আ,জ,ম,সামশুল হক
নদীমাতৃক দেশ হিসেবে অতীতে কম- বেশি বন্যা হয়েছে বাংলাদেশে। তবে এবারের বন্যা স্মরণকালের বন্যা হিসেবে আবির্ভূত। জলবায়ু ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এই দেশে অতিমাত্রায় বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে অধিকাংশ নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে থাকে। একদিকে টানা ৬ – ৭ দিন ভারী বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল এবং অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে পানি প্রবাহের কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে ভয়াবহ বন্যার রূপ নিয়েছে।অতিরিক্ত পানি বৃদ্ধির কারণে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, এবং লোকালয় পানিতে তলিয়ে যায়। পানির তীব্রস্রোতে অনেক এলাকায় বেড়ীবাধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকে এই ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে বন্যায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ফসলের মাঠ, বীজতলা, পুকুরের মাছ,গরু-ছাগল, হাঁস- মুরগি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি অবর্ণনীয়।
বন্যার ভয়াবহতায় চট্টগ্রাম বিভাগে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যানমতে বাংলাদেশে মোট ১২ টি জেলা বন্যা কবলিত। কোথাও কোথাও পাহাড় ধ্বসের ঘটনাও ঘটেছে। ২-৩ টি জেলার মানুষ এখনো পানিবন্দী। সরকারি তথ্যমতে, বন্যাকবলিত ৫৪ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রাথমিক হিসাবে ৫৯ জনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গেছে। অনেক লাশ মাটির অভাবে চোখ বুজে পানিতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। মানুষের পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং সব মাছ ভেসে গেছে পানির তোড়ে। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এই বন্যা। ৪০% মানুষ আশ্রয় নিয়েছে আস্রয় কেন্দ্রে। অবশিষ্ট লোকজন নিজের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ত্রাণ সাহায্যের আহাজারি হয়েছে সর্বত্র। বন্যা কবলিত এলাকায় ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, প্রতিষ্ঠানগত, সশস্ত্র বাহিনী এবং সরকারি ভাবে ত্রাণ সহায়তা হয়েছে এবং হচ্ছে। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছে হার না মানা যোদ্ধারা। তাঁদের কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ়তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিছু কিছু প্রত্যন্ত এলাখায় এখন ও ত্রাণের হাহাকার রয়ে গেছে। এইসব এলাকা চিহ্নিত করে অবশ্যই সরকারি উদ্যোগে ত্রাণ সরবরাহ করা জরুরি। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সরবরাহের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়নি। এককথায় বলা যায়, বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষ হয়েছে সর্বহারা। বৃষ্টির প্রভাব থাকুক না থাকুক কমপক্ষে আরো দুই সপ্তাহ ত্রাণ সরবরাহ করে যেতে হবে। দুর্গত এলাকায় মেডিকেল তিম অত্যাবশ্যক। পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচার জন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ প্রয়োজন।
মানুষের ঘরবাড়ির পাশাপাশি স্কুল-কলেজ- মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক এবং রাস্তাঘাটের ক্ষতি অপূরণীয়। যা প্রত্যক্ষভাবে না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য।। ধনী- গরিব মিলে একাকার। জেলা- উপজেলাভিত্তিক সঠিক হিসাব নিরুপণসহ আশু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্য, চিকিৎসা, পুনর্বাসনসহ কৃষি উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচিত সরকার না হলেও বিত্তবানদের সহযোগিতা নিয়ে এই সরকারকে সময়ের দাবিতে এই কঠিন ও দুরুহ কাজটি করা সম্ভব।
১) দুর্গত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চলমান রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নারী- শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়া বাঞ্চনীয়।
২) সরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে পুলিশ, আনসার,গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনী, সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবীদের দায়িত্ব দেওয়া উত্তম।
৩) ত্রাণ যথারীতি বন্টন হলো কিনা,তা মনিটরিং করাও জরুরি।
৪) সরকারিভাবে মেডিকেল টিম গঠন করে উপজেলাভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করা শ্রেয়।
৫) বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন সহ কৃষি উপকরণ, যেমন-
সার,বীজ,কীটনাশক এর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬)প্রয়োজনে সুধমুক্ত ঋণ ব্যবস্থা এবং ভর্তূকীর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৭) বন্যা পরবর্তীতে বাড়িঘর, পয়:নিষ্কাশন সহ বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন।
৮) পানি প্রবাহের জন্য দখলকৃত খালগুলো উদ্ধার করা ভাংগনের কাছ থেকে নদীকে রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া এবং নদীগুলো ড্রেজিং করাও জরুরি।
৯) সর্বোপরি বন্যার্তদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সমন্বিত উদ্দোগে করা উত্তম।
লেখক : প্রাবন্ধিক