পূর্বদেশ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থানের নয় মাস পার হলেও বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবর্তন আনাটা দিন দিন ‘কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে’ বলে মনে করছে দ্য ইকোনমিস্ট। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এ সাপ্তাহিক পত্রিকা লিখেছে, রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোও দুরূহ হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘একনায়কতান্ত্রিক’ শাসনের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ টানা ‘ভূমিকম্পের’ মধ্য দিয়ে গেছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূসের ভাষায়, ‘যা কিছু ধ্বংস হয়েছে, আমরা সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করছি। আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি; জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা আশাবাদী’।
ইকোনমিস্ট লিখেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে তার শাসনামলের ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র ক্রমে সামনে আসছে। গত বছর এক শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতি বছর প্রায় ১৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এর বাইরে অপহরণ, হত্যা ও গণহত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। যদিও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। খবর বিডিনিউজের
বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো দাবি তুলেছে, ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ব্যবস্থা ফিরে না আসে, সেজন্য গণতান্ত্রিক পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের নয় মাস পার হলেও বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবর্তন আনাটা দিন দিন কঠিন হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে’- লিখেছে ইকোনমিস্ট।
পত্রিকাটি বলছে, পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াটা শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর পরই শুরু হয়। নির্বাচন, আইন ও বিচার ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনার লক্ষ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে কমিশন গঠন করা শুরু করেন ইউনূস। এসব কমিশনে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও রাখা হয়। আর এসব কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করতে গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশন সব সুপারিশ (এখন পর্যন্ত ১৬৬টি) জড়ো করছে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোও ভ‚মিকা রাখছে।
ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করবে, যা নির্বাচন আয়োজনের পাশাপাশি ‘নতুন’ বাংলাদেশের সূচনা ঘটাবে। কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছানোটা সহজ হবে না বলে মনে করছে দ্য ইকোনমিস্ট। কারণ হিসেবে পত্রিকাটি বলছে, কোন কমিশনের থাকা উচিত, কোনটির থাকা উচিত নয়, তা নিয়ে শুরু থেকেই রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কারো কারো অভিযোগ, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি— তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য একটি কমিশন করা উচিত ছিল। শিক্ষায় গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগও আছে। সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন নিয়ে। এই কমিশনের প্রতিবেদনে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তন এনে নারীদের আরও অধিকার দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা নিয়ে ইসলামপন্থি দলগুলো তীব্র আন্দোলনে নেমেছে।
দ্য ইকোনমিস্ট লেখেছে, সংস্কারপন্থিরা আশাবাদী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ ইতোমধ্যে কিছু পরিবর্তন বাস্তবায়িত হওয়ার কথা বলেছেন, যেমন— হাই কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। ১৫ মে’র পর দ্রæতই অংশীজনদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরুর ব্যাপারে আশাবাদী ঐকমত্য কমিশন। আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন আলী রীয়াজ। যদি এ সময়সূচি ঠিক থাকে, তাহলে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে পারে।
মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য বলে আসছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই ভোট হবে এবং তিনি তাতে অংশগ্রহণ করবেন না। ইকোনমিস্ট লিখেছে, নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার কারণে কিছু মূল্যও দিতে হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম ও ব্যাংক খাত কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নাজুক। একটি জরিপের বরাতে পত্রিকাটি লিখেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে, ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলার কোনো উন্নতি হয়নি।
সড়কে বিক্ষোভ এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিক্ষোভকারীদের সাধারণ একটি দাবি হল— আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দাবির মুখে ১২ মে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। ফলে দলটি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। ইকোনমিস্ট লিখেছে, মানুষের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও আওয়ামী লীগের কিছু সমর্থন এখনো আছে।
এ দলের নেতা মোহাম্মদ আরাফাত বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছিল ‘জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত’ দল, যাদের ‘জিহাদিরা’ সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য লড়বে। প্রতিবেদনের শেষভাগে ইকোনমিস্ট লিখেছে, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও আওয়ামী লীগ এখনও দেশে ‘কম্পন’ সৃষ্টি করতে পারে।