অমল বড়ুয়া
সব দেশেই সর্বজনীন উৎসব হিসেবে উদযাটিত হয় নববর্ষ। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্তে¡র দিক থেকে বাংলায় বর্ষবরণও সর্বজনীন এবং এর রয়েছে ঋদ্ধ ইতিহাস ও উর্বর ঐতিহ্য। বাংলায় বর্ষবরণ উৎসবের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আবহমান গ্রামবাংলার মানুষের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, কাল, ঋতু, প্রকৃতি, কৃষি ও উৎপাদনের মতো বিষয়াবলী। ঋতুর পরিবর্তনে প্রকৃতি বদলায় তার সাথে বদলায় কাল ও মানুষের যাপিতজীবন, পরিবর্তন আসে কৃষি ও উৎপাদনেও। অবিরত এই পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে চন্দ্র ও সৌরবর্ষ চক্র। আর এই চন্দ্র-সৌরবর্ষের দিন-মাস-বছর গণনার হিসাব রাখতে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের ভরসা বর্ষপঞ্জিকা। এই পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার উদ্ভবের পেছনেও রয়েছে ফসল বপন ও সংগ্রহের অবদান। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বাংলা সনের যাত্রার পেছনেও এ অঞ্চলের কৃষকের অবদান অনস্বীকার্য। তবে উল্লেখ্য যে, বাংলা সনেরও আগে বঙ্গ অঞ্চলসহ ভারতীয় উপমহাদেশে সাল গণনার বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রচলিত সনের মধ্যে- রাজা বিক্রমাদিত্যের নামে বিক্রমাব্দ, চতুর্থ শতকের দিকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নামে গুপ্তাব্দ, উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের নামে হর্ষাব্দ, শক-ক্ষত্রপদের নামে শকাব্দ, পাল শাসনের সময় পালাব্দ, লক্ষèণ সেনের শাসনকালে লক্ষণাব্দ, মগদের রাজত্বের সময় মগাব্দ এবং চৈতন্যবাদের উত্থানে চৈতনাব্দ ছিল সবচেয়ে পরিচিত। বঙ্গ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল প্রায় ২৪টির মতো সন। এই সব সন রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা অঞ্চলের নামে প্রচলিত ছিল। কিন্তু বাংলা সন হচ্ছে বাংলাদেশ ও জাতির নামে। তাই এক্ষেত্রে বাংলা সন একেবারেই স্বকীয়।
বাংলা সন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ইতিহাসবিদগণ চারজন শাসকের নাম উল্লেখ করেন। এ চারজন হলেন তিব্বতি রাজা ¯্রং সন, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ও মুঘল স¤্রাট আকবর। আবার কোনো কোনো গবেষক মনে করেন বাংলার কাহিনী কিংবদন্তির মহানায়ক মহারাজা বল্লাল সেন বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের উদ্ভাবক। তিব্বতীয় রাজার দাবিটা আসে ফরাসি পÐিত সিলভ্যাঁ লেভির কাছ থেকে। তিনি তাঁর রচিত ‘লে নেপাল’ নামক পুস্তকে বলেছেন, রাজা স্রং সন ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ও পূর্ব-ভারত জয় করেন। তার নামের সন থেকেই বাংলা সন শব্দ যুক্ত করে বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয়। কিন্তু স্রং সনের বাংলা আক্রমণের নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না বলে এই মতবাদ এখানেই খারিজ হয়ে যায়। বঙ্গাব্দের দ্বিতীয় মতবাদে বলা হয় গৌড় রাজ শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু করেন। এই মতবাদের সমর্থক হলেন ‘বঙ্গব্দের উৎসকথা’ বইয়ের লেখক সুনীলকুমার বন্দোপাধ্যায়। এই মতবাদ খারিজ হয়ে যায় গৌর রাজ শশাঙ্কের অধীনস্ত মাধব বর্মণ তার গঞ্জাম লেখতেই গুপ্তাব্দ ব্যবহার করার কারণে। বাংলা সন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সুলতান হোসেন শাহ’র নাম আসে তৃতীয় মতবাদ অনুযায়ী। বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের উন্নয়ন ও বিকাশে সুলতান হোসেন শাহ’র নাম চির স্মরণীয়। সুলতানি আমলে অনেক শাসকই বাংলায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করেছেন। ইলিয়াস শাহ ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। বাংলার স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয়তাবোধ জাগ্রতকরণে সুলতানী শাসকদের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। তবে বঙ্গাব্দ প্রচলনের ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোনো অবদান দৃষ্ট হয় না।
এক্ষেত্রে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে নাম আসে সম্রাট আকবর-এর। এই মতবাদের সমর্থকরা হলেন জ্যোতি:পদার্র্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়ালের মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা। স¤্রাট আকবর তাঁর রাজ্যশাসনের ২৯ বছরে (হিজরি ৯৯২ এবং খ্রিস্টীয় ১৫৮৪ সালে) পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দেন। তাঁর নবরতœসভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজির নেতৃত্বে ও তত্ত¡াবধানে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে নতুন সনের গোড়াপত্তন হয়। আকবরের প্রবর্তিত এই নতুন সন পরিচিতি পায় ‘ইলাহি সন’ হিসেবে। হিজরি সন পুরোপুরি