বাঁশখালীর ‘স্বপ্নের’ বেড়িবাঁধে বড় ধস

117

মেয়াদ ও ব্যয় বেড়েছে কয়েক দফা। তবুও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেননি ঠিকাদার। এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন জটিলতা। সরে যাচ্ছে বাঁধের মাটি। কয়েকদফা পানির তোড়ে সারি ভেঙে এলোমেলো পাথর ব্লক। দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাঁধে বড়ধরনের ধস দেখা দিয়েছে। আবার কোনো অংশে বসানো ব্লকের সিমেন্ট-বালু সরে নুড়ি পাথর ভেসে উঠেছে। বাঁশখালী উপকূলের ছনুয়া ও খানখানাবাদে নির্মাণাধীন ‘স্বপ্নের’ বাঁধটি যেন গড়ার আগেই ভাঙছে।
উপকূলবাসীর অভিযোগ, নিম্নমানের কাজের প্রভাব ইতোমধ্যে টের পাচ্ছেন তারা। প্রেমাশিয়ায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছনুয়ায় পাথর ব্লক ক্ষয়ে গেছে। দেশের সব বড় প্রকল্পে যেভাবে অন্যান্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ থাকে এখানে সেটি নাই। যার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন পাউবো কর্মকর্তারা। দুদক এ কাজের খুঁটিনাটি বের করলে সব গরমিল ধরা পড়বে। ঠিকাদারের সাথে যোগসাজশ করে যেনতেনভাবে কাজ করছে পাউবো। একদিকে বছরের পর বছর যাচ্ছে অন্যদিকে বাঁধের স্থায়িত্ব কমছে। অথচ এখনো কাজই শেষ করতে পারেনি তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অপুদেব পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এখনো প্রকল্প এলাকায় যাইনি। যে অভিযোগগুলো পাওয়া যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখবো। আপনার কাছ থেকে যেসব শুনেছি সে বিষয়ে খোঁজখবর নিব।’
পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী মঞ্জুরুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘স্থায়ী বেড়িবাঁধের পাশাপাশি জরুরি কিছু কাজ চলমান আছে। ছনুয়ায় দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবারো কাজ শুরু করছে। বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়েছে চার বছর আগে। এ সময়ের মধ্যে সেখানে যে ব্লকগুলো নষ্ট হয়েছে সেগুলো লবণাক্ত পানির কারণেই হয়েছে। খানখানাবাদে নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এরমধ্যে যেসব স্থানে ব্লক ধসে পড়েছে সেখানে আবারো রিপেয়ারিং করা হবে। ডাম্পিংও বাড়ানো হচ্ছে।’
খানখানাবাদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক আবু পূর্বদেশকে বলেন, ‘খানখানাবাদের ৭নং ওয়ার্ডের অর্ধেক ও ৩নং ওয়ার্ডের অর্ধেক বাঁধের প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত গাইডওয়াল ভেঙে পড়েছে। সেখানে বসানো ব্লকগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। বাঁধে দেয়া মাটি ব্যবহারে সঠিক নিয়ম মানা হয়নি। যে কারণে জোয়ারের সময় পানির তোড়ে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বাঁধটি আবারো সংস্কার করার কথা বলা হচ্ছে। কাজ হলেও মান সঠিক কতটুকু থাকবে তা নিয়ে আমরা সন্দিহান।’
খানখানাবাদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গাজী সিরাজুল মোস্তফা পূর্বদেশকে বলেন, ‘বিচারপতির বাড়ির পাশে দক্ষিণ অংশে কাজ শেষ না করেই ঠিকাদার চলে গেছে। কালাগাজী পাড়া এলাকা দিয়ে আমবস্যা-পূর্ণিমায় পানি ঢুকছে।’
খানখানাবাদ বাজার এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘মহল্লা পাড়ায় কাজের মান খুব খারাপ। এমন নিম্নমানের কাজে উপকূল রক্ষা পাবে না। কয়েক বছর পর ধসে যাবে পুরো বাঁধ।’
ছনুয়া ঘাট এলাকার বাসিন্দা মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘মাত্র এক বছর আগে বসানো ব্লকের সিমেন্ট ক্ষয়ে ভেতরের ছোট পাথর ভেসে উঠেছে। এসব নিম্নমানের ব্লক বসানো হলেও এ বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে থাকবে না। এছাড়াও মাটির বাঁধের বেশ কিছু অংশে ধসে গেছে। এখানের রাজনৈতিক নেতারা কাজ আদায়ে মন না দিয়ে লুটপাট বেশি করে। ঠিকাদারের সাথেও অনেকের সম্পর্ক ভালো থাকায় সবাই চুপ থাকে।’
পাউবো সূত্র জানায়, ২০১১-১২ সালের প্রকল্পের মূল জরিপ হয়। ২০১৩ সালে বাঁধের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে ২০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। পরে নির্মাণ সামগ্রী দাম বাড়া ও ঠিকাদারদের আপত্তির মুখে ২০১৫ সালে বাঁধ নির্মাণে ২৫১ কোটি ২৯ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকার অনুমোদন দেয় সরকার। পরে এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি টাকা।
বাঁশখালী উপজেলার পোল্ডার নং-৬৪/১এ, ৬৪/১বি এবং ৬৪/১সি এর সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথমদিকে ২০১৮ সালের ৩০জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কাল ধরা হয়। পরবর্তীতে কয়েকদফা মেয়াদ বাড়িয়ে তা ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে ঢাল সংরক্ষণসহ বাঁধ নির্মাণ ৯.৯০০ কিলোমিটার, নদী তীর সংরক্ষণ কাজ ৩.৮৪৮ কিলোমিটার, বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ ২ কিলোমিটার। ৩৪ প্যাকেজে কাজ শুরু করে ঠিকাদার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হাছান এন্ড ব্রাদার্স ২০টি প্যাকেজ, মেসার্স মশিউর রহমান আটটি প্যাকেজ, মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ দুটি প্যাকেজ, মোস্তফা এন্ড সন্স দুটি প্যাকেজ, নিয়াজ ট্রেডার্স একটি প্যাকেজ, আলম এন্ড ব্রাদার্স একটি প্যাকেজের কার্যাদেশ পেয়েছে। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে খানখানাবাদে চার হাজার ৫০০ মিটার, ছনুয়ায় তিন হাজার ২০০ মিটার, সাধনপুরে দুই হাজার ৭৯ মিটার, পুকুরিয়ায় এক হাজার ২৬৯ মিটার, গন্ডামারায় ৯০০ মিটার কাজ শুরু হয়।