মিঞা জামশেদ উদ্দীন
১৪ এপ্রলি ২০২৫ ছিল বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ ১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। দিনটার সকাল থেকে শরীর কেমন মেসমেস করছিল, বিছানায় এদিক-সেদিক গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম। ঘুম কাতুরে মন; কোনভাবেই লাফিয়ে উঠতে সাই দিচ্ছেনা মনও, যেন আরেকটু ঘুমায়। ঘরেও তেমন কিছু-একটা নেই খাওয়ার। অর্থাৎ ভাবনার দোলাচলে একটি সংশয় ও ঘোরের মধ্যেই চলছে। না, তা কি করেই হয়, আজ ১ বৈশাখ- এ শিহরণে দুমড়ে-মুচড়ে লাফিয়ে ওঠা। অবশ্য রাতে খাওয়ার পর কিছু অবশিষ্ট ভাত ছিল হাড়িতে। সকাল হতেই তা একটু নরম বা ঘাঁদা হয়ে ওঠে। তাতে কায়দা করে জল দেওয়া হল। বাহ্, অন্যরকম ফ্লেভার! বলতে হয় মাদকা-মাদকা। এক চিমটি লবণ, একটি কাঁচা লঙ্কা আর একপালা পেঁয়াজ, হয়ে গেল খাওয়ার বন্দবস্ত।
তবে, রাত পোয়ালে ১ বৈশাখ সেটাও মাথায় আছিল। হ্যাঁ, রাতে ভাতের সাথে একটি আলুকে চার পালা করে সিদ্ধ দেয়া হয়। তার সাথে যথাযথভাবে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা, লবণ দিয়ে কচলিয়ে এবং সরিষার তেল মিশিয়ে বানানো হল আলুভর্তা। বেশ, হয়ে গেল পান্তাভাত খাওয়ার আয়োজন। অবশ্য একসময়ে আরো সহজ উপায়ে পান্তা ভাত খাওয়া হতো। বিশেষ করে মাঠে কৃষি কাজ করতে গিয়ে, সকালে যেভাবে খাওয়া হতো। ইয়া, মাটির একবচি পান্তাভাত, তার সাথে লবণ, একটা আগুনে টালা শুকনো মরিচ ও একপালা পেঁয়াজ দিয়ে সাদামাটাভাবে খাওয়া হতো। আজকের মতো ফ্যাশনাবেল শুঁটকিভর্তা, আলু ভর্তা, বেগুন ভাজা, ইলিশ মাছ থাকাতো না। কৃষক বা শ্রমজীবীরা যার যার অবস্থা থেকে টিকিয়ে থাকতে লড়াই চালিয়ে যেতে হতো প্রতিনিয়ত। এটি বাঙালির একেবারে শেকড়ের কথা বা মাটির গন্ধ ও চেতনা। তারা গ্লানি, জরা ধুয়েমুছে দাঁড়াতে চায়, এটি তাদের অঙ্গীকার।
যাক, জলে ডুবানো পান্তা খাওয়া হলো। অবশ্য তার আগে গোসল বা স্নান করা হয়। একেবারে নতুন কাপড়-চোপড় পরে প্রস্তুতি নেয়া। তবে রাতে খবরে যা জানতে পারলাম, ডিসি হিলে বর্ষবরন অনুষ্ঠানের স্টেজ নির্মাণে বাঁধা দেয়ার ঘটনা। আয়োজকদের সাথে কমিটি গঠন নিয়ে কি-একটা ঝামেলা হয়। পরে অনুষ্ঠান আয়োজনও বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকার বেইলি রোডে, মহিলা সমিতির মঞ্চও দখল করে নেয়। সঙ্গত কারণে ডিসি হিলে যাওয়া হলো না। তবে শিরিষ তলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল। আরো দুদিন আগে চেরাগি পাহাড়ে আবৃত্তি শিল্পী ফারুক তাহেরের সাথে দেখা। অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি শিরীষ তলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সদস্য সচিব। সভাপতি সম্ভবত দৈনিক আজাদী সম্পাদক আব্দুল মালেক ও পৃষ্ঠপোষকও। হয়তো একারণে এটি বানচাল করতে পারেনি। করতে গেলে একটি মহা ঝামেলা পোহাতে হতো। হাজারো হলো আয়োজনে ছিল দৈনিক আজাদীর সংশ্লিষ্টতা। অবশ্য এসব শুনতে ভালো ঠেকছিল না। ভাংচুর, হামলা ও লুটপাট, কোনটা গ্রহণযোগ্য নয়। নিরীহ ও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনির ওপর ইসরায়েল নগ্ন-বর্বরতাও ভাবিয়ে তোলে। ২০২৩ সালে অক্টোবরে, হামাস নামের একটি জেহেদী গোষ্ঠী ইয়াহুদীদের উপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় ১ হাজার ২১৮ নিরীহ ইয়াহুদী নিহত হয়। এটিও কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আর হামাসের এ হামলার খোঁড়া অজুহাতে শিশু, নারীসহ নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চলাচ্ছে ইসরায়েলের নেতানিয়াহু বাহিনী। মানাবাধিক লঙ্ঘন বিষয়টি শুধু তাদের বেলায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য ; সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষের বসতভিটা থেকেও বিতাড়িত