বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপর্যয়ের কারণ

1

অমল বড়ুয়া

প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে বাংলাদেশ ভারত-উপমহাদেশের অন্তর্গত অঞ্চল হিসেবে তার ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি সভ্যতার অংশীদার। তাই উপমহাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাজনীতির সুদীর্ঘ উত্তরাধিকার রয়েছে বাংলার। সুতরাং শাসনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রের উপমহাদেশীয় ইতিহাসের সাথে বাংলাদেশও ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আধুনিক পন্ডিতেরা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর সময়ে গণতন্ত্র শব্দটি চিহ্নিত করেছেন। গ্রিস যখন গণতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অভিনিবিষ্ট হচ্ছিল, ঠিক তার কিছুকাল পূর্ব থেকেই উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের উৎসের খোঁজ মেলে। তাই বলা যায় প্রাথমিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নিদর্শন আসে ভারতের স্বাধীন ‘প্রজাতন্ত্র’ সংঘ এবং গণ থেকে, যা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে কিছু কিছু অঞ্চলে চতুর্থ শতাব্দী অবধি বিদ্যমান ছিল। গ্রীক ঐতিহাসিক ডায়োডরাস উল্লেখ করেছেন যে,- স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ভারতে বিদ্যমান ছিল। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িককালে লিচ্ছবিদের একটি প্রধান পরিচালনা পর্ষদ ছিল যাতে ৭০৭৭ রাজা ছিলেন, প্রত্যেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের প্রধান ছিলেন। রাজা বা সরকার সমাবেশের সাথে তার কার্যক্রমের সমন্বয় রেখে চলতেন; শাক্য, কলিয়, মল্ল এবং লিচ্ছবিদের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ-দরিদ্র সকল পুরুষের জন্য এই সমাবেশের দ্বার খোলা ছিল। প্রথম ‘প্রজাতন্ত্র’ বা গণ সংঘ যেমন মল্লদের ক্ষেত্রে কুশীনগর শহরকে কেন্দ্র করে এবং বৃজি সংঘটি বৈশালী শহরকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গড়ে উঠেছিল এবং চতুর্থ শতাব্দী অবধি কিছু অঞ্চলে স্থায়ী হয়েছিল। বিভিন্ন সময় ভারত-উপমহাদেশ বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তি দ্বারা শাসিত হলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্বরূপটি বিপন্ন হয়ে পড়ে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদের অধিপতি নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে পরাজিত করে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭০০ থেকে ১৯৪৭ সাল অব্দি বাংলাসহ পুরো ভারত-উপমহাদেশকে প্রায় দুইশত বছর শাসন করে। ব্রিটিশ শাসনকালে উপমহাদেশে ওয়েস্টমিনিস্টার ব্যবস্থার গণতন্ত্র চালু হয় যা সেই সময়ে ব্রিটেনে প্রচলিত ছিলো। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান দুইটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়।
পূর্ব-পাকিস্তান (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ১৯৪৭ এর পর পাকিস্তান মুসলিম লীগের আধিপত্যের রাজনীতি দেশে উদার গণতন্ত্র আনতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫৪ সালের পূর্ব-পাকিস্তান (বাংলাদেশ) আইনসভা নির্বাচনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব-পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে। যার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানি অভ্যুত্থান; ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ফলে পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সূচনা হয় যা ১৯৭১ সালে দেশকে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান থেকে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানমতে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে সদ্য প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের
মাধ্যমে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়, যা ছিল বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পতনের প্রারম্ভিক কাল। এই সময়ে সরকার প্রাথমিকভাবে নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত করার সাথে সাথে বেশিরভাগ সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সামরিক
অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই ১৯৭৬ সালের ৩০শে নভেম্বর জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতির পদে অভিষিক্ত হন। ১৯৭৬ সালে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শুরু হয় আবার। ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এইচএম এরশাদ আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক আইন জারি করেন। সামরিকশাসনের কবলে পড়া এদেশের গণতন্ত্রের ক্রমাবনতি ও বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালে প্রথম প্রতিবাদ শুরু করে ছাত্ররা। ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে এই আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। আন্দোলন দমাতে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র নিরীহ ছাত্রদের উপর গুলি চালালে জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা সহ অনেক ছাত্রছাত্রী নিহত হয়। এর পর থেকে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে লাগাতার ছাত্র আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর বুকে পিঠে সাদা রঙে ‌‌‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে মিছিলরত নুর হোসন পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ১৯৯০ সালের ১০ই অক্টোবর জেহাদ নামে একজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। শহীদ জেহাদের লাশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে তৎকালীন আন্দোলনরত ২৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‌‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’। ১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং ৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সূচনা হয়। গণভোটের
মাধ্যমে সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯১ দ্বারা ৬ আগস্ট ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রেক্ষিতে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ত্রয়োদশ
সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিল পাস করা হয় ও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৬ সালে দেশে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করে এবং ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে: আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টি। সামরিক শাসনের অধীনে থাকলেও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশিরভাগ সময় ধরে এর একটি গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় থাকলেও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। যার ফলে বাকস্বাধীনতার বৈশ্বিকসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২০১৮ সালের প্রতিবেদনমতে ১০০টি দেশের মধ্যে ৪৪তম। মুক্ত ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ২০১৯ সালের প্রতিবেদনমতে ১৮০টি দেশের মধ্যে বৈশ্বিকসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ একটি দলের সদস্যদের একই দলের অন্যান্য দলীয় সদস্যদের দ্বারা আনা বিল বা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত রাখে যা পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধ। এমন কি এটি সংসদ সদস্যদের নিজ নির্বাচনী এলাকার স্বার্থেও ভোটদানের ক্ষমতাও হ্রাস করে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিপথগামীতার দুইটি দিক পরিলক্ষিত হয়- (১) মার্শাল ল বা সামরিক শাসন ও (২) রাজনৈতিক সংকীর্ণতা। মার্শাল ল বা সামরিক আইন গণতন্ত্রকে হরণ করে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র কায়েম করে, যেখানে ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয় এবং জবাবদিহিতা, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। রাজনৈতিক সংকীর্ণতার মূলে হচ্ছে- রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির মধ্যে আদর্শ, মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অভাব। আর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার ও সুশাসন তখনই বিপর্যস্ত ও বিপন্ন হয় যখন রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না, অনৈতিকতা ও মিথ্যাচার প্রকট রূপ ধারণ করে, অর্থের বিনিময়ে নেতা নিবার্চন করে, পেশিশক্তির উত্থান ঘটে, আমলাতন্ত্রের সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আপোস করে, নেতাকর্মীদের অপরাধের বিচার হয়না, একজন নেতাকে বেশি সুবিধা দিয়ে (বারবার পদ ও নমিনেশন দিয়ে) তাকে সেই এলাকার সর্বেসর্বা করে তুলে একনায়কে পরিণত করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে (এর দ্বারা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করে), ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আনে, বিরোধী মত ও পথের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও দমনের জিঘাংসা, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার নির্লজ্জ প্রয়াস, স্বজনপ্রীতি ও দুনীর্তিতে নিমজ্জিত হওয়া, দেশ ও জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না থাকা এবং সত্যিকার দেশপ্রেমের অভাব, সর্বোপরি দেশের জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রকে ধারণ ও লালন করার সক্ষমতার অভাব। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হলে হবে না, রাষ্ট্রের জনগণকেও গণতান্ত্রিক হতে হবে। শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক গুণাবলী অর্জনের সাথে সাথে জনগণকেও গণতান্ত্রিক হওয়ার সেই গুণবাচক বিশেষ্যের অধিকারী হওয়া জরুরি।
একজন ব্যক্তি গণতান্ত্রিক হলে তার পরিবার গণতান্ত্রিক হয়, পরিবার গণতান্ত্রিক হলে সমাজ গণতান্ত্রিক হয় আর সমাজ গণতান্ত্রিক হলে রাষ্ট্রও স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণতান্ত্রিক হতে বাধ্য। তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রথমে ব্যক্তি থেকে উৎসারিত হওয়া দরকার। প্লেটোর মত হলো- ‘মানুষ যেমন হবে রাষ্ট্রও তেমনিই হবে। মানুষের চরিত্র দ্বারাই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।’ বাংলাদেশের জনগণকে গণতন্ত্র বোঝার এবং গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ জরুরি, তা পরিবার, সমাজ থেকে শুরু শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রেও শিখন ও চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটানো উচিত।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট