মহিউদ্দিন ইমন
বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিত। পুরোনো বছরের সমস্ত গøানি ধুয়ে মুছে, জীর্ণ ক্লান্ত অবসাদের অবসান ঘটিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বাংলা নববর্ষ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী, কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ। সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হয় বৃহৎ। সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ বাঙালির কাছে নববর্ষ এক মহান উৎসব। প্রত্যেকেই বাংলা বছরের প্রথম দিনটি সুন্দরভাবে অতিবাহিত করে। নতুন বছরের আগামী দিনগুলােকে সুন্দরতর ও আনন্দময় করে তােলার স্বপ্ন নিয়েই পালন করা হয় বাংলা নববর্ষ উৎসব। বাংলা নববর্ষ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় ও সার্বজনীন উৎসব। বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল ধর্মের মানুষের এ এক মিলন উৎসব। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের বাঙালিরা এই দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গøানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সুখময় ও সমৃদ্ধ হয়।
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস এখনো সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পÐিত মনে করেন মুঘল সমাট আকবর চান্দ্র হিজরি সনের সঙ্গে ভারতবর্ষের সৌর সনের সমন্বয় করে ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়। নবাব এবং জমিদারেরা খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে চালু করেন ‘পুণ্যাহ’। জমিদারি না থাকায় এখন তা লুপ্ত। পহেলা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল হালখাতা। এদিনে গ্রাহকেরা দোকানিদের বাকির টাকা মিটিয়ে দিতেন। তবে বর্তমানে বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলাে বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈশাখী মেলা উদযাপিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পুরাে এলাকাজুড়ে বহুবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে যে মেলা হয় তাতে বিশেষভাবে স্থান পায় কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, গম্ভীরা গান, পুতুল নাচ, নাগরদোলাসহ নানা আনন্দ আয়ােজন। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীরাও তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে বর্ষবরণ করে। তাদের এই উৎসবকে বলে ‘বৈসাবি’। বাংলা নববর্ষে পান্তা ও ইলিশ মাছ খাওয়া শহরবাসী বাঙালিদের ফ্যাশনের বিষয় হয়ে উঠেছে। বস্তুত বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব। এদিনে বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। শুধু বছরের প্রথম দিন নয়, সারা বছর ধরে যদি বাঙালি এই আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট হয় তবে বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিতে পরিণত হবে। আর বাংলা নববর্ষ হবে সেই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রধান উৎসব।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক