেবে নজরুল সত্যিই অবিস্মরনীয়। আর এই বিস্ময়কর সৃষ্টিশীলতার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে রাসুল প্রশস্তিমূলক কবিতা ও গান।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের শেষ বছরকে বিদায় আর বিশ্বব্যাপী অসম্ভবকে সম্ভব করার বিংশ শতাব্দীকে সাহিত্যে ঐ মাত্রিকতায় ধারণ করার প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণার মধ্যদিয়ে ১৮৯৯ সালে জন্ম নেওয়া কবি তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি রাসুল প্রশস্তিতে পূর্বসুরীদের সৃষ্টিশীল ঐতিহ্যকে
অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে, সম্মান মর্যাদায় ধারন লালন ও প্রতিপালন করে বাংলা সাহিত্যে রাসুল প্রশস্তির ঐতিহ্যিক ঐতিহাসিক ধারাকে যুগপৎ মাত্রাগত ও গুনগত উৎকর্ষতার নতুন মাত্রিকতা দান করে এক অভাবনীয় আকর্ষণীয় নতুন যুগের সূচনা করেন।
শুধু ইসলামী সাহিত্যে নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ধারায় নজরুল তাঁর অভাবনীয় অনন্য সৃষ্টিশীলতার গুনে স্বতন্ত্র ধারায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন ‘ধুমকেতুর’ বিস্ময় নিয়ে। রবীন্দ্রযুগে (১৮৬১-১৯৪১) জন্মগ্রহণ করে ঐ বলয়ের বাইরে আত্ম জিজ্ঞাসার অনন্ত সন্ধানের পাশাপাশি যুগযন্ত্রনার সার্থক বাণী বাহক হিসেবেও স্বতন্ত্র যুগের সূচক কাজী নজরুলের লেখনী জগতের সূচনা কালেই স্বত:স্ফ‚র্ত প্রাণময় গতিময় অভীপ্সায় ফল্গুধারার মতোই বেরিয়ে আসতে শুরু করে ¯্রষ্টা- সৃষ্টির সম্পর্ক আল্লাহ-রসুল কথকতা। আর এই ধারায় সূত্রপাত ঘটে মহানবী (স.) এর শুভ আবির্ভাব বিষয়ক কবিতা ফাতেহাই দোয়াজ দহম (আর্বিভাব) এর মাধ্যমে-
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপাক হাসান আবদুল কাইয়ুমের মন্তব্যটি স্মরণযোগ্য-
“ বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রিয় নবী (স.) এর উপর কবিতা ও নাত রচনায় রীতিমতো হিড়িক পড়ে যায়। এক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক অবদান রাখেন কাজী নজরুল ইসলাম। কবি নজরুল ইসলামের “ফাতেহা-ইয়াজ দহম’ শীর্ষক কবিতার আবির্ভাব ও তিরোভাব উভয় অংশই বাংলা কাব্যে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। তাঁর রচিত প্রতিটি নাতে নবী প্রেমের প্রবল স্পন্দন রয়েছে।”
(সাহিত্য সংস্কৃতি মহানবী (স.) ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ. ২৫১)
“শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের গর্জন শুনা যায়, তেমনি নবীবন্দনা তথা রাসুল প্রশস্তির দিগন্ত প্রসারিত বিশাল বিস্তৃত পরিমন্ডলে নজরুলের প্রথম সৃষ্টিতেই তাঁর ভবিষ্যৎ অপার সৃষ্টি সমূহের সাংকেতিক অনুরণন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল ‘বিনা তারে বীণার অনুরণনের মতো’। আমার এই পর্যবেক্ষণকে প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল গবেষকের অনেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রায় একই সমতলে, যা ‘রাসুল প্রসস্তির বুলবুল’ নজরুলকে গভীর থেকে গভীরতর পর্যায়ে নিবীড় গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচন করে দেয়। নজরুল ইনষ্টি টিউটের নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক) বাঙলি জাতি সত্তার কবি, কবি নুরুল হুদার জীবনঘনিষ্ট সুগভীর পর্যবেক্ষণ এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভাবেই প্রণিধানযোগ্য-
“হযরত মোহাম্মদ (স.) এর আবির্ভাব ও তিরোভাব বর্ণনা করতে গিয়ে ধ্বনিসাম্য বজায় রেখে অর্থানুগভাবে যে অজ¯্র আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার ঘটেছে এই কবিতায়, (প্রথম কবিতা) তা সমগ্র বাংলা ভাষার স্বভাবেই সঞ্চারিত করেছে নতুন চলমানতা। অজানা-অচেনা শব্দ পদে পদে, তবু অর্থ উদ্ধারের জন্য থমকে যেতে হয়না, সচেতন পাঠককে ব্যাকুল চিত্তে সমাপ্ত করতে হয় এর পাঠ, এবং সব অর্থ উদ্ধারের আগেই কবিতাটি অধিকার করে বসে পাঠকের মন ও মনন।” (জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্ম বার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ, নজরুল ইনষ্টিটিউট, পৃ. ২৭)
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রবহমান ধারায় নজরুল তাঁর অভিনবত্বের কারণে একক ও অনন্য ভ‚মিকায় অবতীর্ণ, প্রায় একই বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়ার বর্ণনায় ঘেরাটোপ টপকে নজরুল নিয়ে
এসেছিলেন জীবন ঘনিষ্ঠ সৃজনশীলতার রাঙা দিশা; রীতিমতো উল্লম্ফন। ১৯২০ ফাতেহা-ই- দোয়াজদহম দিয়ে যা শুরু ১৯৪২ সালে নির্বাকতা পর্যন্ত এ সৃজনশীল ধারায় একান্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে, নিজেকে কায়মনোবাক্যে নিবেদন করে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী অনবদ্য সব কাব্য, সঙ্গীত। এ ক্ষেত্রে রচনার গুনগত ও মাত্রাগত বিচারে নজরুল শুধু মাত্র বাংলা সাহিত্যেই নয় বিশ্ব সাহিত্যেও আকর্ষনীয় মাইল ফলকে পরিগণিত। এ প্রসঙ্গে গবেষক ড. এস.এম লুৎফর রহমানের গবেষনালব্দ পর্যবেক্ষনটিও প্রনিধানযোগ্য-
বিশ শতকের কবিদের মধ্যে একমাত্র জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম আখেরী নবী (স.) এর জীবনের নানা বিষয় নিয়ে যতগান রচনা করেছেন তত আর কেউ লেখেননি।তিনি রাসুল (সা.) এর আর্বিভাব ও তিরোভাব নিয়ে ফাতেহা ই দোয়াজ দহম নামক যে কবিতা লিখে গিয়েছেন তার তুলনা সারা বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। (সাহিত্য সংস্কৃতি ও মহানবী (সা.) পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫১)
আমার পর্যবেক্ষনে নজরুলের জীবনে ২০ ও ২২ সংখ্যার একটা অত্যাশ্চার্য সমীকরণ ছিল ক্রিয়াশীল। ১৯২০ সালে লেখেন ফাতেহা-ই দোয়াজদহম। নজরুলের লেখালেখি র সূত্রপাত ঘটে ২০ বছর বয়সে। (১৯২০-১৯৪২) এই ২২ বছরে রচনা করেন অনন্যসাধারণ অত্যাশ্চার্য সব রাসুল প্রশস্তি। মাত্র ২২ বছর বয়সে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখে হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র সত্তায় সত্য-সুন্দর প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের প্রতীক।
আলাওলের সৃজনশীল সৃষ্টিশীলতার আলোচনায় আমরা রাসুল প্রশস্তির বর্ণনা সমূহকে চারটি ভাগে ভাগ করে ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে তার বিশেষত্ব পর্যালোচনা করেছিলাম। নজরুলের এসে দেখি এর সৃজনশীল ব্যাপকতা। যুগপৎ ব্যাপক ও বহুমাত্রিক আকর্ষণীয় গুনগত ও মাত্রাগত শ্রীবৃদ্ধি ও হৃদয়ছোঁয়া নান্দনিক উৎকর্ষতার এক অত্যাশ্চার্য অভিনব উত্তরণ রীতিমতো উল্লস্ফন। তেরটি (১৩টি) পর্যায়ে একে ভাগ করেও যেন তৃপ্তি পাচ্ছিনা। মোটামুটি এই তেরটি শ্রেণী হলো – ১। নূরে মোহাম্মদী, ২। শুভ আবির্ভাব, ৩। হুলিয়া মোবারক, ৪। নবীজির দর্শন লাভের কায়মনোবাক্যিক আকুতি, ৫। রহমাতুল্লিল আলামিনের বিশেষত্ব, ৬। মেরাজের অবিস্মরণীয় অভ‚তপূর্ব বিশেষত্ব, ৭। মদিনা বিরহ, ৮। নবীজির বদান্যতা, ৯। আল্লাহ-রাসুল সম্পর্কের পৌন পৌনিকতা, ১০। নবীজির নামের প্রতি শ্রদ্ধা, ১১। মুহরে নবুয়তের বিশেষত্ব, ১২। বিদায় লগ্নের বিষন্ন গাঁথা, ১৩। সমন্বিত নবী প্রেম।
নূরে মোহাম্মদী: হযরত আদম (আ.) পেশানিতে ছিল নূরে মোহাম্মদী তাঁর মাধ্যমেই দুনিয়াতে এর শুভাগমন। নজরুল কাব্যে এই শাশ্বত সত্যটি ফুটে উঠেছে রীতিমতো দৃশ্যকাব্যের মতো
(ক) সৃজিয়া মানব -আত্মা তাহার দানিল মানব দেহে
কাঁদিতে লাগিল মানব আত্মা পাশিয়া মাটির গেহে।……
কহিলেন প্রভু, “ভয় নাই, দিনু আমার যা প্রিয়তম
তোমার মাঝারে জ্বলিবে সে জ্যোতি তোমাতে আমারিসম।
আমা হতে ছিল প্রিয়তর যাহা আমার আলোর আলো-
মোহাম্মদ সে, দিনু তাঁহারেই তোমারে বাসিয়া ভালো।” (মরু ভাস্কর অনাগত. পৃ. ২১)
(খ) আদমেরি পেশানিতে জ্যোতি ছিল যাঁর/যার গুনে নুহ তরে গেল তুফান পাথার।
যাঁর নূরে নমরুদের আগুন হলো ফুল হার/ সেই মোহাম্মদ মোস্তাফা এলেন নিয়ে দ্বীন ইসলাম।
(নজরুল রচনাবলী বাএ. ১১খন্ড, পৃ.২১৫)
(গ) ছিল নবীর নুর পেশানিতে /ভুলবনা কিশতি নূহের
পুড়লনা আগুনে হযরত /ইবরাহিম সে নমরুদের।
বাঁচল ইউনুস মাছের পেটে স্বরণ করে নবীর পদ!
দোযখ আমার হারাম হল/ পিয়ে কোরানের শিরিন শহদ। (ঐ.পৃ. ৩০৪)
শুভ আর্বিভাব: বাবা আদমের সাথে ধরনীতে আসা নূরের প্রকাশের অনিবার্য প্রয়োজনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান অনন্ত সৃষ্টিকুল এক মাহেন্দ্র ক্ষণে খুঁজে পেল সিংহল চ‚ড়ার প্রলম্বিত রূপ মরু সাহারায়
(ক) মরু সাহারা আজি মাতোয়ারা/ হলেন নাজেল তাহার দেশে খোদার রসুল-
যাঁহার নামে যাঁহার ধ্যানে/সারা দুনিয়া দীওয়ানা প্রেমে মশ্গুল।
যাঁহার আসার আশাতে অনুরাগে/ নীরস খর্জুর তরুতে রস জাগে।
তপ্ত মরু, পরে/ খোদার রহম ঝরে/ হাসে আশাশ পরিয়া চাঁদের দুল।
ছিল এ ত্রিভুবন যাহার পথ চাহি/এলোরে সেই নবী ‘ইয়া উম্মতি’ গাহি’।
যত্রেক গুমরাহে নিতে খোদার রাহে/এলো ফুটাতে দুনিয়অতে ইসলামী ফুল\ (নজরুল সঙ্গীতের নির্বাচিত বানী সংকলন, নজরুল ইন্সটিটিউট, ১৯৯৭, পৃ. ৪২৭)
(খ) ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ/ এলরে দুনিয়ায়/ আয়রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়।
ধুলির ধরা বেহেশ্তে আজ জয় করিল দিলরে লাজ/ আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়\
দেখ আমিনা মায়ের কোলে/ দোলে শিশু ইসলাম দোলে/ কচি মুখে শাহাদাতের বাণী সে শুনায়\
আজকে যত পাপী ও তাপী সব গুনাহের পেল মাফী/ দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী জুলুম নিল বিদায়\
নিখিল দরুদ পড়ে লয়ে নাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম/ জীন পরি ফেরেশতা সালাম জানায় নবীর পায়\ (নজরুল সঙ্গীতের বানী সংকলন, পৃ. ৪৩৫ শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ, ঞডওঘ ঋঞ ৩৪৮০)
(গ) সাহারাতে ফুটলরে/রঙিন গুলে লালা/ সেই ফুলেরই খুশবোতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা\
সেই ফুলেরই রওশনিতে/আরশ কুর্শি রওশন/ সেই ফুলেরই রংলেগে/আজ ত্রিভ‚বন উজালা\
জাহে সে ফুল জ্বীন ও ইনসান হুর পরী ফেরেশতায়/ ফকীর দরবেশ বাদশা চাহে করিতে গলার মালাতোরে)
চেনে রসিক ভ্রমর, বুলবুল সেই ফুলের ঠিকানা কেউ ব:েল হযরত মোহাম্মদ কেউবা কম্লী ওয়ালা\
(ঋ.ঞ.৩২১৭ শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ নজরুল সঙ্গীতের বাণী সংকলন, পৃ.৫০)
(ঘ) ইসলামের ঐ সওদা লয়ে/এলনবীন সওদাগর/ বদনসিব আয়, আয়গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। (ঐগঠ ঘ.৪১১১. শিল্পী আব্বাস উদ্দীন, নজরুল সঙ্গীত বানী সংকলন, পৃ. ৪১৩)
(ঙ) তোরা দেখে যা, আমিনা মায়ের কোলে/ মধু পূর্ণিমারই মতো চাঁদ
দোলে/ যেন ভাষার কোলে রাঙা রবি দোলে/ (নজরুল রচনাবলী, বা.এ. ৪-পৃ. ৩০২)
হুলিয়া মোবারক: রাসুল সা. এর হুলিয়া মোবারক শারীরিক সৌন্দর্য কি বেমেছাল বেনজীর অনুপম তার বর্ণনা আছে হাদিস শরীফে। প্রত্যক্ষ দর্শী সাহাবায়ে কেরামের প্রাণ জুড়ানো হৃদয় ছোঁয়া যে বর্ণনা তা আজও শাশ্বত উপমা। হাসানবিন সাবেত, শরফুদ্দিন বুসরি, ইমাম আহমদ রেযার ধারায় যে শত শত কবি সাহিত্যিক কবিতা সঙ্গীত রচনা করেছেন সে ধারায় নজরুলের অনুপম রেখা চিত্র তা শুধু দৃশ্য কাব্যের মতোই নয়; তারও উর্ধে; যেন বিনা তারে বীণারই অনুরণন-
(ক) আমিনার কোলে নাচে হেলে দুলে/ শিশু নবী আহমদ রূপের লহর তুলে\ (নজরুল রচনাবলী, ৭পৃ. ৯৭)
(খ) ওগো আমিনা তোমার দুলালে আনিয়া/ আমি ভয়ে ভয়ে রি।
এ নহে মানুষ, বুঝি ফেরেশতা. আসিয়াছে রূপ ধরি।
সে নিশীথে যখন বক্ষে ঘুমায়/চাঁদ এসে তাঁয় চুমু খেয়ে যায়,
দিনে যবে ষে চারণে সে যায়/ মেঘ চলে ছায়া করি।
সাথে সাথে তার মেঘ চলে ছায়া করি\….
সে চলে যায় যবে মরুর উপরে / বস্রা গোলাপ ফোটে থরে থরে
তাঁর চরণ ঘিরিয়া কাঁদে ফুলবনে/ অলিকুল গুঞ্জরি\
– (নজরুল নির্বাচিত বাণী সংকলন, পৃ. ৬৭৫. ঘগঠঘ ৯৯৩৯. শিল্পী: পরী বানু।)
(গ) আল্লাহ নারেম খনিতে ভাই উঠেছে এক মনি/ কোটি কোহিনূর ¤øান হয়ে যায় হেরি তার রোশনি।
সেই মনির রঙে উঠল রেঙে ঈদের চাঁদের দোল/তারে কেউ বলে মোস্তফা নবী, কেউ বলে রসুল। (নজরুল রচনাবলী. ১১-১৮৮)
(ঘ) হেরা হতে হেলে দুলে/নূরানী তনু ও কে আসে হায়।
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা/ খুলে খুলে যায়-
সে যে আমার কমলি ওয়ালা কমলি ওয়ালা\ (নজরুল রচনাবলী, ৭ পৃ. ১১)
নবীজীর দর্শন লাভের কায়মনো বাক্যিক আকুতি:
(ক) ঈমানী নজরে যাঁকে দেখলে জাহান্নামের আগুন হয়ে যায় ‘হারাম’ অতি সাধারনও হয়ে হয়ে অনন্য অসাধারণ, সেই পরশ পাথরের প্রেমানলে পুডতে থাকা নজরুলের আকাক্সক্ষার তীব্রতা পাঠক মহলকেও আলোকিত করে তোলে-
আমার হৃদয় শামাদানে জ্বালি মোমের বাতি/ নবীজি গো; জেগে আমি কাঁদি সারা রাতি।
তোমায় পেলে পাব খোদায়/ তাই শরন যাচি তোমারি পায়
পাওয়ার সাকো জেগে থাকি প্রেমের শয্যা পাতি\ (রচনাবলি ৭-পৃ. ১০৯)
(খ) সবাই খুশি ঈদের চাঁদে/ কেন আমার পরান কাঁদে
দেখব কখন ঈদের চাঁদ/ (ওগো) আমার মোস্তফাকে। (ঐ (১১ পৃ. ২৬৭)
রহমাতুল্লিল আলামিনের বিশেষত্ব: পবিত্র কোরানের সুরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে, হাদিসের বিভিন্ন স্থানে রাহমাতুল্লিল আলামিনের যে চিরায়ত শাশ্বত বিশেষত্ব ফুটে উঠেছে তা একান্ত জীবন ঘনিষ্টতায় ফুঠে উঠেছে নজরুলের তুলনায়হিত প্রত্যয় দীপ্ত স্বগতোক্তিতে-
(ক) ভালোবাসা পায়না যে জন/ রসুল তারে ভালোবাসে
উম্মতের ছেড়ে কভু/ বেহেশতে যায়না সে\
যে জন বেড়ায় পিয়াস লয়ে/ দ্বারে দ্বারে নিরাশ হয়ে
সবুরেবি মেওয়া নিয়ে/ নবীজি তার সামনে আসে\ – (ন. রচনাবলী. ১১-৬০)
(খ) ওরে কে বলে আরবে নদী নাই। যথা রহমতের ঢল বহে অবিরল
দেখি প্রেম দরিয়া পানি যে দিকে চাই\
যার শক্তির বন্যার তরঙ্গ বেগে/ যত বিষন্ন প্রাণ ওরে আনন্দে উঠলো জেগে
যার প্রেম -নদীতে যার পূণ্য তরীতে/ মোরা তরে যাই\ (ন.র. ১০-২৩৪)
মেরাজ: নবীজীর মানবীয় সত্তার অবিস্মরনীয় অধ্যায় পবিত্র মেরাজ। কোরান হাদিসে প্রমাণিত এই সুগভীর আধ্যাত্মিক রহস্যপূর্ণ চিরায়ত শাশ্বত অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনার যেমন শেষ নাই, তেমনি শেষ নাই কাব্যে রচনারও। এই ক্রম সম্প্রসারণ ধারায় নজরুল তাঁর স্বীয় প্রতিভা দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন ব্যাপক আকর্ষনীয় মাত্রিকতায়-
(ক) আসিছেন হাবিবে খোদা, আরশ পাকে তাই উঠেছে শোর;
চাঁদ পিয়াসে ছুটে আসে আকাশ-পানে মেযন চকোর,
কোকিল যেমন গেয়ে ওঠে ফাগুন আসার আভাস পেয়ে,
তেমনি করে হরষিত ফেরেশতা সব উঠলো গেয়ে;
ফের আজ আরশে আসেন মোদের নবী কমলিওয়ালা;
দেখ সেই খুশিতে চাঁদ সুরুয আজ হল দ্বিগুন আলা\
(ন.র. ১০-পৃ. ২২৭)
(খ) মেরাজের বর্ণনায় বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিফলনে উপমা-রূপক উৎপ্রেক্ষার সুসমন্ব^য়ে বরাতি পরিবেষ্টিত ‘দোল্হা-দর্শনে’ উম্মুখ আরশের অপূর্ব মনোরম অভিনব চিত্র বাংলা সাহিত্যের অপরাপর কাব্য রচয়িতাদেরও সম্মোহিত করে তোলে-
দেখে যারে দুলা সাজে/ সেজেছেন মোদের নবী/ বর্ণিতে সে রূপ মধুর/ হার মানে নিখিল কবি\
আউলিয়া আর আম্বিয়া সব/ পিছে চলে বরাতি/আসমানে যায় মশাল জ্বেলে/ গ্রহ তারা চাঁদ রবি\
হুর পরি সব গায়ে নাচে আজ/ দেয় ‘মোবারকবাদ’ আলম,/ আরশ কুর্শি ঝুঁকেপড়ে/ দেখতে সে মোহন ছবি \
আজ ্রশের বাসর ঘরে হবে মোবারক রুয়ৎ/ বুকে খোদার ইশ্ক নিয়ে/ নওশা ঐ আল-আরবি\
মেরাজের পথে হযরত যান চড়ে ঐ বোরাকে
আয় কলমা শাহাদাতের যৌতুক দিয়ে তাঁর চরণ ছোঁবি\
(ঐ, ৪র্থ, পৃ. ২৯৬)
চলবে-
লেখক: নজরুল গবেষক ও
রিসার্চ ফেলোফিনিস একাডেমি
হেলসিংকী, ফিনল্যান্ড।