বর্ষায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধের উদ্যোগ নিন

2

মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী

বৃষ্টি নামলেই আতঙ্ক বাড়ে নগরীতে। একদিকে পাহাড়ধস অন্যদিকে জলাবদ্ধতার দুশ্চিন্তা ভর করে নগরবাসীর মনে {সূত্র; দৈ/পূর্বদেশ,৩১ মে’২৫}। অতীব পরিতাপের বিষয়, বর্ষাকাল এলেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর যেন ঘুম ভাঙ্গে। তাঁদের করণীয় কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে অতি ব্যস্ত এবং তৎপর হয়ে উঠে অথচ সারাটা বছর তাঁরা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ এবং তাঁদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা বা এ-সংক্রান্ত কোনোকার্যক্রমই দৃশ্যমান হয় না। এমতাবস্থায়, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পাদদেশ থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে দিলেও বর্ষকালেই এবং বর্ষা পরবর্তীকালে তাঁরা আবার ফিরে আসে সেই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পাদদেশে বসবাসের জন্য শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তদারকি, নজরদারী, এবং জোড়ালো সমন্বিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে। চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে ২৬টি পাহাড়। এসব পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অন্তত ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবার। পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস না করা, পাহাড় কর্তন না করা, পাহাড়ের ক্ষতি না করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়। লাগানো হয় সাইনবোর্ডও। কিন্তু সেগুলোতে কেউ কর্ণপাত করে বলে মনে হয় না। ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা এলাকার পরিমাণ ছিল ৬৭৯ হেক্টর। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার হেক্টরে। জানা যায়, অবৈধ পাহাড়ে যারা বসবাস করছেন, তারা বৈধভাবেই ভোগ করছেন পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব সুযোগ-সুবিধা। প্রতি বছরই চট্টগ্রামে বৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই শুরু হয় পাহাড়ে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরানোর কাজ। পরিচালিত হয় উচ্ছেদ অভিযানও। কিন্তু দুর্যোগ শেষে সবকিছু আবারও স্বাভাবিক হয়ে গেলে মানুষও আবার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতেই বসবাস শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন পাহাড়গুলোতে অবৈধভাবে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে খুঁটি স্থাপন করেই নেওয়া হয় বিদ্যুতের লাইন। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিটি সভায় সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কার্যত তা বাস্তবায়িত হয় না।বিভিন্ন সংযোগ পুনঃসংযোগ প্রদান না করার কঠোর হুঁশিয়ারি নিয়ে সংস্থাগুলো পারস্পরিক দোষারোপে ব্যস্ত কিতু কেউ দায়-দায়িত্ব নিতে চায়না। অনেকটা যেন আসমানী সংযোগ হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড: মো. জিয়াউদ্দিন বলেন, নগরীর ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থ বা বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি। শুধু চট্টগ্রাম রেলওয়ের জায়গায় অবৈধভাবে বসবাস করা পরিবারগুলোতেই রয়েছে ৫ হাজার ৩০০ অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইন। কর্তৃপক্ষ যদি কাউকে বন্দোবস্ত না দেয়, তাহলে সেখানকার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করা হবে। বর্তমানে আবহাওয়ার পরিস্থিতি ভালো নয়।জুনের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত,অন্তত তিনবার শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জুন মাস জুড়ে রয়েছে ভারি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে পাহাড়ধসের শঙ্কা। তাই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা পরিবারগুলোকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র সরিয়ে আনতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, নগরীতে গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযানে উচ্ছেদ করা হয়েছে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা ৫১টি পরিবারকে।এক সূত্র থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে সবচেয়ে বেশিপ্রায় ৪ হাজার ৪৭৬ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। পাশপাশি নগরীর মতিঝর্ণা ও বাটালীহিল পাহাড়ে বসবাস ৪৩১ পরিবারের। এ ছাড়া কৈবল্যাধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ে ১৪৬ পরিবার, পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশ ১২ পরিবার, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে পাঁচ পরিবার, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪ পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬ পরিবার, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে ২৮৮ পরিবার, আমিন জুট মিলস কলোনি সংলগ্ন ট্যাঙ্কির পাহাড়ে ৬৫ পরিবার, উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৫০ দাগের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ে (জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন) ২৮ পরিবার, বিএস ২১২ ও ২১৩ দাগের পাহাড়ে (মুরগি ফার্ম হয়ে গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন) ১২ পরিবার, আকবর শাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯ পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ পরিবার বসবাস করছে। লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩ পরিবার, হারুন খান সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪ পরিবার, নাছিয়াঘোনা এলাকায় ১২ পরিবার, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮ পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯ পরিবার, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে পাঁচ পরিবার, নাগিন পাহাড়ে ২৫ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮ পরিবার, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৪২ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে (রৌফাবাদ, অক্সিজেন) ১১ পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। দুঃখের বিষয় পাশাপাশি থেমে নেই পাহাড় কাটা। বিগত ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা এলাকার পরিমাণ ছিল ৬৭৯ হেক্টর। আর ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৯৫ হেক্টরে। প্রতি বছর যে হারে পাহাড় নিধন চলছে, তাতে নগরীতে পাহাড় কাটা এলাকা বেড়ে এখন ২ হাজার হেক্টর হয়েছে বলে ধারণা পরিবেশবিদদের কারণ, ২০১২ সালের পর আর গবেষণা হয়নি। তাই পাহাড় কাটা এলাকার প্রকৃত তথ্য জানা যায়নি। গত এক বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামে মামলা করেছে ১২টি। তার আগের বছর মামলা হয় ২২টি। ২০ বছরে মামলা হয়েছে শতাধিক। আবার অধিদপ্তরের অগোচরে রয়ে যায় অনেক পাহাড় কাটার ঘটনা। বায়েজিদ ও আকবরশাহ এলাকায় বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটছে। প্রায় ৮০ শতাংশ মামলা হয়েছে এ দুটি এলাকায়। একথা অনস্বীকার্য যে, ‘তাদের জন্য নিরাপদ বসতি নির্মাণের উদ্যোগ না নিলে প্রতি বছর বর্ষায় এমন দৌড়াদৌড়ি করতে হবে সবাইকে।’ ফলশ্রæতিতে যার কোনো সুফল পাচ্ছে না, দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না বসবাসকারী এবং দেশবাসীর কাছে। আমাদের দেশে বর্ষা মানে জলাবদ্ধতার অভিশাপ এবং পাহাড় ধসের শঙ্কা। পাশাপাশি আতি বর্ষাও পাহাড় ধসেরও শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি প্রতি বছরই পাহাড় ধসে বহু প্রাণহানিও ঘটে। তারপরও বন্ধ করা যায়নি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে মানুষের বসবাস। যদিও বর্ষা এলেই এখানে বসবাসরত মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়, তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ এখানে বসবাস করছেন। পাহাড় কাটার সঙ্গে বিভিন্ন পেশার মানুষ জড়িত। এটি বন্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আবার আবাসন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পেটেও ঢুকছে চট্টগ্রামের পাহাড়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫ বছরে শহরের সবচেয়ে বেশি পাহাড় নিধন হয়েছে বায়েজিদ থানা ও পাহাড়তলী বা আকবরশাহ এলাকায়। এখনো এই দুই এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। ফলে দীর্ঘ হয় মৃত্যুর মিছিল। তার পরও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নি¤œ আয়ের এবং বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙ্গনে বাস্তুভিটাহারা নিঃস্ব অসহায় মানুষ। ফলে সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে, সম্ভবত এটাই সান্ত¡না। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও ধীরে ধীরে থিতিয়ে যায়। মানুষের স্বজনহারানোর ক্ষতও উপশম হয়, তাই ঝুঁকি জেনেও এখানে অনেকেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক সুপারিসকৃৎ ৩৬ সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল পাহাড়ের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা, জরুরি বনায়ন, গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ, মতিঝরনা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, নগরীকে পাহাড়ি এলাকা হাটহাজারীর দিকে স¤প্রসারণ না করে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে পটিয়া ও আনোয়ারার দিকে সম্প্রসারণ। গত ১৬ বছরে বাস্তবায়িত হয়নি এর একটি সুপারিশও।জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখানবাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল।এভাবে প্রতি বছরই পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঘটেই চলেছে প্রতি বছর। সবমিলে ২০০৭ সাল থেকে গত ১৭ বছরে নগরী ও আশপাশে পাহাড়ধসে ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এত প্রাণহানির পরও চট্টগ্রাম নগরীতে বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা, দখল ও বসতি স্থাপনা। পাহাড় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উপ-কমিটির দেওয়া তথ্যমতে, নগরীর ২৫টি পাহাড়ে এক হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বললেও যায় না। তাঁদের যতটুকু সহায়সম্বল আছে তা আঁকড়ে আগলে রাখতে চায়। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক সুপারিসকৃৎ ৩৬ সুপারিশগুলি বাস্তবায়নের উদ্যোগের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের এসব মানুষের আবাসন এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে পাহাড় পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস থেকে নিঃস্ব গরীব অসহায় মানুষদের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। অতএব, বর্ষায় পাহাড় পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস চিরতরে বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করা দেশ জাতি রাষ্ট্র এবং সরকারের নৈতিক এবং সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব।

লেখক : প্রাবন্ধিক