বন্দীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি

28

কারাভ্যন্তরে বছরজুড়ে অবকাঠামোগত নির্মাণ কিংবা সংস্কারকাজ লেগেই থাকে পূর্ত বিভাগের। আর কারাগারের ভেতরে হাজার হাজার বন্দির সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও নজরদারির বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকেন মূলত কারারক্ষীরা। নির্মাণকাজকে ঘিরে কারাভ্যন্তরে পর্যাপ্ত সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনে শৈথিল্যের কারণে ছোটখাট দুর্ঘটনার পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে পড়ে। এতে কখনো কখনো সুরক্ষিত কারাগার হয়ে পড়ে অরক্ষিত। সম্প্রতি কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের পানিশমেন্ট ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে খুনের মামলার আসামি ফরহাদ হোসেন রুবেলের সংস্কারাধীন ৩২ নম্বর সেল ভবনের চারতলায় উঠে লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা কারাভ্যন্তরে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টিকে পুনরায় নতুন করে আলোচনার সামনে নিয়ে এসেছে।
জেল-পালানো বন্দি ফরহাদ দু’দিনের মাথায় নরসিংদীর দুর্গম চরাঞ্চলে ফুফুর বাড়ি থেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও তার পলায়ন-কান্ড নিয়ে কারা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের গঠিত পৃথক তদন্ত কমিটির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ দেখে কারা অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি ও পুলিশ কর্মকর্তারা বন্দি ফরহাদের সংস্কারাধীন ভবনের চারতলা থেকে লাফিয়ে কারাগারে সুরক্ষা প্রাচীর টপকে পালানোর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। তাছাড়া পুনরায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর বন্দি ফরহাদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে তার পালিয়ে যাওয়ার কারণ ও কৌশল সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। তাতে তার পালানোর বিষয়টি মোটামুটি পরিষ্কার। যে প্রশ্নগুলোর জবাব এখনও তদন্ত দলের কাছে স্পষ্ট নয়, তার মধ্যে অন্যতম হল কারাভ্যন্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কর্তৃপক্ষের কোনও ধরনের দুর্বলতা এবং বন্দি পালানোর ক্ষেত্রে কারা রক্ষীদের গাফেলতি কিংবা সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না। কারাভ্যন্তরে নির্মাণকাজকে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনও ধরনের শৈথিল্য রয়েছে কিনা- তা খতিয়ে দেখার বিষয়টিও নতুন করে সামনে এসেছে। কেননা, এর আগে ২০১৯ সালের ২৯ মে পূর্ত বিভাগের নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য রাখা ইট দিয়ে সুরক্ষিত ৩২ নম্বর সেলে মাথায় আঘাত উপর্যুপরি আঘাতে খুন করা হয়েছিল বন্দি অমিত মুহুরীকে। নির্মাণকাজের জন্য জড়ো করা ইট দিয়ে সুরক্ষিত সেলের ভেতরে নিজের কক্ষে চুলা বানিয়ে রান্না করে খেতেন পুলিশের তালিকাভুক্ত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী। পাহাড়তলীর সাগরিকা এলাকার অর্গানিক জিন্স নামের একটি পোশাক কারখানার কর্মী রিপন নাথকে অশোভন আচরণের জন্য কর্মস্থল থেকে ছাঁটাই করা হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ছুরি হাতে ওই কারখানায় ঢুকে কয়েকজন কর্মীকে জিম্মি করার অভিযোগে ওই বছরের ৯ এপ্রিল পাহাড়তলী থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আসেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়। অস্ত্র আইনের মামলায় প্রথমবার কারাবাসে অভ্যস্ত হয় রিপন। ওইসময় একাধিক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি হিসেবে দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়া অমিত মূহুরীকে নিজের কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় রান্নার চুলায় ব্যবহৃত ইট দিয়ে উপর্যূপরি আঘাতে হত্যা করে খুনের মত ভয়ঙ্কর অপরাধের খাতায় নিজের নাম লেখান।
বর্তমানে কারাগারের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন ৩২ নম্বর সেল ভবনটি দোতলা থেকে পাঁচতলা করার কাজ চলছে। গত ৬ মার্চ ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে কর্ণফুলী ভবনের চারতলার পানিশমেন্ট ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে নির্মাণাধীন ওই ভবনেরই চারতলায় উঠে লাফিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান অস্ত্র ও খুনের মামলায় বন্দি ফরহাদ হোসেন রুবেল। কারাগারে সাধারণত কারা-প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সকাল আটটার দিকে কর্মস্থলে আসেন। তারপরেই জেলার কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি জেলার কারাভ্যন্তরে রাউন্ড ডিউটিতে যান। বন্দিদের কাছে সুবেদার-জমাদার-মিয়াসাবসহ নানা নামে পরিচিতি কারারক্ষীরাই মূলত লকআপ ও আনলকের সময়সহ কারাভ্যন্তরের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও নজরদারির দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ওয়ার্ডের পাশাপাশি সুরক্ষা প্রাচীর ঘেঁষেও কারারক্ষীরা পালাক্রমে দায়িত্বে থাকেন। বন্দি ফরহাদ পালিয়ে যাওয়ার জন্য রাত পেরিয়ে ভোরের আনলকের সময়ই বেছে নেন।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত দলের প্রধান খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি (প্রিজন্স) ছগীর মিয়া পূর্বদেশকে বলেন, বন্দির পালানোর বিষয়টি তো মোটামুটি সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন আমরা কারাভ্যন্তরে কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনও ঘাটতি এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কারারক্ষীদের কারও অবহেলা বা গাফেলতি ছিল কি না সেসব বিষয় খতিয়ে দেখছি। আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৬ মার্চ কারাভ্যন্তর থেকে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান সদরঘাট থানার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আসা বন্দি ফরহাদ হোসেন রুবেল। নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার মীরের কান্দি গ্রামের শুক্কুর আলীর ছেলে রুবেলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নগরীর অপরাধপ্রবণ এসআরবি এলাকাতেই। এর আগে ২০১৮ সালেও তিনি অস্ত্র আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে এসেছিলেন। চলতি বছরের গত ৫ ফেব্রূয়ারি গভীর রাতে নগরীর সদরঘাটের আইস ফ্যাক্টরি রোডে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবুল কালাম আবু নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন সকালে কালাম মারা যান। কামাল হত্যার ঘটনায় সদরঘাট থানায় দায়ের হওয়ার খুনের মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ওইদিন রাতে নগরীর মিস্ত্রিপাড়া থেকে ফরহাদ হোসেন রুবেলকে গ্রেপ্তার করে পরদিন আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠায়। কারাগার থেকে তার পালানো-কান্ড নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ নগরীর কোতোয়ালী থানায় সকালে জিডি এবং রাতে মামলা দায়ের করে। পালানোর দুদিনের মধ্যেই পুলিশ নরসিংদীর দুর্গম চরাঞ্চলের ফুফুর বাড়ি থেকে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।