বাংলাদেশের ঔষধ বিপণন ব্যবস্থায় পরিবর্তন প্রয়োজন

1

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী

সম্প্রতি ছেলের চিকিৎসাজনিত প্রয়োজনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের বিভিন্ন জায়গায় ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন দেখে অবাক হয়ে গেলাম। শত শত চিকিৎসকের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য দেওয়া বিজ্ঞাপনটি সম্পূর্ন অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন শৃংখলা বাহিনী ,ঔষধ প্রশাসন এবং মেডিকেল কলেজ প্রশাসনের নাকের ডগায় বিজ্ঞাপনটি আমাকে ব্যতিত করেছে পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়ালে সাটানো ছোট্ট বিজ্ঞাপনটির ভাষা তুলে ধরলাম -“ফিজিসিয়ান স্যাম্পল ঔষধ ক্রয় করা হয়। আমরা ট্যাবলেট.ক্যাপসুল, ইনজেকশান, ইনহেলার ও আইড্রপ সততার সহিত ক্রয় করে থাকি”। ফোন করার সাথে সাথে নগদ টাকা দিয়ে ক্রয় করা হয়। যোগাযোগ ঃ মোঃ মিলন মিয়া, ফোনঃ ০১৯২৭-৭৬৪৫৮৮, ০১৭৪৬-৯৭০৭৫৬। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মত জায়গায় যদি এরকম বিজ্ঞাপন সাটানো থাকে বা দুঃসাহস পায় তাহলে নিশ্চিত বাংলাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই চক্রটি আরো বেপরোয়াভবে সক্রিয়। বিক্রি নিষিদ্ধ ‘ফিজিশিয়ান স্যাম্পল’ ঔষধে সয়লাব হয়ে যায় ছোট ছোট মফস্বল শহর। এসব ওষুধের প্যাকেটেই লেখা থাকে- ‘এগুলো স্যাম্পল, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ’। কিন্তু অসাধু এই কারবারের সুযোগ নিয়ে ফার্মেসিগুলোও স্যাম্পল ওষুধ ‘ক্যাচ কভারে’(ঔষধের প্যাকেট) ভরে ক্রেতাদের ঠকিয়ে আসছেন। ঔষধ প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় বন্ধ হচ্ছে না এই ঔষধ কেনাবেচা। বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিগুলোতে এসব ঔষধ প্রকাশ্যে বিক্রি করা হলেও তা প্রশাসনের নজরদারির বাইরে রয়ে গেছে। চিকিৎসকদের প্রলোভনে ফেলে দেশের অধিকাংশ ঔষধ কোম্পানি এসব স্যাম্পল উদারচিত্তে বিলিয়ে যাচ্ছে। অনেক চিকিৎসক মহাউৎসাহে সেসব গ্রহণের পর খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ঔষধ কোম্পানিগুলোর প্রোডাক্ট বিক্রির প্রতিযোগিতার কারণে তা করা হচ্ছে। আবার এমন চিকিৎসকের সংখ্যাও অনেক যারা স্যাম্পল নিতে অস্বীকার করেন।
এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে যে কোনো ঔষধকে বাজারজাত করার পূর্বে ল্যাবরেটরিতে, প্রাণীদেহে এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মানবদেহেও বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ক্লিনিকাল ট্রায়ালের (ঈষরহরপধষ ঞৎরধষ) পর বেশকিছু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক গুণাগুণ, কার্যকারিতা ও নিরাপদ কিনা সে বিষয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে বাজারজাত করতে হয়।যেকোনো প্রোডাক্টের সামগ্রিক তথ্য কোম্পানির লিটারেচার জার্নালে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডাক্তারগণ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক ড্রাগস এর নামটাই লিখে থাকে। যেটি নিশ্চিত করে ঔষধের তৈরীর উপাদানে কি, তার কার্যকারীতা কি – কোম্পানিতে ব্র্যান্ড বা নাম ভিন্ন হলেও জেনেরিক নাম থেকে বুঝা যায় ঔষধটি কি রোগের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে রয়েছে এর ব্যতিক্রম বাংলাদেশে চিকিৎসকগন জেনেরিক নামের বিপরীতে কোম্পানির ব্র্যান্ড নামের উপর ঔষধগুলো ব্যবস্থাপত্রে লিখেন। কিন্তু ওষুধের স্যাম্পল (নমুনা) বলে একটা বিষয় আমাদের ওষুধ শিল্পের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় বৈধভাবে স্থান করে আছে দীর্ঘদিন ধরে। ঔষধ কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন ধরনের মার্কেটিং পলিসির কারণে। এছাড়াও রোগী বা তার অভিভাবকগন জেনেটিক নামে ঔষধ কিনতে এখনও অভ্যস্ত নয় আর সেই সুযোগটি গ্রহণ করে ঔষধ কোম্পানিগুলো। সেক্ষেত্রে এই স্যাম্পল ঔষধ প্রদানের বিষয়টি নেহায়েত একটি প্রলোভনের বিজ্ঞাপন। চিকিৎসকদের মাঝে বিলি করার জন্য প্রায় সকল ঔষধ কোম্পানিরই ভালো বেতন-ভাতা ভুক্ত দক্ষ ও উচ্চশিক্ষিত এমপিও (গচঙ) বাহিনী আছে। যাদেরকে স্থানীয় ভাষায় রিপ্রেজেন্টেটিভ বলা হয়। তাদের রিপ্রেজেনটেটিভরা বিভিন্ন চিকিৎসকের চেম্বার ভিজিট করে শুধু মাত্র তাদের ব্যান্ডের ঔষধগুলো লেখার অনুরোধ করে এবং তার বিনিময়ে চিকিৎসককে কোম্পানি কর্তৃক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। এদের কারণে অনেক সময় চিকিৎসকের চেম্বারে রোগীদের অপেক্ষা করতে হয়ে যা বিরক্তিকর। এমনকি তাদের ব্যান্ডের ঔষধগুলো লিখছে কিনা সেটা তারা চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বের হওয়া রোগীর ব্যবস্থাপত্র দেখে এবং তার ছবিও তুলে নেয় যা রোগীর জন্য প্রচন্ড বিব্রতকর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, আমরা জানি ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ঔষধ বিক্রি নিষিদ্ধ। এই ঔষধ শুধুমাত্র আত্মীয়স্বজন বা গরিব রোগীদের দেওয়া যায়। তাই আমি যেসব ফিজিশিয়ান স্যাম্পল পাই, তা গরিব রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে থাকে এমন প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দিই। তবে অনেক চিকিৎসকই তা ফার্মেসিতে বিক্রি করেন, এটাও কিছুটা ঠিক। দালালেরা নিজেরাই চিকিৎসকের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে ঔষধ সংগ্রহ করেন এবং তারা এসব ঔষধ ফার্মেসিতে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কম দামে ওষুধগুলো বিক্রি করেন। এতে ফার্মেসিগুলো অতিলাভের আশায় তা বিক্রি করে। তাই ঔষধ বিপণন ব্যবস্থায় স্যাম্পল প্রথা বাতিল করা অত্যাবশ্যক। তবেই ফার্মেসিতে ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ওষুধ বিক্রি বন্ধ হবে।
এই স্যাম্পল ঔষধের কারণে কিন্তু অনেক সমস্যারও সৃষ্টি হয়,যেমন- যতদূর জানি এই স্যাম্পল ওষুধ ট্যাক্স ফ্রি, কিন্তু এগুলো নানা ভাবে বাজারেই বিক্রি হয়,এতে সরকার কিছু রাজস্ব হারায়। স্যাম্পলের নামে কারখানার বাইরে এনে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিক্রির একটা সুযোগ থেকেই যায়। অনেক সময় অনেক স্যাম্পলের মেয়াদ থাকে না। অথচ অজান্তে বা জেনেও বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। ফলে যে সব ঔষধ গ্রহণের ফলে নানা রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে এমনকি রোগী মৃত্যু ঝুঁকিতেও পড়তে পারেন। আমাদের দেশে আর একটি বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন ফার্মেসিতে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ঔষধ বিক্রি হয় যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নিষিদ্ধ এমনকি ফার্মেসিতে যারা ঔষধ ক্রয় বিক্রয় করেন তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা সার্টিফিকেট নেই এবং তারাও এই স্যাম্পল ঔষধ সংগ্রহের সাথে জড়িত বলে জানা যায়।সামান্য স্যাম্পল বিলির জন্য উচ্চ শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যবহার অপচয় এবং লজ্জাকর। বর্তমান বাজারে বেশ কিছু ভালো ভালো ওষুধ কোম্পানি আছে,যাদের মার্কেট পলিসিতে স্যাম্পল নামক কোনো বিষয় নেই।
অনেকে এই লেখা পড়ে ঔষধ কোম্পানি আর ডাক্তারদের মধ্যে বিভিন্ন রকম সম্পর্ক, লেনদেন, উপঢৌকন, বিদেশ ভ্রমণ, ইত্যাদি নিয়ে নানা কথা বলবেন। কিন্তু আমরা সব কিছু হয়তো একদিনে ঠিক করতে পারবো না। তবে স্যাম্পল নামক এই দুষ্ট প্রথা যদি দূর করতে পারি সেটাই বা কম কী? আমার বিশ্বাস বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ডাক্তারই স্যাম্পল (নমুনা) প্রথার বিপক্ষে। তাই ফিজিশিয়ান স্যাম্পল হিসেবে ঔষধ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা থেকে স্যাম্পল (নমুনা) নামক এই ব্যবস্থাটি চিরতরে বিলুপ্ত করতে হবে। তবে প্রোমোশনাল মেটেরিয়াল হিসেবে চিকিৎসকদের কলম, প্যাড, ডায়েরি, ক্যালেন্ডারসহ চিকিৎসাজনিত প্রয়োজনীয় কিছুসামগ্রী দেওয়া যেতে পারে।
পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বুঝা যায় যে, আইন করে ঔষধের স্যাম্পল বিলি নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে। ইতোমধ্যে সরকার ঔষধ ব্যবস্থাপত্র লেখার ক্ষেত্রে জেনেরিক নাম লিখার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে শুনা যাচ্ছে এবং সেটি কার্যকর হতেও অনেক সময় লাগবে আমরা যারা চিকিৎসা গ্রহণ করে তাদের তাই সেটির জন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন ক্যাম্পিং গ্রহণ কতে হবে। এবং মানহীন ঔষধ কোম্পানিগুলো চিহ্নিত করতে হবে যাতে এই জেনেরিক নামে প্রোডাক্ট বিক্রির কারণে ঐ সমস্ত কোম্পানিগুলো লাভবান না হয়।
এক সময় আমাদের দেশে কেমিষ্টরা ঔষধ কোম্পানিগুলোর কাজ করতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে শিক্ষা পদ্ধতিতে ফার্মেসি বিভাগ চালু করায় প্রতি বছর অনেক ফার্মাসিষ্ট তৈরী হচ্ছে। এবং যাদের ফার্মেসি কাউন্সিল কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হয়। কিন্তু পড়ালেখা শেষে তাদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চাকরির সংকটে আছে। তাই এই স্যাম্পল প্রথা বাতিল করে সেই সব ফার্মাসিস্টদেরকে ঔষধ বিপনন ব্যবস্থার কাজে লাগালে বেকার সংকটও ঘুচবে। কারন তারা প্রতিটি চিকিৎসককে তাদের ঔষধের গুনাগুন সম্বন্ধে তাদের লিটারেচর এর মাধ্যমে বুঝাতে পারবে। তাতে সময় একটু বেশি ব্যয় হলেও রোগী-চিকিৎসক এবং ঔষধ বিপনন কোম্পানিগুলো লাভবান হবে।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