চন্দ্র নির্ভর হওয়ায় ভারতীয় ঋতুর সাথে মিলতো না। এতে রাজস্ব আদায়েও অসুবিধা হতো। এজন্য মাসগুলোকে চন্দ্রনির্ভর রেখে বছরকে সৌর করে ঋতুর সাথে খাপ খাওয়ানো হয়। ফসলি সন হিসেবে এর কার্যকারিতা ছিল যুগোপযোগী। আকবর অন্য যেসব আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওড়িশার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। এগুলোকে বলা হয় ফসলি সন। বাংলা সনও তেমনই ফসলি সন। আইন-ই-আকবরি থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রæটিমুক্ত ও বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। তবে স¤্রাট আকবর প্রণীত সনের কাঠামোই যে বাংলা সন এবং ‘ইলাহি সন’ থেকে যে বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে এ নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। তাছাড়া, বঙ্গাব্দ শব্দটি (বাংলা বছর) আকবরের সময়কালের কয়েক শত বছর পূর্বে দুটো শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, বাংলা দিনপঞ্জির অস্তিত্ব আকবরের সময়ের পূর্বেও ছিল।
১৭০০ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার দীউয়ান হিসেবে নিয়োগ দেন মুর্শিদকুলী খানকে। তিনি ছিলেন রাজস্ব এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে খুবই দূরদর্শি। ১৭১৭ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। মুর্শিদকুলী খান দীউয়ান ও সুবাদার হলেও সত্যিকার শাসকের মতো সংস্কার আনেন পুরো ব্যবস্থার। বাংলা সন এবং আকবরের ইলাহি সনের মধ্যে যে ঐতিহাসিক ফাঁক ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে, তা পূরণের জন্য মুর্শিদকুলী খান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। স¤্রাট আকবরের প্রবর্তিত ‘ইলাহি সন’-কে ভিত্তি ধরে ঠিক রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই মুর্শিদকুলী খানের সময় বাংলা সন জন্ম নেয়। এর ফলে মাসের ফারসি নামগুলো পরিবর্তিত হয়ে যায় নক্ষত্রের নামানুসারে,- বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশি^ন, কার্তিক, অগ্রহায়ন, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র। ইলাহি সন থেকে উৎপত্তি ঘটলেও বাংলা সালের মাস এবং দিনের নাম পূর্বপ্রচলিত শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়। বাংলা সনের বর্তমান কাঠামোর প্রবর্তন করেছেন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খান। এর-সমর্থনে কোনো কোনো গবেষক বলেন যে, প্রাচীন বাংলার বহু পুঁথিতে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দকে ‘যবন নৃপতে শকাব্দ’ বা ‘যবনী বৎসর’ বলা হয়েছে। এর থেকে ধারণা করা হয় যে কোন যবন তথা মুসলমান রাজা বা বাদশাহ বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রবর্তন করেন। ১৯৫২ সালে বাংলা সনের সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন প্রখ্যাত জ্যোতি:পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এবং তাঁর কমিটি। তারই ফলশ্রæতিতে ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে প্রধান করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি নথিতে বাংলা তারিখের প্রথা চালু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় তা আরও দৃঢ় হয়। অবশেষে ১৯৮৭ সাল থেকে সরকারি কাজে খ্রিস্টাব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা সন লেখার নির্দেশনা আসে।
বর্তমানে বাংলার নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে পালিত নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে; তবে এক সময় নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ‘ঋতুকালীন উৎসব’ হিসেবে পালিত হত। মূলত: কৃষকদের ঋতুর উপর নির্ভর করেই এই উৎসব পালিত হত। এখন গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলা ১ বৈশাখ এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কবিগান, যাত্রাপালা, নাটক, বলি-খেলা, তুমরুবাজি-খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়। নববর্ষের সময় বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব ‘শোভাযাত্রা’কে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশের পাহাড়ী জনগণও তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অংশ হিসেবে পহেলা বৈশাখকে ‘বিজু, সাংগ্রাই বা বৈসাবি’ বর্ষবরণ উৎসব হিসেবে সাড়ম্বরে উদযাপন করে। পহেলা বৈশাখ বর্তমানে বাংলা সংস্কৃতির এক অপার্থিব অংশে পরিণত হয়েছে, যা ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ও বাঙালির সর্বজনীন প্রাণের উৎসব হিসেবে উদযাপন করে। এই উৎসব আবাহমান বাংলার ঋদ্ধ লোকায়িত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সর্বজনীন সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধনের প্রতিনিধিত্ব করে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট