বন্ধ রাখার পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চলছে

6

মনিরুল ইসলাম মুন্না

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সহিংসতার পর বন্ধ করে দেয়া হয় ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, টিকটক, এক্স, ইন্সট্রাগ্রামসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু থেমে নেই এসব যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহার। আর তা হয়েছে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন এর মাধ্যমে। গত কয়েকদিন ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর ভিপিএন ব্যবহার দেখা গেছে সর্বত্র।
জানা গেছে, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন সাইট বন্ধ হয়ে গেলে দেশে ভিপিএন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যায়। অন্যান্য প্রযুক্তির মতো এই ভিপিএন ব্যবহারে বেশ কিছু সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে নানারকম ঝুঁকি। এর মধ্যে কিছু নিরাপদ আবার কিছু অনিরাপদ ভিপিএন রয়েছে। অনিরাপদ ভিপিএন ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা।
সফ্টহাট লিমিটেডের সিনিয়র সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম বলেন, ভিপিএন এমন এক ধরনের নেটওয়ার্ক কাঠামো, যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক দিয়ে ভার্চুয়াল টানেলের সাহায্যে অন্য এক বা একাধিক নেটওয়ার্কিংয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ মেলে। ইন্টারনেট ব্যবহারে নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষা, নিরাপত্তা বাড়ানো ও অপ্রবেশযোগ্য কনটেন্ট দেখার জন্য বাংলাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভিপিএন।
তিনি আরও বলেন, এটি অনলাইন কার্যক্রমের সুরক্ষা নিশ্চিতে অদৃশ্য একটি চাদর। তবে ভিপিএন ব্যবহার করা অবস্থায় ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে যেকোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি।
এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ও পরবর্তী সংঘাতের মধ্যে ১৭ জুলাই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত হয়। পাঁচ দিন পর মঙ্গলবার রাতে দেশে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড সেবা আবার সচল করা হয়। আর বুধবার থেকে সারা দেশে চালু হয় ব্রডব্যান্ড সেবা। যদিও এখনো বিভিন্ন এলাকায় ইন্টারনেটের গতি নিয়ে নেতিবাচক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ফেসববুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রয়েছে এখনও। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বহু মানুষ ভিপিএন ডাউনলোড করে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে। অনেকেই অবশ্য আগে থেকেই ভিপিএন ব্যবহার করলেও তাদের সঙ্গে এখন প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ভিপিএন ব্যবহারকারীর। স্বাভাবিক সময়ে গুগল প্লে স্টোরে সামাজিক নানা যোগাযোগমাধ্যম এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় নানা গুরুত্বপ‚র্ণ অ্যাপস ডাউনলোড বেশি করে মানুষ। তবে গতকালের পরিসংখ্যান বলছে, গুগল প্লে স্টোরে শীর্ষ ডাউনলোড করা পাঁচটি অ্যাপসের মধ্যে চারটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিপিএন। এরপর রয়েছে টিকটক।
সম্প্রতি দেশে ভিপিএনের ব্যবহার ৫ হাজার শতাংশ বাড়ায় ইন্টারনেট ধীরগতি বলে জানান ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, ‘টেকনিক্যাল পার্সনরা (প্রযুক্তিবিদরা) আমাদের জানিয়েছেন, দেশে সম্প্রতি ভিপিএন ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৫০০০ শতাংশ। যখন তারা ভিপিএন ব্যবহার করছেন; তখন তারা বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন। বিদেশের ব্যান্ডউইথের ট্র্যাফিক বেড়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের গতি কমে যাওয়ার এটা একটা অন্যতম কারণ। এতে অনেক সময় মোবাইলে ফোরজি ইন্টারনেট একটু স্লো পাওয়া যাচ্ছে। ব্রডব্যান্ডের ক্ষেত্রেও ধীরগতি দেখা যাচ্ছে’।
ইন্টারনেটের গতি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা-নিষেধ নেই জানিয়ে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘ইন্টারনেটের গতি নিয়ে আমরা কোনো রেস্ট্রিকশন (নিষেধাজ্ঞা) রাখিনি। বিটিআরসির পক্ষ থেকে সম্পূর্ণরূপে এটা অবাধ ও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও কোনো বাধা নেই। কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, কোনো গাইডলাইনও (নির্দেশনা) নেই’।

ভিপিএনের সুবিধা : নিরাপদ সংযোগ থেকে ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট ডেটায় অন্য কারও মনিটরিং বা ব্যাঘাত ঘটানোর বিষয়টি ঠেকিয়ে দেয় ভিপিএন। ভিপিএনের সহায়তায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নিজের আইপি অ্যাড্রেস ও ভৌগোলিক অবস্থান গোপন রাখার সুযোগ পান, যার ফলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, বিজ্ঞাপনদাতা এবং অনলাইন ট্র্যাকারের পক্ষে ব্যবহারকারীর অনলাইন গতিবিধি নজরদারি করা জটিল হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সাইবার নিরাপত্তা হুমকি যেমন ‘ম্যান ইন দ্য মিডল’ ধাঁচের সাইবার আক্রমণ, ‘ডিএনএস স্পুফিং’ এমনকি ওয়াই-ফাই থেকে ব্যবহারকারীর গতিবিধি আড়ি পেতে শোনার মতো ঘটনার ক্ষেত্রে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। ইন্টারনেট সংযোগের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার। এগুলো বিভিন্ন স্থানে বিনাম‚ল্যে ব্যবহারের সুযোগ মেলে। অনেকে বাধ্য হয়ে আবার অনেকে না বুঝে এসব ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এসব ক্ষেত্রে হ্যাকাররা সহজেই ব্যবহারকারীর গুরুত্বপ‚র্ণ ব্যক্তিগতসহ নানা তথ্য পেয়ে যান, যা দিয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করতে পারেন এমন ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। ভিপিএনের মাধ্যমে এসব থেকে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।

ভিপিএন ব্যবহারের অসুবিধা : বিভিন্ন ভিপিএন সেবায় সত্যিকারের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সুবিধার কথা উল্লেখ থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে এগুলো অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বর্তমানে হাজার হাজার ভিপিএন সফটওয়্যার ও অ্যাপ পাওয়া যায়। ভিপিএন টুল ডাউনলোড করার সময় মোবাইল বা কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণসহ ফেসবুক, ইমেইলসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ওই ভিপিএন নির্মাতার কাছে। ব্যবহারকারীর ডেটা যেহেতু ভিপিএন সেবাদাতার হাত দিয়ে যায়, তাই সেবাদাতার সততার ওপর নির্ভর করে ব্যবহারকারীর তথ্য নিরাপত্তা। এ ঝুঁকির পাশাপাশি অনেক সময় ইন্টারনেটের গতি কমে যায়। কারণ বিভিন্ন দুর্গম সার্ভারের মাধ্যমে ডেটা পাঠায় ভিপিএন। একটি ভিপিএন সেটআপ বা কনফিগার করা অনভিজ্ঞ ব্যবহারকারীর কাছে ভীতিকর হতে পারে, বিশেষ করে এনক্রিপশন প্রটোকল, সার্ভার বাছাই ও ‘টানেলিং’ আলাদা করার মতো বিভিন্ন উন্নত ফিচার ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া, ইন্টারনেট সংযোগে ‘ট্রাবলসশুটিং’, ‘ডিএনএস’ বা ‘ডোমেইন নেইম সিস্টেম’ ফাঁস বা নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ্লিকেশন অথবা ডিভাইস সেটআপের বেলায় কারিগরি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা, এমন বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জিং হতে পারে তুলনামূলক কম প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে। ভিপিএনের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু তথ্য গোপন করা তাই সরকারি সংস্থাগুলো চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব তথ্য উদঘাটন করতে পারে না। ভিপিএন ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী বহু অপরাধের ঘটনা ঘটে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের শনাক্ত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।