পূর্বদেশ ডেস্ক
অর্থ সংকটের কারণে সোয়া দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে কর্মরত হাজারের অধিক বাংলাদেশি নাগরিক শিক্ষকতার চাকরি হারাবেন। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘের শিশু তহবিল- ইউনিসেফ গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়েছে।
কক্সবাজারে ইউনিসেফ কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন ইউনিসেফের কক্সবাজার কার্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফ ফিল্ড অফিস) এঞ্জেলা কার্নে। কিন্তু এর প্রভাবে নানাবিধ শঙ্কার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। বিশেষ করে চাকরি হারানোর আশঙ্কায় শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে চাকরিরত বাংলাদেশি শিক্ষকরা এরই মধ্যে আন্দোলন শুরু করেছেন। খবর বিডিনিউজের।
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আশ্রয়শিবিরে সাড়ে চার হাজারের অধিক শিক্ষাকেন্দ্র চালু আছে। এসব ‘লার্নিং সেন্টারে’ প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার শিশু পড়াশোনা করে। এঞ্জেলা কার্নে বলেন, শিখন কেন্দ্রগুলো আপাতত জুনের শেষ নাগাদ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। কিন্তু এরপর কেন্দ্রগুলো খুলবে কি-না তা নির্ভর করবে নতুন করে তহবিল পাওয়ার উপরে।
যদি শিক্ষা কার্যক্রম ফের শুরু হয় তাহলে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ আওতাভুক্ত স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষকরা (বাংলাদেশি নাগরিক) চাকরিতে থাকবেন না।
কার্নে বলেন, এতে করে চাকরি হারাবেন স্থানীয় এক হাজার ১৭৯ জন শিক্ষক। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের আর শেখানো হবে না ইংরেজি, বিজ্ঞান বা সামাজিক শিক্ষা।
বার্মিজ ভাষা, গণিত, জীবন দক্ষতা ও সামাজিক মানসিক শিক্ষার উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কেবল। যেখানে যুক্ত থাকবেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিক্ষকরা।
এমনকি শিশুদের নতুন করে পাঠ্যবই দেওয়া থেকেও সরে আসার কথা জানিয়েছে কার্নে। তিনি বলেন, পুরাতন বইগুলো শিক্ষাবর্ষ শেষে পুনরায় নতুন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে।
এদিকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের খবরে চাকরিরত স্থানীয় শিক্ষকরা কয়েকদিন ধরেই উখিয়ায় আন্দোলন করছেন। তারা সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার যান চলাচল ব্যাহত করছেন।
তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের রেখে স্থানীয়দের চাকরি থেকে সরানো হচ্ছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়রা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
স্থানীয়দের চাকরির দাবিতে আন্দোলনকারী সাফফাত ফারদিন চৌধুরী বলেন, হোস্ট এরিয়া উখিয়া মগের মুল্লুক নয়, যখন যা খুশি সিদ্ধান্ত নেবেন। হোস্ট কমিউনিটির টিচারদের অন্যায়ভাবে অপসারণের চেষ্টা করা হলে আমরা ছাড় দেব না। সব কিছুর ফান্ড থাকে; হোস্ট কমিউনিটির বেলায় ফান্ড থাকে না, এই খেলা বন্ধ করতে হবে।
তবে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইউনিসেফ কর্মকর্তা এঞ্জেলা কার্নে বলেন, এখানে কোনো বৈষম্য নেই, এটা শুধুমাত্র তহবিল সংকটের কারণে নেওয়া সিদ্ধান্ত। আমাদের এখানে তিন হাজারের অধিক বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক কাজ করেন, যেখান থেকে শুধুমাত্র গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ ভুক্তরা থাকছেন না।
স্থানীয়দের চাকরি থেকে বাদ দিলে তার প্রতিক্রিয়া ভাল হবে না বলেই মনে করছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, এখানে যে চাকরিচ্যুতির বিষয় আছে, এতে আমাদের স্থানীয় লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১২-১৩ লাখ রোহিঙ্গার যে চাপ, তাতে স্থানীয়দের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারি তা এই ছোটোখাটো কিছু চাকরি দিয়ে। তারা যে এখানে আন্দোলন করছে, তার জন্য আমরা তো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছি।তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচিতির অন্যতম মাধ্যম হলো তাদের নিজ ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম। এটি বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ সরকারের পলিসি বিরুদ্ধে।
আমরা ইউনিসেফকে জানিয়েছি, সামগ্রিক বিষয়ে এবং সরকারের উপর মহলেও জানানো হয়েছে। তারা বলেছে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
যদি শিক্ষা কার্যক্রম ফের চালু হয় তবে ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের পাঠদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী কমিশনার বলেন, এটাও আমাদের পলিসি-বিরুদ্ধ, কারণ আমরা চাই রোহিঙ্গারা ইংরেজি শিখুক।
রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী টি কে অং মাইয়েং বলেন, লার্নিং সেন্টার বন্ধ হলে রোহিঙ্গা শিশুদের মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে। কারণ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় লার্নিং সেন্টারগুলো শিশুদের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় হয়ে আছে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিচ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মাস্টার মো. জোবায়ের বলেন, আমাদের রোহিঙ্গা শিশুরা বিশ্বের সবচেয়ে অসহায়। এদের কাছে শিক্ষাটা বিলাসিতা নয়, মানবিক সংকটের সময়ে এই অসহায় শিশুরা শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আশান্বিত হয়, নিয়মশৃঙ্খলা শেখে। কিন্তু যে ধরনের খবর শুনলার এটা আমাদের মর্মাহত করে।