বেশ কয়দিন ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীরা সীমান্তে ল্যান্ডমাইন স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়াগুলো সংবাদ প্রকাশ করে আসলেও তার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু গত ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা বান্দরবনের নাইক্ষ্যংছড়িতে পৃথক দুইটি ল্যান্ডমাইন বা স্থল মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটার পর সবার টনক নড়ে। এ বিস্ফোরণের ঘটনায় তিন জন বাংলাদেশি আহত হয়েছে। ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের পর সীমান্ত এলাকাজুড়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এটিকে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেছেন একই সাথে এ জাতীয় ঘটনাকে আমাদের জন্য অশনি সংকেত ! বলে করেন তারা। এ বিষয়ে মিয়ানমার সরকার ও বিদ্রোহী দুই পক্ষের সাথে বাংলাদেশ সরকারের কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তারা।
সম্প্রতি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সামরিক জান্তা বাহিনীর টানা যুদ্ধের পর সীমান্তবর্তী ওই এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে এসেছে বলে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরেও বলা হয়েছে। এরই মধ্যে শুক্রবার স্থলমাইন বিস্ফোরণে তিনজন আহত হওয়ার পর নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ওই তিনজন বাংলাদেশি অবচেতনভাবে কিংবা সচেতনভাবেই খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে সীমান্ত এলাকা পাড়ি অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে বলেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটেছে’। হঠাৎ কেন একদিনেই এরকম তিনটি ঘটনা ঘটলো এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার একজন প্রাক্তন চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী এলাকা মিয়ানমারের অংশ সম্প্রতি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আসার পর বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য যেমন মিয়ানমারে যাচ্ছে একই সঙ্গে সে দেশ থেকে গরুসহ বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশে আসছে। সাবেক ওই জনপ্রতিনিধি আরো জানিয়েছেন, পণ্য আনা-নেয়ায় ওই সীমান্তের কিছু নির্দিষ্ট রুট দিয়ে অবৈধ পথে প্রবেশ করতে গেলে মিয়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীকে ‘ঘুষ’ দিতে হয়। ‘আমি যতটুকু জানি অনেকেই ঘুষ না দিয়ে চোরাকারবারি করতে গিয়ে বিকল্প পথ ব্যবহার করেন। শুক্রবার যারা গিয়েছিলেন তারা ওই বিকল্প পথে গিয়েই মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন’। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেন, সীমান্তে স্থল মাইনের উদ্দেশ্য শত্রুকে হত্যা করা না, শত্রুকে বাধাগ্রস্ত করা। এগুলো কেউ যদি স্থাপন করেও তাহলে একটি নির্দিষ্ট আইন মেনে করতে হয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে মিয়ানমারে এখন যা আছে সেটা স্পষ্ট আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘন’। উল্লেখ্য যে, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকটের সময়ে স্থল মাইন বিস্ফোরণের খবর বেশি আসতে শুরু করে সীমান্ত থেকে। রাখাইন রাজ্য থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসার সময় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে স্থাপন করা অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন বিস্ফোরণে গত কয়েক বছর হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যাযজ্ঞ চালাতে অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন ব্যবহৃত হয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘সীমান্তে সাধারণত যে মাইন ব্যবহৃত হয়ে থাকে সেটা এন্টি পার্সোনাল মাইন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এখনও বাংলাদেশ সীমান্তে স্থল মাইন পুঁতে রাখছে যা সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে সীমান্ত এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ২৭১ কিলোমিটার। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল নামার পর সীমান্তে স্থল মাইন স্থাপনের পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে মিয়ানমারের কাছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর টানা লড়াই চলে। সে সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলা এসেও পড়ে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। মিয়ানমারের গণমাধ্যমের খবর বলছে, আগে রাখাইনসহ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো মিয়ানমার বাহিনীর দখলে থাকলেও টানা যুদ্ধের পর সেসবের নিয়ন্ত্রণ চলে এখন বিদ্রোহী আরাকান আর্মির হাতে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ আরো বলেন, সীমান্তের ওপারের এলাকাগুলোর দখল নিলেও আরাকান আর্মির মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে যে দেশটির সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী এটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে।
‘আরাকান আর্মির দখল থেকে ভূখন্ড নিয়ন্ত্রণ নিতে যৌথ অভিযান হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর। এজন্য মিয়ানমার জান্তা বাহিনী আবারো অভিযান চালাতে পারে। মূলত এমন অভিযান যেন না চালাতে পারে বা সেটিকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য এটা করতে মাইন পুতে রেখে প্রতিহত একটা কৌশল হতে পারে আরাকান আর্মির।’ তবে বিশ্লেষকরা এর জন্য মিয়েনমার সেনাবাহিনীকে দায় দিচ্ছেন। যেই কারণই হোক, বাংলাদেশ সীমান্তের গা ঘেঁষে ল্যান্ডমাইন পুতে রাখা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে মিয়ানমারের উপর মাইন সরানোর চাপ সৃষ্টির কোন বিকল্প বলে আমরা মনে করি। এছাড়া সীমান্তে বিজিবির নজরদারী জোরদার করতে হবে।