বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

2

কয়দিন আগেও ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক যেখানে মধুচন্দ্রিমায় ছিল, সেখানে হঠাৎ তিতে হয়ে উঠা, বাকবিতন্ডা; এমনকি বাংলাদেশ সহকারী হাই কমিশন অফিসে হামলার মত ঘটনায় রূপ নেয়ার ফলে দু’দেশের সাধারণ মানুষ অস্বস্থিতে দিন গুজর করছেন। দু’দেশের সরকারের মধ্যেও চলছে নানা অস্থিরতা। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের তীক্ষè নজর এখন বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের গিঁটে গিয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় যুদ্ধবিদ্ধস্ত ও অস্থির পৃথিবীতে নতুন করে আরো কোন সংকটের উদয় হচ্ছে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে শান্তিকামী মানুষ। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কপালে ভাঁজ, কোন দিকে গড়াচ্ছে বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের সম্পর্ক!
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দু’দেশের সম্পর্ক আরো গভীরে গ্রথিত হয়। গত ৫২ বছরে এ সম্পর্ক সর্বোচ্চ উষ্ণতায় পৌঁছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। আর যেহেতু বাংলাদেশের তিন দিক জুড়ে বিস্তৃত সীমানা যে ভারতের সেই ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও প্রধান প্রতিবেশী-তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এক্ষেত্রে অন্য যেকোন দেশের চেয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ঘটে চলা ঘটনাগুলো দুই দেশের সম্পর্ককে এক বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মনে হয়। গত সোমবার ভারতের আগরতলার কুঞ্জবনে অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়। একই দিন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে যোগ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলেছেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন তিনি। এর পাশাপাশি ভারতের বেশকিছু অনলাইন মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে যে ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে, তার ফল যে ভালো হয়নি, সেটা গত সোমবারের ঘটনায়ই স্পষ্ট। এসব অনলাইনের অপপ্রচার নিয়ে বাংলাদেশ উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে কয়দিন ধরে।
শুরুতেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঘটে যাওয়া সা¤প্রতিক ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সা¤প্রতিক তিক্ততার বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় সবেধন নীলমণি হিসেবে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী যে দেশটির সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উষ্ণ ছিল, সেটি বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনে প্রতিবেশী দেশ দুটির মাঝেও এখন দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান অনেক দেয়াল রচিত হয়ে গেছে।
এই ‘দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দেয়াল’ সরাতে গত সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। কূটনীতিক ব্রিফিং শেষে তিনি জানিয়েছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে কোনো ধরনের সা¤প্রদায়িক কর্মকাÐ বরদাশত করবে না।’ ব্রিফিংয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের কথা এসেছে। প্রধানত ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার। উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ উভয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী।’ ভারতের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি থাকলে তা দূর হবে বলে প্রত্যাশা করেছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)। তার মতে, ‘এ দেশের মানুষ ভারতবিরোধী নয়। যতটুকু ভুল-বোঝাবুঝি আছে, এটা দূর হবে।’
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারত ও বাংলাদেশের মানুষে মানুষে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সে কারণেই বারবার হোঁচট খেলেও এই বন্ধন কখনো ছিন্ন হয় না। দুই দেশই অভিন্ন ঐতিহ্যের অধিকারী, অনেক ক্ষেত্রে ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির মিল রয়েছে গভীরে। রয়েছে বাণিজ্যিক সম্পর্ক।বিগত কয়েক বছরে যোগাযোগেও অনন্যতায় পৌঁছেছে। এ অবস্থায় আমরা চাই, পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে দেশ দুটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকুক। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সব ধরনের যোগাযোগ ও সহযোগিতা ক্রমশ জোরদার হোক। সেই লক্ষ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে উভয় দেশকেই আরো বেশি আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে। গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে এক আলোচনাসভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ইতিবাচক ও গঠনমূলক থাকবে।’ বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী দেশ। এই দুই দেশের রয়েছে অভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য। সবার ওপরে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দুই দেশের মানুষের মধ্যে রক্তের যে বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, তার অবিচ্ছেদ্য সংযোগ। এ সংযোগ কোন রাষ্ট্রীয় তিক্ততায় ছিড়তে পারে না। আমরা আশা করি, সম্প্রতি যা ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে, দু’দেশের সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে সহসাত তার অবসান হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক উত্তরোত্তর আরো শক্তিশালী হবে এবং উভয় দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের অনিবার্যতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।