বাঁশখালীতে ৩৩ বছর পর বালক স্কুলে বালিকা

170

বাঁশখালীতে ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। মহিলাদের শিক্ষাবিস্তারে উপজেলা সদরেই ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বাঁশখালী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বালক ও বালিকাদের পৃথক লেখাপড়ার সুবিধার্থে বিদ্যালয় দুটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমাজহিতৈষী ব্যক্তিরা। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র-ছাত্রীরা পৃথকভাবে শিক্ষগ্রহণ করলেও বালিকা বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তি না করায় বালক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছে বালিকারা।
বাঁশখালী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ায় এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। অন্যদিকে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা ভর্তি হওয়ায় বাড়তি শিক্ষার্থীর চাপে আছে বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আমিরুল কায়ছার পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রতিটি স্কুলের অনুমোদিত সেকশন আছে। প্রতি সেকশনে যে ক্যাপাসিটি সেটি বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত। এই মুহূর্তে কোন স্কুলে কত ক্যাপাসিটি আছে সে বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নাই। এটা অনুমোদন দেয়া আছে। অনুমোদন ছাড়া সেকশন খুলতে পারে না। যতটুকু অনুমোদিত আছে ততটুকু। এরচেয়ে বেশি ভর্তি করার সুযোগ নেই। তবে জাতীয়করণের আগে যে ক্যাপাসিটি ছিল সেটা পরিবর্তন হয়নি। এটাই নির্ধারিত। সবই আগের মতো থাকবে, স্কুল শুধু সরকারি হবে। অনেক স্কুল প্রতিবছর সেকশন বাড়াতে কমাতে আবেদন করে। নিজেদের সুবিধার্থে একেক স্কুল একেক সময় ক্যাপাসিটি বাড়ানোর কাজ করছে।’
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক আলী আকবর পূর্বদেশকে বলেন, ‘এটাতো আমরা জানি না। ডিসি, জেলা শিক্ষা অফিস ও স্থানীয় প্রশাসন ভালো জানবেন।’
দক্ষিণ জলদী এলাকার অভিভাবক সরোয়ার আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘সরকারি স্কুলে মেয়েকে পড়াবো বলে অনেক আশা করেছিলাম। কিন্তু ভর্তি করাতে পারি নাই। যে কারণে অন্য স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হয়েছি। শুনেছি, বালিকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভালোমানের শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্কুলে রেখে লেখাপড়ায় দুর্বল শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা থেকে বিরত রয়েছে।
বাঁশখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনতোষ দাশ পূর্বদেশকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ে এখন প্রায় ১৭০০ শিক্ষার্থী আছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবার ২৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। সপ্তম শ্রেণিতে ৪৫০ জন, অষ্টম শ্রেণিতেও একই সংখ্যক হবে।’ গত বছরের তুলনায় এ বছর শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে শিক্ষাবোর্ড থেকে ১৬০ জন নিতে বলেছিল। আমি জাতীয়করণের প্রথম বছর রেজুলেশন করে আরো কিছু বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছি। প্রতি সেকশনে এখন ৮০ জন করে ভর্তি করিয়েছি। আনোয়ারা, রাউজানে আরো কম ভর্তি হয়েছে। ভর্তি হতে না পেরে বাকি শিক্ষার্থীরা অন্য স্কুলে গেছে। ছাত্রী কমে যাওয়ায় স্কুলের আয়ও কমে গেছে। সামনে আরো কমে যাবে। আগামীতে শহরের সরকারি স্কুলগুলোর মতো পূর্ণাঙ্গভাবে সরকারি নীতিমালায় চলে যাবো।
