নিজস্ব প্রতিবেদক
দীর্ঘমেয়াদে দেশকে ‘গ্লোবাল ফ্যাক্টরি’ বা বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। তিনি বলেছেন, ‘র্দীঘমেয়াদে লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে আমরা গ্লোবাল ফ্যাক্টরি করতে চাই, ম্যানুফেকচারিং হাব করতে চাই। আমাদের জনসংখ্যার বড় অংশ হচ্ছে তরুণ। তাদের ব্যবসা করার জন্য বিনিয়োগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। সেজন্য আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরকে উন্নত করতে হবে। ঢাকাকে নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। ঢাকা বাংলাদেশের অফিসিয়াল ক্যাপিটাল, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রাম কিন্তু অনেক বেশি প্রমিনেন্ট (প্রসিদ্ধ)। ভৌগোলিকভাবে চট্টগ্রাম সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের লক্ষ্য সফল করতে হলে চট্টগ্রামকে সফল করতে হবে’।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে লালদিয়ার চরে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত টার্মিনাল প্রকল্প, বে-টার্মিনাল প্রকল্প এলাকা এবং বন্দরের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এলাকা পরিদর্শন করেন বিডা চেয়ারম্যান। এরপর বিকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘দেশের মোট শিল্প উৎপাদনের বড় অংশ চট্টগ্রামে হয়ে থাকে।এ বিভাগের ৩০-৪০ শতাংশ এলাকায় শিল্পায়ন হয়ে থাকে। আমরা সামনের দিনের বড় বড় প্রকল্পগুলোর কথা বলি বিশেষ করে চাইনিজ স্পেশাল ইকনোমিক জোন, সেটি চট্টগ্রামে। জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাইতে, আমরা আরেকটি ইকনোমিক জোন নিয়ে কথা বলছি সেটাও চট্টগ্রামে হবে। যেসব ম্যানুফেকচারিং পাওয়ার হাউসগুলোর কথা বলছি সেগুলো চট্টগ্রামে। বন্দরগুলোকে যদি আমরা সফল করতে না পারি, তাহলে এই মহাপরিকল্পনা ফেইল করবে। এজন্য চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জায়গা সীমাবদ্ধতার কারণে শতভাগ বেস্ট কোয়ালিটির বন্দর হিসেবে চালাতে না পারলে আমাদের লক্ষ্য পূরণ করা যাবে না’।
‘উচ্চাকাঙ্খার মধ্যমণি চট্টগ্রাম’
প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল এলাকা পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল পরিদর্শনে যান বিডা চেয়ারম্যান। সেখানে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘এই বাংলাদেশের ফুল অ্যাম্বিশনটার মধ্যমণি হচ্ছে চট্টগ্রাম। আমরা বাংলাদেশকে যেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা, ইকনোমিক্যালি চিন্তা করছি। সেটার সবচেয়ে সেন্টার পিস হচ্ছে গিয়ে চট্টগ্রাম। এবং চট্টগ্রামের এই সেন্টার পিসটার একটা অংশ আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি। এই পোর্টটা আরো এফিসিয়েন্ট হবে, সাথে আরো অনেকগুলা পোর্ট দাঁড়িয়ে যাবে। অ্যান্ড চিটাগাং উইল বিকাম বেসিক্যালি দি, দি ট্রু কমার্শিয়াল হাব। যেটা আমরা সবসময় বলে আসছি যে, ঢাকা হচ্ছে গিয়ে পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল, ঢাকা হচ্ছে গিয়ে আমাদের ফাইনান্সিয়াল ক্যাপিটাল। বাট আমাদের কমার্শিয়াল ক্যাপিটাল যেটা, সেটা হবে চট্টগ্রাম এবং এই ট্রেডের কারণেই হবে’।
বে টার্মিনালে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে
চট্টগ্রামের বন্দরগুলো উন্নত করলে বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বলে মনে করেন আশিক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি লালদিয়া টার্মিনাল এলাকায় গিয়েছি, সেখানে ৮০০ মিলিয়ন ডলার এফডিআই আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপর আমরা বে-টার্মিনালে গেলাম। সেখানে দুইটা অপারেটরের কথা বলা হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের এক বিলিয়ন ডলার করে ইনভেস্ট করার প্ল্যান আছে। এরপর আমরা এনসিটিতে গিয়েছিলাম, সেখানেও ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো কথাবার্তা হচ্ছে। এই যে আমরা ৩ বিলিয়ন ডলারের কথা বলছি, এটা হয়তো নেক্সট তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আসতে শুরু করবে, যদি আমরা সবকিছু সাকসেসফুলি করতে পারি। আমি ৩ বিলিয়ন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট পাচ্ছি শুধু পোর্টে। এছাড়া কর্মসংস্থানের জন্যও এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি পোর্টগুলো করতে পারি, শুধু বে-টার্মিনালেই ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে’।
বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘তাদের প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। সে প্রযুক্তিও আমাদের আসতে হবে। আমাদের বন্দরের শ্রমিকদের বিদেশি একটা কোম্পানি প্রশিক্ষিত করবে। দুবাইতে নিয়ে যাবে। বন্দর পরিচালনার গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড়, আমাদের শ্রমিকদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যদি একই স্কিলে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে গ্লোবাল অপারেটররা আমাদের দেশের শ্রমিকদের দিয়ে অন্য দেশের বন্দর পরিচালনা করাবে। এটা আমাদের লক্ষ্য’।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভিয়েতনামের তুলনা হাজির করে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভিয়েতনামের সাথে প্রতিযোগিতায় যাওয়া যাবে না। আমরা বেস্ট পোর্ট অপারেটর হতে চাই। আমরা ক্যাপাসিটিতে কোনোদিনই ভিয়েতনামের সাথে পারব না। কারণ তাদের ৪৪টি বন্দর রয়েছে। তাদের হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি হচ্ছে ৪৭ মিলিয়ন টিইইউএস, সেখানে আমাদের হচ্ছে ১ দশমিক ২৯ মিলিয়ন টিইইউএস। আমাদের সবগুলো পোর্ট চালু হবার পরেও হবে ৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন। এটা যখন হবে, তখন আমাদের দক্ষতার সঙ্গে বন্দর পরিচালনা করতে হবে। নাহলে আমরা প্রতিযোগিতা করতে পারব না’।
চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল ২০৩০ সালে চালুর আশা প্রকাশ করে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘সেখানে ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে, ইনডিরেক্ট এটার সাথে আরো অনেক আসবে। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা এডিশনাল এই চিটাগং শহর, এই এলাকায় এসে থাকা শুরু করবে, এই এলাকায় কাজ করবে। তো তাদের বাসস্থান, চিকিৎসা, যাতায়াতের ব্যবস্থা এবং তাদের ফ্যামিলির এডুকেশনের যে পার্টটা, এই পুরো প্ল্যানিংটাও আমাদেরকে আসলে ওভারঅল পিকচারের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। সেটা একটা মাস্টার প্রজেক্ট, দ্যাট উই অলসো নিড টু কিপ ইন আওয়ার মাইন্ড’।
বে টার্মিনালে চারটি টার্মিনাল করার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমাদের তিনটা অ্যাপ্রুভ হয়েছে। টার্মিনাল ওয়ান- যেটা পিএসএ সিঙ্গাপুর করবে। টার্মিনাল টু- যেটা ডিপি ওয়ার্ল্ড করবে এবং টার্মিনাল থ্রি আমরা ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে করব, যারা কম্পিট করে আসতে পারে। আরেকটা টার্মিনাল- এনার্জি টার্মিনাল, ওটা প্ল্যানে রেখেছি। এটা ভবিষ্যতে আমরা স্টাডি করে তারপরে এটা আমরা হয়তো বাস্তবায়ন করব। তো সামগ্রিকভাবে এখান থেকে আমাদের যে ক্যাপাসিটি, প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুটের দৈর্ঘ্যরে কন্টেইনারকে একক ধরে) ইজিলি করতে পারব। এতে এটা হয়তো ৪.৫ এর উপরেও চলে যাবে, যদি আমরা এখানে আরো অফ ডক অন্যান্য ফ্যাসিলিটিসগুলা করতে পারি এবং এটার যে মডেল কানেকটিভিটি, এগুলা যদি করতে পারি’।
চলতি বছরের শেষ দিকে বে টার্মিনালের কাজ শুরুর আশাবাদ ব্যক্ত করেন বন্দর চেয়ারম্যান।
‘১০ বছরে গ্লোবাল ম্যানুফেকচারিং হাব’
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে আশিক চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ গেøাবাল ম্যানুফেকচারিং হাব হতে ইনিশিয়াল জার্নি আগামি ১০ বছরের। বন্দরের জার্নিটা পরবর্তী পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে শেষ হবে। ২০৩০-৩১ সাল নাগাদ চট্টগ্রামের যে কয়টা বন্দর আছে, সেগুলো চালু হয়ে যাবার কথা। আমরা সেভেন প্লাস মিলিয়ন টিইইউএস হ্যান্ডলিংয়ের কথা বলছি সে সক্ষমতা ২০৩০-৩১ নাগাদ হয়ে যাবার কথা। তার পাশাপাশি ইকনোমিক জোনগুলো যদি সময়মত ডেভেলপ করতে থাকে, তাহলে আমরা পরবর্তী কয়েক বছরে অগ্রগতি দেখতে পাব’।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কী, এ প্রশ্নে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘ফাংশনালি চিন্তা করলে প্রথম লেবার, দ্বিতীয় ল্যান্ড। ইকনোমিক জোনে যেহেতু জমি দেওয়া শুরু করেছি, একসময় জমি সমস্যা ছিল, পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা আমরা মোটামুটি একটা স্ট্রাকচারে নিয়ে আসছি। এর পরেরটা হচ্ছে ইউটিলিটি সার্ভিসেস ও অবকাঠামো। এ জায়গায় আমরা একটু পিছিয়ে। গ্যাসের কানেকশান নাই, এটা নাই, ওটা নাই। এসব যেগুলো দেওয়ার কথা সেসবের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। এটা সামনে যাবার ক্ষেত্রে একটা বিষয়’।
এক দিন আগে এক বিনিয়োগকারী সঙ্গে বৈঠকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গতকালকে (বুধবার) বিডা বা বেজার সঙ্গে একজন চাইনিজ বিনিয়োগকারী দেখা করে কথা বলেছেন। উনার সঙ্গে আরও তিনজন সাপ্লাইয়ার আছেন। উনারা সবাই জায়গা চান আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে জায়গা আমি উনাকে দিব, উনি কনস্ট্রাকশন শুরু করার ১২ মাসের মধ্যে উৎপাদনে যেতে চান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, রাস্তাসহ ১০০ একর জমি দিতে পারি- এরকম জায়গা খুব বেশি আপনি বাংলাদেশে দিতে পারবেন না। এ মুহূর্তে সরকারের কাছে নাই। একজন বিনিয়োগকারী আসছেন, কিন্তু তাকে আমরা একটা লোকেশন দিতে পারছি না। এটা আমার দেখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ’।
বাজেট নিয়ে বিডা চেয়ারম্যানের প্রত্যাশা
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘অর্থ উপদেষ্টা এবারে একটা প্র্যাকটিক্যাল বাজেট দেবেন আশা করি। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে একটি বড় বাজেট করা কঠিন। এবারে একটি প্রেগমেটিক বাজেট আপনার দেখতে পাবেন’।
এবারের বাজেটে বৈদেশিক সাহায্য ‘যতটুকু সম্ভব’ কমিয়ে আনার কথা হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কারণ আপনি অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য বাইরের থেকে লোন নেন সেটা ভালো। কিন্তু নিজে চলার জন্য যদি আমি বাইরে থেকে লোন নিয়ে নিই, আমাদের যতটুকু রাজস্ব আদায় হয় তার একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। ক্রমাগত আমরা যদি ধার করে করে খরচ করতে থাকি সেটা ঠিক না। একটা মডেল বাজেট করার জন্য চেষ্টা থাকবে, যাতে চর্চাটা ভবিষ্যতে পলিটিক্যাল গভর্নমেন্টের সময়েও হয়’।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ তালুকদার, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।