বর্ষাকাল বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময়

1

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

বর্ষার আগমনে প্রকৃতিতে নামছে অঝোর বৃষ্টি। হয়তো আষাঢ়ে ঝরবে বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ধারা। মনমাতানো বৃষ্টির এমন মায়াময় দৃশ্য এখন বিরল। এই বর্ষা তথা আষাঢ়-শ্রাবন বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময়। দেশজুড়ে বৃষ্টি নামলেও বর্ষার পুরো রুপ ফুটে উঠেনি এখনো। অবশ্য বর্ষা ঋতু তার সেই চিরচেনা রূপে এখন আর ধরা দেয়না। নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টির দেখা মিলেনা আবার অনির্দিষ্টিকালেও বৃষ্টির দেখা মিলে!
বর্ষা আসে। সময়ে সময়ে বিরামহীন বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীসহ নিচু এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। নিম্নাঞ্চলে সৃষ্টি হয় বন্যার। অনেক সময় পানি নামলেও রেখে যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি! দুর্ভোগ ও অবর্ণনীয় কষ্টে পড়ে বহু মানুষ। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। এসবের জন্য বৃক্ষ কাটা ও বৃক্ষ না লাগানো অন্যতম বড় কারণ! প্রতিবছরই অতিবৃষ্টি, বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মে। এর কারণ কী? প্রধান কারণ গাছপালা ধ্বংস। ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও পরিবেশের ভারসাম্য। ইতিপূর্বে করোনার মতো ভাইরাসের হামলে পড়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। যদিও এখন আবার বাড়ছে করোনা। জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, প্রকৃতি ধ্বংসের কারণেই মহামারীর সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ব।
পরিবেশ সুরক্ষায় বৃক্ষরোপণের কোন বিকল্প নেই। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ভূমিকা যেমন ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য ও সুষম জলবায়ুর প্রয়োজনে একটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা আবশ্যক। অর্থনৈতিক ও নানা প্রয়োজন মেটাতে পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের মতে, বনের উপর নির্ভরশীল বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের জীবন সমস্যায় পড়তে পারে। প্রতি বছর আট হাজার বর্গহেক্টর বনভূমি ধ্বংস করছে পৃথিবীর মানুষ। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তৃত এলাকার মরুময়তা রোধে ২০ হাজার হেক্টর ভূমিতে বনায়ন-বৃক্ষরোপণ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি খুবই কম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বনভূমি কাটার মাত্রাও ক্রমে বেড়ে চলেছে। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য বৃক্ষরোপণ আবশ্যক। মানুষ তার নানা প্রয়োজন মেটাতে বৃক্ষের ব্যবহার এবং বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বৃক্ষের ব্যাপক ক্ষতি করে। অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ প্রয়োজনে বৃক্ষ সংকট একটি ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। শুধু যে বনভূমি উজাড় হচ্ছে, তা নয় সমান তালে চলছে পাহাড় কাটাও। যে কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মুখোমুখি।জাতিসংঘের এক রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশ অপেক্ষা অধিকহারে বৃক্ষ কর্তন করছে। যে কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ। ছড়িয়ে পড়ছে নানা প্রাণঘাতী রোগজীবানু। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় এবং সাগরে পানি বৃদ্ধির কারণে উপকূলবর্তী ভূ-ভাগ সাগরতলে ডুবে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। বনভূমি ও বৃক্ষ কমে যাওয়ায় বিশ্বের নানাস্থানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বাড়ছে। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরায় বিপর্যস্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলো। সমুদ্রে পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়লে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ মালদ্বীপ, বাংলাদেশসহ বহুদেশ ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। গ্রীন হাউজ ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে হলে বৃক্ষকাটা রোধ ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। না হলে পরিণাম হবে ভয়াবহ। পরিবেশ দূষণমুক্ত করতে উদ্ভিদ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রাণিজগত শ্বাস প্রশ্বাস ও দহনকার্যের ফলে প্রচুর পরিমাণ কার্বনডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে যোগ করছে এবং সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করছে। সবুজ উদ্ভিদ বায়ুমন্ডলের দূষণ রোধ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
উদ্ভিদ মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রেখে মাটির ক্ষয়রোধ করে। পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্যাপকহারে গাছ লাগানোর কোন বিকল্প নেই। বৃক্ষরোপণের তাৎপর্য তুলে ধরে একটি শ্লোগান নির্দিষ্ট করা হয়েছে ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। বলা হচ্ছে একটি গাছ কাটলে তার বদলে তিনটি গাছ লাগাতে হবে। বর্ষাকালই বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময়। এ সময় সরকারি উদ্যোগে লাখ লাখ বৃক্ষচারা জনগণের মাঝে বিনামূল্যে নতুবা নামমাত্র মূল্যে বিতরণ করা হয়। কেবল বৃক্ষরোপন নয় পাশাপাশি বৃক্ষের পরিচর্যাও করতে হবে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বৃক্ষসম্পদের উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ করা দরকার। এজন্য নতুন বনভূমি সৃষ্টি, নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন রোধ ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ করতে হবে। পরিবেশ ধ্বংস হয় এমন সব কর্মকান্ডে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অবাধে বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ বাঁচাতে বৃক্ষরোপণের কোন বিকল্প নেই। কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয় ‘বৃক্ষরোপণ অভিযান’কে আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করতে হবে। বৃক্ষরোপণে সরকার, এনজিওসহ নানা প্রতিষ্ঠান এবং আমাদেরকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আসুন, আমরা গাছ লাগাই, গাছের পরিচর্যা করি এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হই।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট