নিজস্ব প্রতিবেদক
রেলওয়ের ইঞ্জিন ও কোচ সংকটের শুরু হয় ২০১৫ সালের দিকে। সে সময় নতুন রেলপথ নির্মাণ ও নতুন ট্রেন চালু করার কারণে এ সংকট প্রকট হয়। যা বিগত আট বছরেও নিরসন হয়নি। ২০১৬ সালের পর ইঞ্জিন ও কোচ সংকট নিরসনে প্রায় ৯ হাজার ১০১ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে আগামী জুনে শেষ হতে যাচ্ছে পাঁচ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দের দুটি প্রকল্প। প্রকল্প দুটি পুরোপুরি শেষ হলে পাঁচ প্রকল্পে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয়ে যাবে। এত টাকা ব্যয় হলেও ইঞ্জিন ও কোচ সংকটে ‘বেসামাল’ অবস্থার মুখোমুখি রেল। বাকি তিন প্রকল্পও একপ্রকার গতিহীন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, যাত্রীদের বাড়তি চাহিদা পূরণকল্পে নতুন নতুন রুটে ট্রেন পরিচালনা, পুরাতন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যাত্রীবাহী গাড়ি প্রতিস্থাপন ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং ইঞ্জিন ফেইলর কমাতে প্রকল্পগুলো নেয়া হয়। পাঁচটি প্রকল্পের মধ্যে আগামী জুনে শেষ হতে যাওয়া দুটি প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৯ ও ৯৮ শতাংশ। বাকি তিন প্রকল্পের মধ্যে দুটির অগ্রগতি ৫ ও ৮ শতাংশ। একটি প্রকল্পের এখনো টেন্ডার আহŸান করা হয়নি। প্রকল্পগুলো ২০২৮ সালের দিকে শেষ হলেই রেলে পুরোপুরি ইঞ্জিন ও কোচ সংকট কেটে যাবে। তবে নতুন রুট ও নতুন ট্রেন বাড়ালে প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়তে পারে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘কোরিয়া থেকে কিছু কোচ এনেছি আমরা। আরও ৩৫টি কোচ অতিরিক্ত অর্ডার দেয়া হয়েছিল। সেটাও চলে আসবে। আর ভারত থেকে কিছু কোচ যেটা আসার কথা, সেটা আগামী ছয় মাসের মধ্যে এলে ঘাটতি হয়তো অনেকটা পূরণ হতে শুরু করবে। কিন্তু ইঞ্জিনের সমস্যাটা আমাদের থেকে যাবে। ইঞ্জিন নিয়ে কোরিয়ার একটা প্রকল্প আছে। তাদের সাথে এখনও কোনো চুক্তি হয়নি। সবমিলিয়ে আমরা ইঞ্জিন ও কোচ সংকট নিরসনে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০০টি মিটার গেজ যাত্রীবাহি ক্যারেজ (কোচ) সংগ্রহ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ৯২৭ কোটি টাকার প্রকল্পটি অসম্পাপ্ত রেখেই পরের বছর প্রকল্পটি সংশোধনী শেষে গত বছরের মার্চে প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দুই হাজার ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। কোরিয়া ইডিসিএফের অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) এবং ১৮২টি মিটারগেজ যাত্রীবাহি ক্যারেজ সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনে শেষ হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের অধীনে ২০টি এমজি লোকোমোটিভ ও ১৪৭টি ক্যারেজ সংগৃহীত হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে বাকি ৩৫টি ক্যারেজ চলে আসবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, বর্তমানে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৮৯ শতাংশ। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ইঞ্জিন ফেইলর কমবে এবং ক্যারেজের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি যাত্রী নিরাপত্তা ও রেলওয়ের আয় বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে নতুন কোচ দিয়ে পূর্বাঞ্চলে ছয়টি নতুন রেকে ট্রেন চলাচল করছে।
যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ৪০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ, ৭৫টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান, ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান, ৫৮০টি মিটারগেজ ওয়াগন এবং ৪২০টি ব্রডগেজ ওয়াগন সংগ্রহ প্রকল্প গ্রহণ করে রেলওয়ে। তিন হাজার ৬০২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে অনুমোদিত প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনে শেষ হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৮ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি হয়েছে।
রেলওয়ের প্যাসেঞ্জার কোচের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি ও যাত্রী সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০০ ব্রডগেজ (বিজি) যাত্রীবাহি ক্যারেজ সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকল্প নেয়া হয়। ২০২২ সালে অনুমোদিত এক হাজার ৭০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নেয়া প্রকল্পটি আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, যাত্রী সাধারণের আধুনিক সুবিধা সম্বলিত নিরাপদ ট্রেন সেবা প্রদান, যাত্রীবাহি গাড়ির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি, যাত্রীদের বাড়তি চাহিদা পূরণকল্পে নতুন নতুন রুটে ট্রেন পরিচালনা, পুরাতন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যাত্রীবাহি গাড়ি প্রতিস্থাপন ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫ শতাংশ। প্রকল্পটি শেষ হলেই যাত্রীদের চাহিদা অনুসারে নতুন নতুন রুটে ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
কোচ পুনর্বাসন করে প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য ৫০টি বিজি এবং ৫০টি এমজি যাত্রীবাহি ক্যারেজ পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২২ সালে অনুমোদিত হয়। রেলওয়ের রাজস্ব বাজেটের অপ্রতুলতার কারণে যেসব ক্যারেজ মেরামত ও পুনর্বাসন করা সম্ভব নয় সেগুলি প্রস্তুত করতেই ১৩৮ কোটি টাকার প্রকল্পটি নেয়া হয়। প্রকল্প শেষ হলে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বহরে ১০০টি যাত্রীবাহি ক্যারেজ সংযোজন করা হবে। চলতি বছরেই জুন মাসেই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো প্রকল্পের অগ্রগতি ৮ শতাংশ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি ২০২২ সালে অনুমোদিত হলেও কাজ শুরু হয়েছে গত বছর। সে হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ২৫টি, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে ৪০টি ও ২০২৬-২৭ অর্থ বছরে ৩৫টি কোচ সংস্কার করে বাইর করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম-দোহাজারি মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়েল গেজ রেলপথে রূপান্তর প্রকল্পের অধীনেও ৩০টি মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ করা হবে। ২০২৮ সালেই প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনকে গুরুত্ব দিয়ে এ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। ৩০টি ইঞ্জিন কিনতে প্রকল্পের অধীনে ব্যয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক মো. সবুক্তগীন পূর্বদেশকে বলেন, ‘দোহাজারি-ষোলশহর প্রকল্পে ৩০টি ইঞ্জিন কেনা হবে। ইঞ্জিনগুলো আসলে রেল বহরে যুক্ত হলে আরও গতিশীলতা বাড়বে। এছাড়াও প্রস্তাব অনুযায়ী ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহ করা গেলে সংকট কেটে যাবে। চাহিদা অনুযায়ী যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো যাবে।’