সূত্র জানায়, বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৮০০ শিক্ষার্থী আছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে বিদ্যালয়টিতে ছাত্রী ভর্তি শুরু হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১৩৭ জন, সপ্তম শ্রেণিতে ৪৯ জন, অষ্টম শ্রেণিতে ৪৯ জন, নবম শ্রেণীতে চারজন ও দশম শ্রেণিতে চারজন মহিলা ছাত্রী লেখাপড়া করছে।
বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানান, ‘এমনিতেই বিদ্যালয়ে ছাত্র বেশি। গত তিনবছর ধরে ছাত্রী ভর্তি করানো হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীর চাপ বাড়ছে। কিছুদিনের মধ্যে বিদ্যালয়ের একটি ভবন ভেঙে ফেলা হবে। তখন শ্রেণিকক্ষ সংকটে পড়তে হবে আমাদের। চলতি শিক্ষাবর্ষে তিন গ্রুপে ছাত্র-ছাত্রী মিলিয়ে ৪৭৫ জন ভর্তি করা হয়েছে। যেখানে এক গ্রুপে ৭০ জনের অধিক শিক্ষার্থী রাখার নিয়ম নেই।’
বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমিত্র সেন বড়–য়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘একটা সময় আমাদের স্কুলে মেয়েরাও পড়তো। বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কম হওয়ায় স্কুলটি টিকিয়ে রাখতে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন ইউএনও আমাদের স্কুলে বালিকা ভর্তি বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে কখনো বালিকারা ভর্তি হয়নি। বালিকা বিদ্যালয় সরকারি হওয়ার পর থেকে আমাদের স্কুলে ছাত্রী ভর্তি করাতে বাধ্য হচ্ছি। এখন স্কুলের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকায় শিক্ষার্থীদের চাপ বেড়েছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে চারটি ভবন আছে। এরমধ্যে একটি ভবন নতুন করা হয়েছে। বাকি তিনটি পুরাতন ও জরাজীর্ণ। এসব ভবনের প্রত্যেকটিতেই শ্রেণিকক্ষ আছে। সপ্তম শ্রেণির ক্লাসের একপাশে ছাত্রী অন্যপাশে ছাত্র বসানো হয়েছে। ছাত্ররা সাদা শার্টে স্কুল পোশাকে ক্লাস করলেও ছাত্রীরা পরে বেগুনি ও গোলাপী রঙের দুইরকম পোশাক। একইভাবে নবম শ্রেণিতে ৭০ জনের অধিক ছাত্রের সাথে বসে ক্লাস করছে মাত্র একজন ছাত্রী। সামনের একটি টেবিলেই মেয়েটি একা পড়ালেখায় মগ্ন আছে।
রহুল্লা পাড়া এলাকা থেকে আসা আফরিন আক্তার নামে নবম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থী পূর্বদেশকে বলে, ‘বাবার চাকরি সূত্রে ফৌজদারহাট কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে এই বিদ্যালয়ে। বালক বিদ্যালয়ে বালিকা ভর্তি করানো হচ্ছে জেনে বাবা কাছের এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। শিক্ষক ও সহপাঠীরা ভালো আচরণ করায় কোনো অসুবিধা হয় না। তবে ক্লাসের সবাই ছাত্রী থাকলে আমার আরো বেশি ভালো লাগতো।’ ‘এখন একটু মানসিকভাবে দুর্বল লাগে।’
বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে বাড়ি হলেও প্রায় এক কিলোমিটার দূরের বালক বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস করছে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসা ছগীর। সে জানায়, ওই স্কুলে ভর্তি হতে না পেরে এ স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তবে আমার ভাইও এই স্কুলে পড়ার কারণে তেমন সমস্যা হয় না। ভাই-বোন একসাথেই স্কুলে আসি। আরেক শিক্ষার্থী জানালো, ‘এক বোন বালিকা বিদ্যালয়ে, সে পড়ে বালক বিদ্যালয়ে।’
বাঁশখালী পৌরসভার দুইজন অভিভাবক ও একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘ছাত্র-ছাত্রী একসাথে পড়ার বিষয়টি ইতিবাচক। আগামীতে বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ব্যাপক ছাত্রী ভর্তি হলে এমন ব্যতিক্রম আর চোখে পড়বে না। এজন্য স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। একইভাবে সরকারি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া থেকে বালকরা যে বঞ্চিত হচ্ছে সেটিও কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে হবে।’