করা হচ্ছে। এরমধ্যে গাজা উপত্যকার রাফাহ শহর দখল নেয়ায় দেড় লক্ষ ফিলিস্তিন উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। তারা এখন শরনার্থী। একই সাথে নেতানিয়াহু বাহিনী সিরিয়ায়ও ডুগে আংশিক দখলে নিয়েছে। ৮ ডিসেম্বর দেশটি প্রধান বাদশার আল-আসাদ পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেয়। মূলত মধ্যেপ্রাচ্য অশান্তি-জনপদে পরিণত হয়েছে। এসব ঘটনা বিশ্ববিবেকও স্তম্ভিত। বলতে হয়, আজ ২শ কোটি মুসলিম আওয়ারা; যাদের ডাল নেই, তোলার নেই ! যেভাবে অর্ধকোটি ইয়াহুদীর কাছে নিরবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছে তারা। কেন মার খাচ্ছে এটাও ভাবা উচিত নয় কী? হ্যাঁ, এক বাক্যে বলতে পারি, বড্ডই আবেগ-উচ্ছ¡াসে চলছে এ জাতির। তারা শুধু বলতে শিখেছে, ইয়াহুদী-নসরাদের ওপর আল্লাহর গজব-নাহালত পড়ুক; আবাবিল পাখি এসে পাথর ছুড়ে মিশিয়ে দিক তাদের। বাস্তবে এসব কথা এখন চলে না; যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইয়াহুদীরা হয়ে ওঠেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্ব। আর আপনারা দেন উল্টো ফতুয়া কোনটি জায়েজ, কোনটি না জায়েজ এবং কে নাস্তিক, কে আস্তিক নয়। আর নারীদের নিয়ে যতসব কিচ্ছা-কাহিনী- এরকম হয়ে চলতে হবে, তমুকভাবে চলতে হবে। শুধু এসব তকমা লাগিয়ে শেষ হল এ জাতি; অতি কল্পনা, অতি অদৃশ্যশক্তি এবং পরনির্ভরশীলতা। যেখানে নিজস্ব সখিয়তা বলতে কিছু নেই, লেখা-পড়ার ধারে-কাছেও নেই। শুধু গুজুবে কান দেয়, আর কান নিল চিলে! অলস এ জাতিগোষ্ঠীর বাস্তবে কান আছে কি নেই, তাও হাত দিয়ে দেখার ফুরসত পায় না। এ হল অবস্থা আর হালহকিকত। এরমধ্যে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো একচেটিয়া দখল করে নিয়েছে বাজার। তাদের পণ্যের গুণগত মানও ভালো এবং টিকসই। পুরো ১৮ কোটির লোকসংখ্যার এ দেশের, এ বিশাল মার্কেট এখনো তাদের দখলে। বাটা কোম্পানি একচ্ছত্রভাবে কয়েকযুগধরে বাজার দখল করে রেখেছে। জুতোসহ তাদের অন্যান্য পণ্যের প্রধান কাঁচামাল হলো চামড়া। আর এ চামড়া বিগত কয়েক বছর অবিক্রিত অবস্থায় পঁচেগলে পরিবেশ দূষণ করে তুলে। অথচ এ চামড়া দেশের অন্যতম রফতানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল। প্রসাধনীর মধ্যে লিভার ব্রাদারসের পণ্যও এখনো অদ্বিতীয় বাজার। কোমলপানিওর মধ্যে কোঁকাকোলাও একচ্ছত্র দখলে রেখেছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত পণ্য তাদের ধারে কাছেও যেতে পারছে না গুণগত মানে। তার সাথে ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা , নষ্ট-পঁচা-বাসি, ভেজাল মেশানোয় প্রবণতা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ। দামও চড়া। শ্রমিকদেরও ঠকায়। ভ্যাট-কর ফাঁকি দেয়া। সর্বশেষে সিআরবির শিরিষ তলা বৈশাখী মেলায় যাওয়া হয়। আয়োজক আবৃত্তি শিল্পী ফারুক তাহের ও স্বপন মজুমদারের সাথে দেখা হয়। স্বপন মজুমদার হলেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার নতুন রাজনৈতিক দল নাগরিক ঐক্য এর চট্টগ্রামের সংগঠক। আমার সঙ্গে ছিলেন সাংস্কৃতিককর্মী বনবিহারী চক্রবর্তী। বনবিহারী চক্রবর্তী ও স্বপন মজুমদারের সাথে কথা হয় বন্ধ থাকা দি এশিয়াটিক কটন মিলস লিমিটেড নিয়ে। বনবিহারী চক্রবর্তী মিলটির কর্মাসশিয়ালে চাকরি করতেন। অবশ্য পরে উৎপাদন শাখায় সুপারভাইজার পদে নিয়োজিত হন। ১৯৭২ সালে মিলটি জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৮২ সালে মিলটি ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে মালিক মিলটি লেআপ ঘোষণা করে। এতে করে বেকার হয়ে পড়ে মিলটি প্রায় ১৩শ শ্রমিক-কর্মচারী। অবশ্য নিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের দীর্ঘ আন্দোলন ও বাদপ্রতিবাদ চলতে থাকে। শেষতক মিলটিকে আবারও ২০১০ সালে বিটিএমসি (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন) অধীনস্থ করা হয় এবং বিটিএমসি সাথে মিলটির শ্রমিক-কর্মচারীদের চুক্তি হয়। বিটিএমসি মিলটি পুনরায় চালু করা এবং ধাপে ধাপে শ্রমিক কর্মচারীদের সকল পাওনাও পরিশোধ করার। এরমধ্যে বিটিএমসি মিলটির যন্ত্রাংশ লোহার দরে কেজি মাফায় বিক্র করে দেয়। সঙ্গে মিলের খালি বিল্ডিং-ঘরসহ অন্যান্য স্থাপনাগুলো গুদাম হিসেবে ভাড়া দিয়ে দেয় প্রাইভেট কোম্পানির কাছে। সর্বশেষ শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা দাঁড়িয়েছে, ৩৩ কোটি টাকা। শ্রমিক-কর্মচারীদের এ ন্যায্য পাওনা বিটিএমসি পরিশোধ করার কথা থাকলেও বরাবরই গড়িমসি করে চলেছে। এমতাবস্থায় অভাব-অনটনে মানবেতর জীবন-যাপন করে বহু শ্রমিক কর্মচারী মারা যায়। আর সকল শ্রমিক-কর্মচারী বেঁচে আছে, তারাও সীমাহীন অর্থ কষ্টে দিনযাপন করছে। মিলটির নিজস্ব প্রায় ১শ একর ভ‚মি রয়েছে। তারমধ্যে কিছু ভ‚মি শ্রমিক-কর্মচারীদের দখলে রয়েছে এবং কিছু শ্রমিক-কর্মচারি মিলটির শ্রমিক কলোনিতে এখনো বসবাস করে আসছেন। তবে তারাও বিটিএমসির আশ্বাসে পথ চেয়ে আছেন। কিন্তু বিটিএমসিও তাদের পাওনা আজ দেব কাল দেব বলে নানা ছল-চাতুরী করছে। বনবিহারী চক্রবর্তী তাঁদের সীমাহীন লাঞ্ছনার কথা জানালেন, নেতা স্বপন মজুমদারকে। নেতাও আশ্বস্ত করেন কিছু একটা করতে পারবেন বলে। ইতিমধ্যে তাদের দল কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করেছেন বলে দৃষ্টান্ত দেখান তিনি।
একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় শিল্প কারখানা মধ্যে চিটাগং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স অন্যতম একটি। এটি ছিল দেশের একমাত্র রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যেটি নাকি লাভজনক ফ্যাক্টরী ছিল। এ ফ্যাক্টরী বার্ষিক আয় ছিল ২০-৩০ কোটি টাকা। সিটি কর্পোরেশনসহ বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের বিশাল অংকের পাওনা রয়েছে। এমতাবস্থায় এ ফ্যাক্টরীটিও রুগ্ন শিল্প দেখিয়ে বন্ধ করে। যার উৎপাদনের একমাত্র কাঁচামাল ছিল লবণ। যা কি-না যোগান দেশে সহজলভ্য ছিল। এমন একটি ফ্যাক্টরী আকস্মিক বন্ধ হয়ে যাওয়াতে দেশের উৎপাদিত সকল পণ্যের উপর প্রভাব পড়ে। ওষুধ শিল্প, গ্লাস, রড, টিন, প্রসাধনীসহ মশক নিধনেও এ ফ্যাক্টরীর উৎপাদিত কেমিক্যাল অত্যাবশ্যক ও সহজলভ্য কাঁচামাল ছিল। ফ্যাক্টরী পুনরায় চালু করতে বিএমআরইও করা হয়। তারপর ফ্যাক্টরীটি চালু করতে কেন গড়িমসি চলছে।
এদিকে ভিটা (বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী জানিয়েছে গণমাধ্যমকে, বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত বিনিয়োগ সম্মেলন সফল হয়েছে। নতুন করে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ আসার আশ্বাস পাওয়া গেছে। এ বিনিয়োগ অনেকটা নিশ্চিত বললেন তিনি। তবে কোন কোন সেক্টরে বিনিয়োগ এসেছে, তা স্পষ্টভাবে কিছু জানাননি। এ বিনিয়োগ সম্মেলন করতে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। তারমধ্য সরকারকে করতে হয় ১ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা। এরমধ্যে আরেক দফা গ্যাসের দাম বেড়েছে। পুরোনো শিল্পে প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা। নতুন শিল্পে ৪০ টাকা। তবে এসবেও শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। তবে গণশুনানিতে বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেছেন, দেশের গ্যাসের মজুদ কমার সঙ্গে সঙ্গে এলএনজি আমদানি বাড়তে থাকে। তারা ১৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো প্রস্তাব করে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিশাল অংকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট