বাংলা লোকগানের ঋদ্ধ ঐতিহ্য

35

অমল বড়ুয়া

মানবজাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিবাহ নামক পুত-পবিত্র ও শুদ্ধতম সামাজিক রীতি। আর এই বিয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে আছে বিভিন্ন প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, লোকাচার ও বিয়ের গানের মতো মননশীল বিষয়ও। আর এই বিয়ের গানগুলো হলো বাংলা লোকগান তথা লোকসংষ্কৃতি। যা বাংলা লোকসাহিত্যের অংশ। বাঙালি সংস্কৃতিতে লোকগানের যে কয়েকটি ধারা লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার মধ্যে বিয়ের গান অন্যতম। আর লোকসাহিত্যের এক-অমূল্য ভান্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে এ গান। যা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আর আবহমান বাংলার গ্রাম-জনপদের অধিবাসীদের কন্ঠ থেকে উত্থিত এই সঙ্গীতের রয়েছে সাহিত্য মূল্য, কাব্যগুণ ও শ্রুতিরসের পরিপূর্ণ সুষমা।
অঞ্চল ও সম্প্রদায়ভেদে লোকসংস্কৃতির তারতম্য দেখা গেলেও বিয়ের গানের লোকসংস্কৃতির প্রভাব একই দেশে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে কম-বেশি পরিদৃষ্ট হয়। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বাহক ও সংস্কৃতির চারণভূমি চট্টগ্রামেরও রয়েছে নিজস্ব লোক-ঐতিহ্য বিয়ের লোকগান- ‘হঁঅলা’। চট্টগ্রামে লোকগানের কয়েকটি ধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এইগুলো হচ্ছে- ক) প্রেম-সঙ্গীত; খ) হঁঅলা বা বিয়ের মেয়েলি গান; গ) মারফতি গান; ঘ) কবিগান; ঙ) জারিগান বা মহরম সঙ্গীত; চ) উজ্জীবনী সঙ্গীত; ছ) গাইনের পালা বা গাজীর গান; জ) পুস্তিকা কবিতা। চট্টগ্রামের এ সকল গানকে অনেকে আঞ্চলিক গানও বলে থাকেন। এই গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রামীণ লোকগান হল ‘হঁঅলা’ বা বিয়ের গান। ‘হঁঅলা’ তথা বিয়ের এই গানগুলো মূলত চারভাগে বিভক্ত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ক. হঁঅলা বা বিয়ের গান। ‘হঁঅলা’ এক-প্রকার চাটগাঁইয়া মোর্চা-সংগীত; এই সংগীতের সুর এমনভাবে করা হয়েছে, যেন ঘন্টার পর ঘন্টা বানিয়ে বানিয়ে গাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন ‘হঁঅলা’র উৎপত্তি চাঁটগাইয়া পুথিসাহিত্য থেকে। আবার অনেক পÐিতের মতে, চর্যাপদেও রয়েছে লোকগানের ছোঁয়া। চর্যাপদ শুধু প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, প্রাচীন বাংলা গানেরও নিদর্শন। প্রতিটি পদের শুরুতে রাগ-তাল ও প্রতি জোড়-পদে ‘ধ্রæব’ শব্দের উল্লেখ থাকায় নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, এগুলি তখন গান হিসেবে গাওয়া হতো। চর্যার ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের হঁঅলার উৎপত্তি অসম্ভব কিছু নয়। খ. ‘চেয়ার’। এই শব্দের উৎপত্তি শেয়ার থেকে। বিশেষ করে উর্দু গজল বা শায়ের আর হিন্দি গান এই শ্রেণিতে পড়ে। গ. পুরোনো বাংলা আর আঞ্চলিক গান এবং ঘ. বিয়ে কেন্দ্রিক কিছু গান।
হঁঅলা বা বিয়ের গান এক প্রকার লোকগীতি। বিয়েতে গ্রামের মেয়েরা একক বা দলবদ্ধভাবে এ গান পরিবেশন করে। তারাই এ গানের রচয়িতা, সুরকার এবং কন্ঠশিল্পী হিসেবে তাৎক্ষনিক মুখে মুখে গান পরিবেশন করেন। হঁঅলা সংগীতে সাধারণত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। বেশির ভাগ হঁঅলা সংগীতের সুর করুণ ও আবেগধর্মী। গায়ে হলুদ, মেহেদি তোলা, সোহাগ মাগা, জলভরন, বর-কনে স্নান, কনে সাজানো, বর-বরণ, বর-কনে বিদায়, বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রায় প্রতিটি পর্বে হঁঅলা সংগীত পরিবেশিত হয়। হঁঅলা সংগীতে একদিকে যেমন নারী-মনের কামনা-বাসনা প্রকাশ পায়, তেমনি লঘু হাস্যরস, কৌতুক ও ঠাট্টা-মশকরা স্থান পায়। এক কথায় হঁঅলা সংগীত গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত নারীর মনের অকৃত্রিম প্রকাশ। এই সংগীত গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই হঁঅলা লিখিত বা সংকলিত গান নয়; বরং এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে ম‚লত শ্রæতিধরের মৌখিক ব্যবহারেই এর প্রাণ। অর্থাৎ মুখে মুখে এ গান চলে আসছে। হঁঅলা হলো এরকম –
‘ফঁইরেঘোনা বিলের মাঝে তোতার ঝাঁক বইস্যে,
সোনামিয়া দুলা তোতা মাইত্তু গেইয়্যে রে মোর হায় হায় রে……..
বউ আনতে যাওয়ার মুহুর্তে, যাওয়ার পথে আর বউ নিয়ে আসার সময় ও পরে হঁঅলা গান গাওয়া হয়। চট্টগ্রামের হঁঅলা গানের তাল, ছন্দ, লয় ও সুরের জাদু না থাকলেও এতে একধরেনর আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়।
‘দুলর মা দোয়া গরো, দুনো হাত তুলি,
আঁজিয়া ফঁইরেঘোনার আরফাত মিয়ার বিয়া’,
বউ আনার সময় দেবর-ননদরা গান ধরে-
‘ভাবী চোখে কাজল,
ওঠে পালিশ দিঁইয়ে লাল গঁরি,
ধীরে ধীরে চলো রে স্বামীর বাড়ি..’
এই ‘হঁঅলা’ চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিয়েতে গাওয়া হয়। বৌদ্ধসমাজে এক কালে প্রচুর বিয়ের গান প্রচলিত ছিল। গ্রামে সাধারণ বৌদ্ধদের মধ্যে এই ঐতিহ্য এখনো দেখা যায়। তবে ইদানিং এই সব ছড়া ও গানের অব্যবহারে হারিয়ে গেছে অধিকাংশ রচনা; নেই কোন সঙ্কলনগ্রন্থও, গবেষণায় আগ্রহীর সংখ্যাও নগণ্য। যাহোক, বাপের বাড়ি থেকে বিদায়লগ্নে বৌদ্ধ কন্যা মনের দুঃখে চোখের জল মুছতে মুছতে বলছে-
‘ঢোল বাজে আর মাইক বাজে
আঁর পরাণে ক্যান গঁররের
ক্যান গঁরি আঁই যাইঁয়ুম পরের ঘর।’
বাঙালি হিন্দু সমাজেও একইভাবে প্রচলিত আছে এই ‘হঁঅলা’ বা বিয়ের গানগুলি। অশীতিপর বৃদ্ধা তাঁর ¯েœহের নাতনির বিবাহ-বাসরে শুনিয়ে দেন এমন দুই-একটি গান-
‘আঁইলাম সই তোদের বাড়িত মালা দিতে
মালা দিতে লো সজনী বর দ্যাখতে
আঁই রসেরও মালিনী
রসের খেলা কতই জানি।’
বিবাহকর্মকে ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত পুণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়। চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজেও প্রচলিত আছে সহস্রাধিক বিয়ের গান। বাঙালি-মুসলমান সমাজে বাসর-জাগা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে গানের রেওয়াজ আছে। বর-কনেকে মাঝে রেখে মেয়েরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে এই গান গায়,-
‘তার-ই-তসন (অপূর্ব সুন্দরী) মেয়ে আঁর,
জামাই ক্যান মোর কালা গো?
হোক না মা তোর কালা জামাই,
আঁধার ঘরে ভালা গো।
তার-ই-তসন মেয়ে আঁর,
জামাই ক্যান মোর দাঁততো গো?
হোক না মা তোর দাঁততো জামাই,
কচু ছিলবার ভালা গো।’
হঁঅলা গানের মধ্যে যেমন গ্রামীণ মহিলাদের দুঃখ-বেদনা আর বিরহের অর্ন্তজালা আছে তেমনি আছে আনন্দরসের ফÐুধারা; আছে নিটোল রসিকতার অপূর্ব আবেশও …….
আঁর পরাণে ছইট ক্যাঁ গরের ও মাইজ্জ্যা বু বইন রে
আঁই এক্কানা বাড়ি পাক্কাই আঁইসয়ুম রে
বাড়ি পাাক্কাই আঁইবার সমত গুরা দুলা দ্যাখে
গুরা দুলা ঝাপটা মারি ধঁইরজ্জে রে
ঝাপটা মারি ন ধইরজ্জু রে গুরা দুলা ভাই রে
আঁর গায়ে আছে আসট্ট মাইস্যা দাদু রে।
চট্টগ্রামের বিয়ের গানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আনোয়ারার মনুমিয়া ও বাঁশখালির মালকা বানুর বিয়েতে গাওয়া গানটি। জনশ্রæতি আছে মালকা বানু ও মনুমিয়ার বিয়ে হয়েছিলো খুব ঝাঁকজমকপূর্ণভাবে। একমাস ধরে চলেছিলো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। আর সেই বিয়েতে বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পীরা এসে গান পরিবেশন করেছেন। তারমধ্যে-
‘মালকা বানুর দেশেরে,
বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজেরে।
মালকা বানুর সাতও ভাই,
অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই।
মালকার বিয়া হইবো, মনু মিয়ার সাথেরে।’
এই গানটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে, গ্রামে-গঞ্জে গানটি এখন কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাংলার খ্রিস্টানদের বিবাহ-বাসরে কিছু দিন আগে পর্যন্ত প্রচলিত ছিল ‘নবদো’। বিলেত-ফেরত জনৈক পাদরি ল্যাটিন ভাষায় এই শপথ-কবিতাটি রচনা করেছিলেন বাঙালি খ্রিস্টানদের জন্য। এর অর্থ না বুঝে গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলে যেত বাংলাভাষী বর-বেচারা। এতটুকু ত্রæটি ঘটলেই হাসির রোল পড়তো; আবার প্রথম থেকে আবৃত্তি করতে হত। তবে এখন ‘নবদো’ নেই। তা সময়ের বিবর্তনে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
চট্টগ্রামে ‘হঁঅলা’র জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। ‘হঁঅলা’র জনপ্রিয়তায় আপ্লুত হয়ে ১৯৭০ সালে গফুর হালী রচনা করেন একটি জনপ্রিয় হঁঅলা, যা ইতোমধ্যে গ্রামীণ জনজীবনের একটা অমলিন অংশে পরিণত হয়েছে-
আইওরে আইওরে কুডুম
দুলা হাঁজাইতাম।
কাঁচি হলইদে আনরে বাডি
আনরে মিডা পান
কুডুম আইওরে।