বাংলা নববর্ষ – বাঙালি কৃষ্টি সংস্কৃতি ঐতিহ্যের স্মারক

1

বাবুল কান্তি দাশ

শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি মানব সভ্যতার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের অন্যতম অনুষঙ্গ। বাঙালির মননে যে সভ্যতা তা পেশিশক্তির প্রভাবে নয় জ্ঞানশক্তির প্রভাবে বিকশিত হয়েছিল, যার সঠিক কাল নির্ধারণ করা এখন সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি, সমবেত মানুষের উন্মুক্ত জ্ঞানের উপলব্ধি থেকে এই সভ্যতার বিকাশ, তাই এই সভ্যতা অপৌরুষ সভ্যতা। যদিও এই সভ্যতার পুরাতাত্তি¡ক নিদর্শন আমাদের চোখের সামনে তেমন নাই, তবুও যেটা রয়ে গেছে এটাই অসীম আকাশের ন্যায়। কিন্তু অনুতাপের বিষয় এইযে তার সামান্যতম অংশও আমরা বর্তমানে নিজের করে রাখতে পারিনি। তাই আমাদের সমাজ অতীতের ন্যায় উজ্জ্বল নয়। আমরা আমাদের সত্তার পরিপালন পরিপোষণে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি। সত্তার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে যা যা করণীয় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে সত্তার বিপর্যয় ও বিধ্বংসীতে মেতে উঠেছি। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি কৃষ্টি ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বর্দ্ধনায় যে সকল উপাদান তার অন্যতম হচ্ছে বাঙালির উৎসবাদি। যা জীবনকে নতুনভাবে তৈরি করতে শেখায়। নতুন কিছু করতে নতুন কিছু গড়তে নতুন কিছু ভাবতে শেখায়। আর তা’তে সভ্যতার ক্রমবিকাশ নিরবচ্ছিন্ন চলতে থাকে। সেইরকম একটি বাঙালি উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন প্রিয় স্বদেশ। ফুলে-ফলে, শস্য-শ্যামলে, সৌন্দর্যে-সমারোহে, লীলা বৈচিত্র্যে, রূপ লাবণ্যে ভরা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি। বছরের বিভিন্ন সময় অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনে হয় বিধাতা যেন সব সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছেন। এ দেশে ছয়টি ঋতু নিরন্তর চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে চলছে। লীলাময়ী প্রকৃতি এখানে মুক্ত হস্তে সৌন্দর্য বিতরণ করছে। তাই এ দেশকে প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতন বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। প্রকৃতির এই উজাড় করে দেওয়া সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বাঙালি মেতে উঠে বিভিন্ন উৎসবে। বলা হয়ে থাকে বাঙালির বার মাসে তের পার্বন। বাঙালির এই উৎসব সমূহের মধ্যে অন্যতম বাংলা নববর্ষ বরণ। বসন্তে যেমন প্রকৃতি সেজে ওঠে অপরূপ সৌন্দর্যে তেমনি বাংলা নববর্ষে সারাদেশ হয়ে উঠে রঙিন। পুরুষ ও প্রকৃতি নব বস্ত্রে নব সাজে সজ্জিত হয়ে উঠে বাংলা নববর্ষে
‘নিশি অবসান প্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত ! আমি আজি ধুলিতলে এ জীর্ণ জীবন করিলাম নত। বন্ধু হও, শত্রæ হও, যেখানে যে কেহ রও, ক্ষমা করো আজিকার মতো, পুরাতন বরষের সাথে, পুরাতন অপরাধ যত।’
এ সংসার নিত্য নবীনতার আকর। এখানে যা পুরাতন, তা টিকতে পারে না, একেবারেই লোপ পায়। মানুষের দেহ নিত্য নতুন হচ্ছে। গাছ-লতা-গুল্ম নিত্য নবীনতা ধারণ করছে। সৃষ্টি শক্তি অনবরত নতুন নিয়েই খেলা করে। আর এই নতুনের মধ্যে স্রষ্টা নব নব লীলার প্রকাশ করছেন। যদি সবই নতুন, তবে এর মধ্যে পুরাতন কি? পুরাতনের বোধটা যে আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে রয়েছে। এই নতুন সৃষ্টির নবীন লীলার মধ্যে আমিই পুরাতন। এই আমার আমিত্ব বোধটাই সনাতন। আমি আছি, আমি ছিলাম, আমি থাকব-এই জ্ঞান থেকেই কালের পরিমাণ, এই জ্ঞান থেকেই পুরাতনের বোধ। প্রতি পলে প্রতি ক্ষণে আমার থেকে নঈনতার প্রস্রবণ যেন ছুটে বের হতে থাকে। তখন পুরাতনের বোধও থাকে না, পুরাতনের ভাবনাও থাকে না। কিন্তু যখন আমি আছি, এই জ্ঞানটা ফুটে উঠে, আমার আমিত্বের সনাতন তত্ত¡টা যখন বুঝতে পারি, তখন পুরাতন ছাড়া, কেবল অতীত কালের বোধ ছাড়া অন্য অনুভূতি মনে লাগে না। এমন অনুভব হলে সৃষ্টি রক্ষা সম্ভপর হয় না। তখন মনে হয় আমি নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ, নিরালম্ব সত্য-স্বরূপ। তখন মনে হয় জগতের এ লীলা মায়া, এটা যাদুকরের ইন্দ্রজাল মাত্র। তাই সমাজ রক্ষার জন্য মানুষকে কর্মি করার উদ্দেশ্যে পুরাতনে ও নতুনে পর্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ মাত্র অহরহ স্মৃতির মালা ঘুরাচ্ছে। কাল কি ছিল, আজ কি হল, আগামীকাল কি হবে, এই চিন্তার মালা মানুষের মনে অহরহ ঘুরছে। একবার সে মালা ঘুরানো শেষ হলে একটা বর্ষ শেষ হল মনে করতে হয়। আমাদের পুরাতন বর্ষ শেষ হয় চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ তারিখে। এই দিনই অজ্ঞাত ভবিষ্যতের বুকে একটা আশার যব রাখতে হয়। যেন কাল থেকে সব নতুন হবে, নতুন বর্ষ, নবীন আশা, নবীন উদ্যোগ, সবই যেন নতুন হবে। তাই আজ পুরাতনের শেষ, কাল নবীনতার সূচনা।জীবনটাকে স্বাদু করার উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা হয়ে থাকে। এক একটা উৎসব, এক একটা পূজা, এক একটা জন্মতিথি যেন নতুনের সূচক ও প্রবর্তক হয়ে আমাদের একটু সজ্ঞান করে তোলে। তাই এই সকল দিনকে ‘বৎসরকার দিন’ বলা হয়। অর্থাৎ, এই সকল আমাদের জীবন প্রবাহের যেন এক একটা ছেদ, এক একটা পুরাতন অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি এবং নতুনের সূচনা। যাদের জন্ম বঙ্গে, মাতৃভাষা বাংলা, মূলত তারাই বাঙালি। এই বাঙালির বড় উৎসব বাংলা নববর্ষ। বিগত বছরের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, উৎসবের স্মৃতিচারণ পরিহার করে নতুন বর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। বৈশাখে উৎসবে মানুষের ঢল নামে। মেলা বসে গ্রামে গ্রামে। নানা ধরনের হাতের তৈরি দ্রব্য ও খাবারের মেলা যেন গ্রামবাংলার মানুষের প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবন যেন খন্ড খন্ড হয়ে ধরা পড়ে তাদের হাতের কারুকাজে। মাটির পুতুল, পাটের শিখা, তালপাতার পাখা, সোলার পাখি, বাঁশের বাঁশি, ঝিনুকের ঝাড়, পুঁতিমালা, কত না অদ্ভুত সব জিনিসের সমাবেশ ঘটে সেই মেলায়। চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই হয় না বাংলার মানুষের জীবন এত সমৃদ্ধশালী। বাংলার মানুষ গরিব হতে পারে, দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে তারা জর্জরিত হতে পারে; কিন্তু এসব দুঃখকষ্ট তাদের জীবনকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কবিগুরুর এমনই আকুতি আমাদের বাঙালি সত্তাকে প্রতি বছরে জাগিয়ে তোলে-”মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা”। বঙ্গের অব্দ, এই অর্থে বঙ্গাব্দ। বাংলাদেশসহ পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। এটি একটি সৌরবর্ষ পঞ্জিকা। খ্রিষ্টাব্দের (গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা) দিনের শুরু হয় রাত ১২টা থেকে। কিন্তু বঙ্গাব্দের দিন গণনা হয় সূর্যোদয় থেকে। এই অব্দ গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা-র মতোই ১২ মাসে বিভক্ত। এই মাসগুলো হলো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। এই অব্দের শুরু হয় ১লা বৈশাখ থেকে। খ্রিষ্টাব্দের বিচারে বঙ্গাব্দের নববর্ষ শুরু হয় ১৪ এপ্রিল এবং ভারতে ১৪ বা ১৫ এপ্রিল থেকে। যে কোনো খ্রিষ্টাব্দের (গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা) ১৪ বা ১৫ এপ্রিলে যে অব্দমান পাওয়া যায়, সেখান থেকে ৫৯৩ বৎসর বিয়োগ করলে বঙ্গাব্দ পাওয়া যায়। যেমন– কোনো বৎসরের ১৪ বা ১৫ এপ্রিল তারিখে যদি বৎসরের সংখ্যা ২০২৫ হয়, তবে ওই দিন থেকে বঙ্গাব্দের প্রথম দিন হিসাবে গণনা শুরু হবে এবং তখন বঙ্গাব্দ হবে ২০২৫ – ৫৯৩= ১৪৩২। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তিতে অর্থাৎ ১লা বৈশাখের আগের দিনে ওই বঙ্গাব্দ হবে ১৪৩১। বঙ্গাব্দ নামটি শুনলেই মনে হয়, বঙ্গদেশের নিজস্ব অব্দ। কিন্তু এই নামটি কিভাবে প্রচারিত হলো, তার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায় না। সম্ভবত এই নাম জনসাধরণের দেওয়া। ফসলি সন খাজনা আদায়ের মাস ছিল বটে, কিন্তু অগ্রহায়ণ মাসকে বৎসরের শুরু এটা বঙ্গবাসী গ্রহণ করেন নাই। ফলে ঋতুগুলোকে শনাক্ত করা, হিন্দু ধর্মীয় পালাপার্বন, লৌকিক আচারাদি প্রচলিত বাংলা মাস ধরেই হতো। এছাড়া হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তির আচারাদি এবং তৎসম্পর্কিত বাৎসরিক মেলা ইত্যাদির বিচারে বৈশাখ নববর্ষের প্রথম মাস হিসাবেই মান্য করা হতো। সাধারণ মানুষ ফসলি সন, হিজরি সন, লক্ষণাব্দ ইত্যাদি থেকে পৃথকভাবে নতুন অব্দকে অনুসরণ করা শুরু করেছিল। এবং এই সব অব্দ থেকে স্বতন্ত্র অব্দ হিসাবে এ্ই লৌকিক অব্দকে বঙ্গাব্দ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এভাবে শুরু হয় বঙ্গাব্দ। সেই বঙ্গাব্দের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠে চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষ অর্থাৎ বঙ্গাব্দের শেষ দিন এবং পহেলা বৈশাখ। এই দিনটি ছিল সামাজিক আদানপ্রদানের দিন। স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে সেই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে। ক্রমে তা গোটা সমাজ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে যা ছিল শুধু কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের বিষয়, এক সময় তা হয়ে উঠল নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা, তার সঙ্গে নব জীবনের আহবান। যা কিছু অসুন্দর, জীর্ণ, পুরাতন, তা শেষ হয়ে যাক। পয়লা বৈশাখ সেই শুভ সূচনার দিন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রথম থেকেই নববর্ষের উৎসব কোনও ধর্মের বাঁধনে বাঁধা পড়েনি। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ এই উৎসবে বাংলার মানুষ— সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান— মহানন্দে যোগ দিতেন। একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা বিনিময়, খাওয়াদাওয়া, আনন্দ উৎসব মিলে সারা বছরের অন্য দিনগুলির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে উঠত এই দিনটি। চৈত্র সংক্রান্তিতে বসত চড়ক মেলা। হিসেব করা হতো পাপ পূণ্যের। যার আবেদন শিহরণ জাগিয়ে তুলত প্রতিটি প্রাণে। চড়ক পূজার আগের দিন চড়ক গাছকে ভাল করে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। তারপর জলভরা একটি পাত্রে শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। এই পুজো করেন পতিত ব্রাহ্মণরা।চড়কগাছে সন্ন্যাসীদের চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রæতবেগে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, শরীরের অন্যান্য অঙ্গে জ্বলন্ত বাণ শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়ার রীতিও রয়েছে। এছাড়াও, কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, গায়ে ধারালো জিনিস ফোটানো, ধারালো কিছুর ওপর লাফানো, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, ইত্যাদি এই পুজোর বিশেষ অঙ্গ হিসেবে মনে করা হয়।চড়ক মেলার মাঠে এ দৃশ্য ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।আমরা, তথাকথিত পাপ ও পুণ্যের হিসেব নিকেশ, পার্থিব আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যাদের দিন কাটে—তাকিয়ে থাকি ভবিষ্যতের দিকে। আগামীকালের নতুন সূর্য কি নতুন বার্তা নিয়ে আসবে আমাদের জন্য? এই আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়াপাওয়ার দোলাচলে দুলতে দুলতেই কি আমরা আমাদের ঘটে যাওয়া অতীত কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করি? নিজেদের যন্ত্রণা দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি যে এই পৃথিবীটা সত্যিই তো কুসুমাস্তীর্ণ নয়।এখানে সুখ যেমন আছে, আছে দুঃখও। আর সুখের সঙ্গে দুঃখকে যে যত নির্লিপ্ত ভাবে গ্রহণ করতে পারবে সেই তো এই জীবন সংগ্রামে জয়ী হবে। এই দার্শনিক ভাবনার থেকেই কি চড়ক পুজোর উৎপত্তি? চৈত্র সংক্রান্তির পর দিন পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হত নতুন খাতা বা হালখাতা। ব্যবসায়ী ও অন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হত মিষ্টি। পয়লা বৈশাখ উৎসব অনুষ্ঠানে পালিত হত। সেই ধারা এখনো চলছে। পয়লা বৈশাখ মানে এখনও ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতা খোলার উৎসব।খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করানো। পাড়ায় পাড়ায় দল বেঁধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, নতুন জামাজুতোয় নিজেকে সাজানো। বর্ষশেষের উৎসব পালনেই বাঙালি অভ্যস্ত ছিল দীর্ঘ কাল। গ্রন্থকার দীনেন্দ্রকুমার রায় সঙ্গত কারণেই বলেছেন যে, বসন্ত আর গ্রীষ্মের সন্ধিস্থলে চৈত্র মাসে পল্লিজীবনে ‘নব আনন্দের হিল্লোল বহে’। গম, ছোলা, যব, অহর প্রভৃতি রবিশস্য পেকে উঠেছে, সুতরাং দীর্ঘ কালের ‘অনাহারে শীর্ণদেহ, ক্ষুধাতুর কৃষক পরিবারে যে হর্ষের উচ্ছ¡াস দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা সুদীর্ঘ হিমযামিনীর অবসানে বসন্তের মলয়ানিলের মতই সুখাবহ। ’চট্টগ্রামের সারোয়াতলিতেও চৈত্র সংক্রান্তির দিন ‘লাওন’ (এক ধরনের নাড়ু) খাওয়ার উৎসবের মধ্য দিয়েই হত বর্ষবিদায় এবং হিন্দু-মুসলমানের নববর্ষ বরণের আন্তরিক শুভ কামনার বিনিময়। এখানে যে বর্ষবরণের আভাস আছে, তার বয়স খুব বেশি নয়। চৈত্র সংক্রান্তিই ছিল প্রধান। হুতোমের খুব আক্ষেপ ছিল এ নিয়ে।লিখেছেন ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন৷ পানসুপুরি দিয়ে তারা বরণ করেন আগামীকে। ভাল বা খারাপ যে ভাবেই বছর শেষ হোক না কেন, ‘সজ্নে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়েই পুরনোকে বাঙালি বিদায় দেন’। কেবল মাতাল আর ‘নতুন খাতাওয়ালারাই’ নতুন বছরের মান রাখেন। ‘ইংরাজী নববর্ষ’ কবিতায় ঈশ্বর গুপ্তও তো লিখেছিলেন ‘নববর্ষ মহাহর্ষ ইংরাজটোলায়।’ আসলে পয়লা বৈশাখ তো ছিল ওই খাতাওয়ালা, মানে ব্যবসায়ীদের পরব— হালখাতা অনুষ্ঠান। এ ছাড়া তো কোনও গুরুত্বই ছিল না। আজকের মতো সে দিনও দোকানদাররা ফুল, আমপাতা দিয়ে দোকান সাজাতেন। যে দোকান-মালিক অন্য দিন তার দোকানে সামান্য একটি মাটির ‘ডেল্কো’ (প্রদীপবিশেষ) জ্বালতেও কষ্টবোধ করে, সে-ও নাকি এ দিন ‘লণ্ঠনের মধ্যে গ্লাসে ভরে তেলের বাতি জ্বালতে কার্পণ্য করে না’। সন্ধে হতে না হতেই শুরু হয় হালখাতার ব্যস্ততা। খাবার মেনুও ছিল জিভে জল আনা— বড় দোকানিরা বেলের শরবত, ভিজে মুগের ডাল, পেঁপে, ডাব থেকে লুচি, কচুরি, ছানা, ক্ষীর কিছুই বাদ দিতেন না। তবে পয়লা বৈশাখের মান ব্যবসায়ীরাই রেখেছিলেন দীর্ঘ কাল। আজও দেখি দোকানগুলোয় হালখাতার ভিড়, খদ্দেরের প্রবেশ ও হাসিমুখে মিষ্টির বাক্স নিয়ে প্রস্থান। বাঙালি কি নতুনে ভীত ছিলেন ? হুতোম একটা ইঙ্গিত করেছিলেন কিন্তু। বলছেন বছরের শেষ দিনে ‘যুবত্ব কালের এক বৎসর গ্যাল দেখে যুবক যুবতীরা বিষণ্ণ হলেন’। আরও বলছেন, বর্তমান বছর ‘স্কুল মাষ্টারের মত গম্ভীরভাবে এসে পড়্লেন আমরা ভয়ে হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত!’ পরবর্তী সংযোজন, ‘জেলার পুরাণ হাকিম বদলী হলে নীল প্রজাদের মন যেমন ধুক্পুক্ করে— স্কুলে নতুন ক্ল্যাসে উঠ্লে নতুন মাষ্টারের মুখ দেখে ছেলেদের বুক যেমন র্গুর্গু করে মঞ্চে পোয়াতীর বুড়ো বয়সে ছেলে হলে মনে যেমন মহান সংশয় উপস্থিত হয় পুরাণর যাওয়াতে নতুনের আসাতে আজ সংসার তেমনি অবস্থায় পড়্লেন।’ নিধুবাবুর গানের সেই কলি ‘নূতনেতে হয় অনুরাগ/পুরাতনে হেলা ফেলা’য় মজলেও এ ক্ষেত্রে বাঙালি পুরনোটাই সেলিব্রেট করে এসেছে দীর্ঘ কাল। পয়লা বৈশাখকে যিনি বাঙালির প্রাণের সঙ্গে জুড়ে দিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। যা ছিল বাণিজ্যিক, তা চিরকালের জন্যে ধরা পড়ল আমাদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটকে বার বার এসেছে নতুন বছরের স্বাগতবাণী। এ তাঁর কাছে নবজন্ম। পুরনো জীর্ণ জীবনের অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশের আনন্দ অনুভূতি। ১৯৩৯ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) শ্যামলী-প্রাঙ্গণে সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘নববর্ষ-ধরতে গেলে রোজই তো লোকের নববর্ষ। কেননা, এই হচ্ছে মানুষের পর্বের একটা সীমারেখা। রোজই তো লোকের পর্ব নতুন করে শুরু। ’নববর্ষে মহর্ষিভবনের উপাসনা উপলক্ষে তিনটে গান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘নববর্ষের গান’ শিরোনামে ‘আমারেও কর মার্জনা’, ‘বর্ষ গেল, বৃথা গেল, কিছুই করিনি হায়’ আর ‘ফিরোনা ফিরোনা আজি এসেছ দুয়ারে’। ‘তত্ত¡বোধিনী’-র বৈশাখ সংখ্যাতেই মুদ্রিত হয় গান তিনটে। শুধু কি গান? ১৩০৯-এর বৈশাখে লিখলেন ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধ। বলছেন, “প্রান্তরের মধ্যে পুণ্য নিকেতনে নববর্ষের প্রথম নির্মল আলোকের দ্বারা আমাদের অভিষেক হইল। আমাদের নবজীবনের অভিষেক।” মানবজীবনের যে মহোচ্চ সিংহাসনে বিশ্ববিধাতা আমাদের বসার জায়গা দিয়েছেন, তা আজ ‘আমরা নবগৌরবে অনুভব করিলাম। ’রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠির যে সঙ্কলনটি করেছিলেন গৌরচন্দ্র সাহা, (‘রবীন্দ্রপত্রপ্রবাহ ও তথ্যপঞ্জী’) তাতে দেখা যায় নববর্ষে নিয়ম করে কবি প্রিয়জনদের চিঠি লিখতেন। ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মা থেকে নির্মলকুমারী ও রাণী মহলানবিশ, প্রমথ চৌধুরী, অমিতা ঠাকুর আরও কত জন। ১৯০২ থেকে ১৯৪১ ধারাবাহিক ভাবে। দীনেশচন্দ্র সেন, প্রিয়নাথ সেন, শৈলেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখকে আবার পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। ১৯১১-র ১৩ এপ্রিল মীরা দেবীকে লিখছেন, পয়লা বৈশাখের উৎসবের জন্য আশ্রম প্রস্তুত হচ্ছে। অনেকেই আসবেন বলে তাঁর ধারণা। ২৪ বছর পর, ১৯৩৫-এর ৮ এপ্রিল হেমলতা সেনকে লিখছেন পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে বিপুল জনসমাগম হবে।পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভা যাত্রা, গ্রামীন মেলা আমাদের ঐতিহ্যকে বহন করে। কিন্তু আজ আর নববর্ষ নতুন চেতনার আলোকবর্তিকা নিয়ে আসে না। উৎসব আছে, প্রাণ নেই। এক সময় সব ধর্মের মানুষ বিভেদ ভুলে উৎসবের দিনে একই সঙ্গে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন। সেখানে এখন ধর্ম আর রাজনীতির প্রচ্ছন্ন শাসন মানুষের থেকে মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছে। অথচ পয়লা বৈশাখ তো দ্বিধাহীন মহামিলনের উৎসব। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, শামসুর রাহমানরা এই দিনটিকে কেন্দ্র করে মিলনের গান গেয়েছেন, দিয়েছেন অশুভকে দূর করে শুভর বার্তা। নববর্ষ বছরটির জন্য আশার বাণী বহন করে নিয়ে আসে। তাই নববর্ষ আমাদের প্রাণে জাগায় আশার আলো ও উদ্দীপনা। পরিশেষে মহান স্রষ্টার নিকট এতটুকু চাওয়া এই যে, অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, নির্মল কর, উজ্জ্বল কর, সুন্দর করো হে…’।
নববর্ষ বয়ে আনুক সবার জীবনে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি।
লেখক : শিক্ষক , প্রাবন্ধিক