বলিরহাট জেলেপল্লীর কান্না থামছে না

1

এম এ হোসাইন

কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বলিরহাট জেলেপাড়ার বাসিন্দাদের জীবন আজ অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলছে। বংশ পরম্পরা মাছ ধরাই যাদের একমাত্র জীবিকা, তাদের ওপর নেমে এসেছে এক কঠিন বাস্তবতা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) লিংক রোড প্রকল্পের কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে এই জেলেপাড়ার বহু ঘরবাড়ি, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের শেষ আশ্রয়টুকুও। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও মেলেনি কোন ক্ষতিপূরণ, ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অন্তত ৩৯টি পরিবার।
সিডিএ’র বাস্তবায়নাধীন লিংক রোড প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে জেলেপাড়ার অনেকের স্থাপনা ভাঙা হয়েছে। ঘরবাড়ি ও বসতভিটা অধিগ্রহণে পড়েছে। সিডিএ ইতিমধ্যে সেখানে রাস্তার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু জেলেপাড়ার বাসিন্দারা তাদের অধিগ্রহণের টাকা পাননি। কখন পাবেন, সেটা নিয়েও সন্দেহের মধ্যে আছেন তারা। এ অবস্থায় তাদের ঠাঁই কোথায় হবে, সেটা নিয়ে অস্থির অবস্থায় আছেন তারা। টাকার জন্য সিডিএতে ধরনা দিয়েও তারা পায়নি স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ও ভূমি অধিগ্রহণের টাকা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়েও পাননি কোনো সুরাহা। এমন সময় জেলেদের পাশে এসে দাঁড়ান সাবেক কাউন্সিলর প্রার্থী ও নগর যুবদলের সাবেক সাহিত্য সম্পাদক আজিজুল হক মাসুম। স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে গতকাল রবিবার দুপুরে সিডিএ চেয়ারম্যানের কাছে যান তিনি।
আজিজুল হক মাসুম বলেন, জেলেপাড়ার বাসিন্দারা অনেক কষ্টে টিকে আছেন। তাদের অনেকের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন কেটে গেল, পাচ্ছেন না ভূমি অধিগ্রহণের টাকা। তারা কোথাও ঠাঁই নেবেন? এসব বিষয় সিডিএ চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানিয়েছি, তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন দুই মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান করবেন।
জেলেপাড়ার বাসিন্দা রাজ কুমার বলেন, আমরা বংশ পরম্পরা এখানে বাস করছি। মাছ ধরাই আমাদের একমাত্র পেশা। সিডিএ আমাদের জায়গা অধিগ্রহণ করেছে ৮ বছর আগে। এখনও আমরা ক্ষতিপূরণ পাইনি। আমাদের ৩৯টি পরিবার ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ঘুরছি। অথচ গত আট বছরে জায়গার দাম অনেক বেড়ে গেছে। এখন আমরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার পরও অন্য জায়গায় ঘর করতে পারব কি না, জানি না।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর বাস্তবায়নাধীন দ্বিতীয় আউটার রিং রোড প্রকল্প। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। নগরীর কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত বিস্তৃত বাঁধ কাম সড়কটির প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নগরীর যান চলাচলে গতি আনা, অনুন্নত থাকা বিস্তৃত এলাকার জীবনমান উন্নয়ন, পর্যটন এবং আবাসনসহ সার্বিক ক্ষেত্রে এই শহররক্ষা বাঁধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাঁধের ১২টি স্লুইসগেট নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখবে।
এ বিষয়ে সিডিএর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম বলেন, বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। আমি ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছি। আগামী দুই মাসের মধ্যে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কোন ধরনের হয়রানি ছাড়াই তারা টাকা পাবেন। যদি মামলা বা মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যা না থাকে, তাহলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা টাকা পেয়ে যাবেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার ৪ লেনের সড়ক-কাম শহর রক্ষা বাঁধে বর্ষায় নগরীর পানি নিষ্কাশনের জন্য ১২টি স্লুইসগেট রয়েছে। এসব স্লুইসগেটে পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্প স্থাপন করা হবে। ১২টি স্লুইসগেটের মধ্যে দশটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। গেটগুলো অস্থায়ীভাবে চালু করা হয়েছে। নগরীর বিস্তৃত এলাকার জলাবদ্ধতা সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে স্থাপিত স্লুইসগেটগুলো জোয়ারের পানি ঠেকানোর পাশাপাশি ভেতরের বৃষ্টির পানি পাম্পের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হবে। এসব স্লুইসগেটে ইউরোপ থেকে আনা বিশেষ ধরনের মরিচা প্রতিরোধক স্টিলের গেট স্থাপন করা হয়েছে।
নগরীতে যানবাহনের চাপ কমানোসহ নানা লক্ষ্য নিয়ে নগরীর কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু সংলগ্ন চাক্তাই খালের মুখ থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ-কাম সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি চট্টগ্রামের দ্বিতীয় আউটার রিং রোড। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২১ জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিসহ নানা প্রতিক‚লতায় নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ শেষ করতে পারেনি সিডিএ। ইতিমধ্যে তিন দফা সময় বাড়িয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা থাকলেও বিভিন্ন ধরনের কাজ বাড়ায় ইতিমধ্যে প্রকল্প ব্যয় ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব দাশ বলেন, জেলেপাড়ার ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা আছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত আছেন, তারা সবাই টাকা পাবেন। মাঝখানে টাকা ছাড়করণের সমস্যার কারণে ধীরগতিতে অধিগ্রহণের কাজ চলছিল। এখন আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করতে পারব বলে আশা করছি। যাদের বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে, তাদের টাকা দ্রুত দেওয়ার চিন্তা করছি।
তিনি বলেন, শহরের জন্য প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি যান চলাচলে প্রত্যাশিত গতি আনবে। শহররক্ষা বাঁধ এবং জলাবদ্ধতা নিরসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পর্যটন, আবাসন এবং শিল্পায়নে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করা প্রকল্পটি এলাকার জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অবদান রাখতে শুরু করেছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে বাকলিয়া, চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে যেবে। সড়কটি নির্মাণের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে কালুরঘাট থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করা যাবে। এই সড়ক ঘেঁষে চান্দগাঁও হামিদচরে নির্মিত হচ্ছে দেশের একমাত্র মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকার দিকে একটি সংযোগ সড়ক রাখা হয়েছে। ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যানবাহন আউটার রিং রোড দিয়ে কালুরঘাট এলাকায় পৌঁছার সুযোগের ফলে নগরীতে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। তারা কি আদৌ ক্ষতিপূরণ পাবে, নাকি শুধু আশ্বাসের বৃত্তেই আটকে থাকবে, এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে কর্ণফুলীর তীরে।