চিংলামং চৌধুরী
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা) একটি অনন্য সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ভৌগোলিক অঞ্চল। এখানকার পাহাড়, অরণ্য, ঝরনা আর নদী যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো প্রাচীনকাল থেকে এখানে সহাবস্থান করে আসছে প্রায় ১৩টির বেশি ঐতিহ্যবাহী জাতিগোষ্ঠী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খিয়াং, পাংখোয়া, লুসাই, রাখাইন, বম প্রভৃতি। এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে নিজস্ব ভাষা, জীবনধারা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক এবং উৎসব-পার্বণের ধারা। এদের অনেকেই বৌদ্ধ, কেউ হিন্দু, কেউ খ্র্রিস্টান। কিন্তু ধর্মীয় ভিন্নতা সত্তে¡ও পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সহাবস্থান। আন্তঃসম্প্রীতির ঐতিহ্যতার একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে এখানকার বর্ষবরণ উৎসব। এই উৎসবসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনচর্চার এক উজ্জ্বল প্রতিফলন। আদি সমাজে বর্ষচক্রের ধারণার আলোকে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব জাতিগোষ্ঠীর সমাজে সময়ের পরিমাপ ছিল মূলত ঋতু এবং কৃষিকাজের ধারা অনুযায়ী। শস্য কাটার সময়, জুম প্রস্তুতির সময় এবং বর্ষার আগমনএসব সময়েই নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন হতো। পরে, পালিত ধর্ম এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংস্কৃতির প্রভাবের ফলে এখানে নির্দিষ্ট বর্ষবরণ উৎসবের রূপ পায়। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইনসহ বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকেই নিজস্ব নববর্ষ উদযাপন করে আসছে। বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপন ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হলেও, তাদের উৎসবকাল, অভিব্যক্তি ও উদ্দেশ্য প্রায় অভিন্ন। এ উৎসবের রূপ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হলেও মূল রীতিনীতি ও চেতনা আজও টিকে আছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে মূলধারার বাইরে রাখা হয়। কিন্তু তারা নিজেদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে পরিবারভিত্তিক অনুশীলনের মাধ্যমে। ব্রিটিশরা পাহাড়ে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও সংস্কৃতি ও আচার রক্ষা মূলত পাহাড়িদের উপরই নির্ভরশীল ছিল। বর্ষবরণ ছিল পাহাড়িদের বছরের সবচেয়ে বড় মিলনোৎসব। এটি ছিল একাধারে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক আনন্দের উপলক্ষ। চৈত্র মাসের শেষ কয়েকদিন জুড়ে উৎসবের প্রস্তুতি চলত, যা বাংলা নববর্ষ পেরিয়ে সপ্তাহ গড়িয়ে যেত। পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা জাতিগোষ্ঠীর সাংগ্রাইং উদযাপন যদি আমরা দেখি। সাংগ্রাইং উৎসব তিন থেকে চার দিন ধরে উৎযাপিত হয়। সাংগ্রাইংএর প্রথম দিন হলো আ্ক্রো বা অ্াক্যো নিঃ। স্থানীয়ভাবে এদিন পাইং ছোয়েঃ নিঃ (পাইং= ফুল, ছোয়েঃ= পাড়া, নিঃ= দিন) নামে পরিচিত। কারণ, এদিন ছেলে-মেয়েরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কলরব করতে করতে ঘুরে ঘুরে বুদ্ধ পূজার জন্য, ঘর সাজানোর জন্য রংবেরংয়ের ফুল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। ঘর-দোর, উঠান সব কিছু পরিষ্কার করে সংগৃহিত ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে তোলে। দ্বিতীয় দিন হলো আ্ক্যাঃ নিঃ। এদিন বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা হয়। প্রথানুসারে, এদিন ভোরের আলো ফোটার পরে পরেই মারমা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা স্নান করে পবিত্র হয়ে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে পঞ্চশীল (শুচিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য পাঁচটি অঙ্গিকার) ও অষ্টশীল (শুচিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য আটটি অঙ্গিকার) গ্রহণ করেন। বয়স্করা বিহারে গিয়ে অষ্টশীল পালন করেন। অষ্টশীল পালনকালে তাঁরা ২৪ ঘন্টা বিহারে অবস্থান করে বুদ্ধ বন্দনায় নিয়োজিত থাকেন (তাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছে করলে বিহারে ২/৩ দিন থেকে গিয়ে অষ্টশীল পালন করে যেতেও পারেন)। এদিন তাঁরা শুধু একবেলাই আহার করবেন, এবং তা দ্বিপ্রহরের আগেই সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়া এদিন মঙ্, ক্রীহ্নাং, সাইংজি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের ও সাইজের কাঁসার ঘন্টা বাজিয়ে ধুমধাম করে সোনা-রূপার চোবানো জল বা চন্দন মিশ্রিত জল বা নারিকেলের জল দিয়ে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করানো হয়। বুদ্ধ-স্নানের পর্বটি বিহারে যেমন সম্পন্ন করা যায়, তেমনি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি ছড়াতে নিয়ে গিয়েও করা যায়। এছাড়া এদিন পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদেরও স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ নেয়া হয়। বিকেলে ফুল দিয়ে, ধূপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধ পূজা হয়। গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে বৌদ্ধ বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষুদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের জন্য ছোয়েং (আহার্য্য-সামগ্রী) পাঠানো হয়। তৃতীয় দিন হলো আ্ক্রেঃ বা আ্ক্যেঃ নিঃ। দ্বিতীয় দিনের ধর্মাচারগুলো তৃতীয় দিনেও অব্যাহত থাকে। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমাদের মধ্যে এদিনেই রি-লঙ-পোয়ে বা ধিঃবৎ ভবংঃরাধষ অনুষ্ঠানের শুরু হয়। এ ছাড়া বোমাং সার্কেলে চতুর্থ দিনে পিঠা-পুলি তৈরি করে ঘরে ঘরে বিতরণের যে রেওয়াজ রয়েছে তার আয়োজন-প্রস্তুতি এদিন থেকেই শুরু হয়। পালেংসা মারমারা এদিন আ্তাক্ নিঃ বা আ্তাদাঃ দিনের অর্থাৎ চতুর্থ দিনের আপ্যায়নের অন্যতম একটি পদ রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় বুনো সবজির উপকরণের সন্ধানে গ্রামের আশেপাশের পাহাড়, জঙ্গল চষে বেড়ায়। বছরটি বর্মী পঞ্জি অনুসারে যদি লীপ ইয়ারএর বছর হয়, তাহলে, তৃতীয় দিন আরও একদিন বেশি উদযাপিত হবে। চতুর্থ দিন আ্তাক্ নিঃ (আ্তাদাঃ নিঃ নামেও পরিচিত) নামে পরিচিত। এদিন স্গ্রাা মাং দেবলোকে ফিরে চলে যান। বার্মায় এদিন রি-লঙ-পোয়ে উৎসবেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। এদিন স্গ্রাা মাং আকাশমার্গ ধরে দেবলোকে পাড়ি জমান বিধায় এদিনটি আপ্যাইং নিঃ হিসেবেও অনেকের কাছে পরিচিত। আপ্যাইংএর অর্থ ‘ওড়া বা উড়ে যাওয়া’। পঞ্চম দিন হলো “হ্নইক্ সয়্্ তাক্রে নিঃ” বা নতুন বছরে পদার্পনের দিন অর্থাৎ পঞ্চম দিন মারমাদের নতুন বছরের প্রথম দিন। এদিনে কোন আনুষ্ঠানিক আয়োজন নেই। তবে এদিন বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ নেয়া হয়। মারমাদের অনেকেই এদিন শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়, নালা ইত্যাদি থেকে মাছ ধরে এনে নদীতে, বড় জলাশয়ে ছেড়ে দেন। ছেড়ে দেওয়ার সময় বলেন, “আমি তোমাকে একবার মুক্ত করলাম, তুমি আমাকে দশবার মুক্ত করবে”। শুধু তাই নয়, খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে থাকা অনেক প্রাণীকেও তাঁরা এদিনে মুক্ত করে দেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জনগোষ্ঠীগুলো প্রধানত বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। বর্ষবরণ উৎসবে ধর্মের উপস্থিতি একটি গুরুপূর্ণ অনুষঙ্গ। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকেই বর্ষবরণের সময় বিহার গিয়ে পুজা দেয়, ধর্মীয় উপদেশ গ্রহণ করে। ধর্মীয় উপাসনা, প্রার্থনা ও দানের মধ্য দিয়ে নতুন বছরের সূচনা করা হয়। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সামগ্রিক জীবনশুদ্ধির এই চর্চা অনেকাংশে ধর্মনিরপেক্ষ এক চেতনা তৈরি করে, যা সকল জাতিগোষ্ঠীকে একত্র করে। বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম সৌন্দর্য হলো এর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র। যদিও প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর উৎসব আলাদা, তবু তারা একে অপরের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।এই পারস্পরিক দাওয়াত, শুভেচ্ছা বিনিময়, ও সহঅংশগ্রহণ পার্বত্য জনপদের একটি অনন্য সম্প্রীতির ধারা গড়ে তুলেছে। এটি কেবল সংস্কৃতির নয়, বরং একটি সামাজিক বন্ধনের রূপ যা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও জাতিগত টানাপোড়েনকে ছাড়িয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অনেক বছর ধরে রাজনৈতিক উত্তেজনা, সহিংসতা ও জাতিগত বৈষম্যের অভিজ্ঞতা বয়ে এনেছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর ধীরে ধীরে শান্তির আবহ তৈরি হলেও, অনেক সামাজিক বিভাজন আজও বিদ্যমান। এই প্রেক্ষাপটে বর্ষবরণ উৎসব এক ধরণের “সাংস্কৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়া” হিসেবে কাজ করে। জাতি, ধর্ম, বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে মানুষ এই সময়টিতে একত্র হয়, যা সামাজিক ঐক্যকে শক্তিশালী করে। পার্বত্য অঞ্চলের শহরাঞ্চল এবং গ্রামীণ অঞ্চলে বর্ষবরণের রীতিনীতিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে: শহুরে আয়োজনে আমরা যা দেখে থাকি তা হলো, সামাজিক সংগঠন ও প্রশাসনের সহযোগিতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার আয়োজন,সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, নাটক, গানের অনুষ্ঠান। মেলা, ও হস্তশিল্প প্রদর্শনী। স্কুল, কলেজ ও সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ। গ্রামীণ আয়োজন আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া। গৃহস্থালি পরিচ্ছন্নতা, ধর্মীয় উপাসনা।প্রতিবেশীদের সঙ্গে উপহার ও খাবার বিনিময়। লোকজ নৃত্য, গান ও কাহিনী পাঠের আয়োজন। বর্তমান প্রজন্ম অনেক সময় শহুরে সংস্কৃতির প্রভাবে নিজস্ব ঐতিহ্য থেকে কিছুটা বিচ্যুত হচ্ছে। বাংলা মূলধারার ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন অনেক সময় স্থানীয় উৎসবগুলোকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এতে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সংকট তৈরি হতে পারে। এই প্রেক্ষিতে প্রয়োজনশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় সংস্কৃতির পাঠ অর্ন্তভুক্ত করা। তারুণদের উৎসবে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা। গবেষণা ও দলিলায়নের উদ্যোগ।
পার্বত্য বর্ষবরণ উৎসব একদিকে যেমন স্থানীয় সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে তা জাতীয় বহুসংস্কৃতির অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব উৎসবকে গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করলে তা জাতিগত স¤প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। হতে পারে উৎসবের সৌহার্দ্য জাতীয় সম্প্রীতির পাথেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্ষবরণ উৎসব কেবল একটি উৎসব নয়; এটি একটি জীবন্ত সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ, একটি সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। বৈসু, সাংগ্রাইং, বিজু, বিষু, বিহু,সাংলান,পাতা, সাংক্রাই, চাংক্রান এবং বাংলা নববর্ষ ভিন্ন নাম, কিন্তু অভিন্ন আবেগ। এখানেই নিহিত আছে পাহাড়ের আত্মপরিচয়,শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, এবং সহাবস্থানের চেতনা। আমরা চাই, এই উৎসব শুধু পাহাড়েই সীমাবদ্ধ না থেকে, সমগ্র দেশের জন্য এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠুক। বর্ষবরণ হোক বৈচিত্র্যকে ধারণ করার, সংরক্ষণ করার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখার এক অনন্য উপলক্ষ।