বাঁশখালী বেড়িবাঁধ যেন পাউবোর ‘খেলার পুতুল’

2

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাঁশখালী-আনোয়ারা উপকূলে নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি গত বছরের ২৮ মে অনুমোদন হয়। প্রকল্পটি বাঁশখালীর অংশের কাজ বাস্তবায়নে কার্যাদেশ পেয়েছে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে প্রকল্পের এক বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কার্যাদেশ পাওয়া একজন ঠিকাদার প্রাথমিক কাজ শুরু করলেও বাকি দুই ঠিকাদার এখনো কাজই শুরু করেনি। তবে কাজ শুরু করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিডিএলের বিরুদ্ধে পাথর ব্লক নির্মাণে লবণাক্ত বালি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এ প্রতিষ্ঠানকে গতকাল ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়াও অন্য দুই ঠিকাদার কাজ শুরু না করায় ২০২৭ সালের জুনে মেয়াদকালীন সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঠিকাদার যেন কাজ শুরু করে সেজন্য গত ১৬ অক্টোবর তাগাদাপত্র দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘তিনজন ঠিকাদারের মধ্যে পিডিএল কাজ শুরু করেছে। বাকি দুইজন ঠিকাদার এখনো কাজ শুরু করেনি। তাদেরকে দ্রুত সময়ে কাজ শুরু করতে চিঠি দিয়েছি। এরপরেও কাজ শুরুতে সময়ক্ষেপন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
স্থানীয়রা বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছর ধরেই আলোচনায় বাঁশখালী বেড়িবাঁধ। বিভিন্ন সময়ে জরুরি মেরামতের নামে অর্থ তছরুপ হয়েছে। এছাড়াও ২৯৩ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের কাজ ছয় বছর পর শেষ হলেও তা নির্মাণের দুই বছরেই ভেঙে গেছে। প্রতিবছর এত এত টাকা বরাদ্দ হলেও বাঁশখালী উপকূলের মানুষের দীর্ঘশ্বাস কাটেনি। এ জনপদের ৩৬ কিলোমিটার উপকূল যেন পানি বোর্ডের ‘খেলার পুতুল’। নতুন অনুমোদিত বড় প্রকল্পের কাজ এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। এতে চলমান প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অথচ নতুন প্রকল্পটি ঘিরে উপকূলীয় মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। এরমধ্যে ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বিগত প্রকল্পের মতো এই প্রকল্প ঘিরেও দিন দিন অনিশ্চয়তা বাড়ছে। যা নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ঝারছেন।
পাউবো সূত্র জানায়, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলায় টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্পে আনোয়ারা অংশে ৩৬৫ কোটি টাকা ও বাঁশখালী অংশে ৫০৯ কোটি টাকা মিলিয়ে ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের আওতায় বাঁশখালীর বাহারচড়ায় এক হাজার মিটার, খানখানাবাদে এক হাজার ৩১০ মিটার, ছনুয়ায় দুইহাজার ৮০০ মিটার, সাধনপুরে এক হাজার ১০০ মিটার, পুরাতন বাঁধ শক্তিশালীকরণে এক হাজার ৩০০ মিটার সমুদ্র তীর প্রতিরক্ষা ও সাঙ্গু নদী তীর রক্ষা কাজ হবে। এরমধ্যে খানখানাবাদ, ছনুয়া ও সাধনপুর অংশের ৭০ শতাংশ কাজ পেয়েছে প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (পিডিএল)। খানখানাবাদ ও বাহারছড়ায় কাজ পেয়েছে হাসান এন্ড ব্রাদার্স। জামিল ইকবাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানও কিছু কাজ পেয়েছে। কিন্তু পিডিএল ছাড়া বাকি দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো কাজ শুরু করেনি। ঠিকাদার হাসান এন্ড ব্রাদার্স ২০২৩ সালে শেষ হওয়া ২৯৩ কোটি টাকার প্রকল্পের বৃহৎ কাজ করেছিল। বিতর্কিত এই ঠিকাদারকে এবারও কাজ দেয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয়রা।
খানখানাবাদ এলাকার বাসিন্দা শাহেদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে পানি বোর্ডকে হার্ডলাইনে থাকতে হবে। বিগত প্রকল্পে অনিয়ম করা একজন ঠিকাদারকে এবারও কাজ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা আগের মতো অনিয়মের কাজ চাই না। ইতোমধ্যে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। কোন কারণে পাউবো ও ঠিকাদারের যোগসাজশে কাজের অনিয়ম হলে এবার মানুষ রাস্তায় নামবে। এক বছর চলে গেলেও দুই ঠিকাদার কাজ শুরু না করাটা দুঃখজনক। প্রকৃতপক্ষে গত দশ বছরে বাঁশখালী উপকূলে কত টাকার কাজ হয়েছে তা দুদক তদন্ত করলে সব দুর্নীতি বের হবে।’
বাঁশখালী পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী লিটন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘ঠিকাদাররা কাজে নামতে চাইলেও স্থানীয়রা বাধা দিচ্ছেন। যে কারণে যথাসময়ে ঠিকাদার কাজ শুরু করেনি। তাদেরকে কেউ জায়গা দিচ্ছে না। জায়গা না দিলে মালামাল রাখবে কোথায়। এসব জটিলতার কারণেই কাজ করতে পারছেনা ঠিকাদার।’
কাজে কারা বাধা দিচ্ছে এমন প্রশ্নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসান এন্ড ব্রাদার্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘কেউ আমাদের বাধা দেয়নি। দ্রুতসময়ে আমরা কাজ শুরু করবো।’

পিডিএলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা : বাঁশখালীতে কার্যাদেশ পাওয়া তিন ঠিকাদারের মধ্যে একমাত্র কাজ শুরু করেছে প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (পিডিএল)। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্লক নির্মাণে লবণাক্ত বালি ব্যবহার করছে এমন অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় সাগর থেকে বালি উত্তোলন করার অভিযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিডিএলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে এবং মুচলেকা নিয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওমর সানী আকন। গতকাল সকাল ১০টায় খানখানাবাদ নতুন বাজার এলাকায়এ অভিযান চালানো হয়।
বাঁশখালীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওমর সানী আকন পূর্বদেশকে বলেন, ‘বাঁশখালী উপক‚লে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিডিএল সাগর থেকে বালি উত্তোলন করছে এমন অভিযোগে অভিযান চালানো হয়। এ বালি দিয়ে পাথর ব্লক নির্মাণ করছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে পাউবো প্রতিনিধি, ঠিকাদার প্রতিনিধি, স্থানীয় চেয়ারম্যান তলব করা হয়। এসময় দোষ স্বীকার করায় পিডিএলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও মুচলেকা আদায় করা হয়।’