বন্দরের শ্রমিকদের ৪ দিনের কর্মসূচি

71

ফারুক আবদুল্লাহ

অর্থনীতির হৃদপিন্ড চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ইস্যুতে চলছে আন্দোলন। এরইমধ্যে বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারিরা চারদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। পৃথকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সোচ্চার রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। সবারই একই কথা বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল কোনোমতেই বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
এদিকে গত বুধবার চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি পরিদর্শনের সময় বন্দর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের হাতে বন্দর ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিতে হবে। সেটা যেভাবেই হোক। মানুষ রাজি না থাকলে তাদের রাজি করাতে হবে। মানুষকে রাজি করিয়েই সব করতে হবে। এরপর থেকে এনসিটি ইস্যুতে বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারি ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
এনসিটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এবার চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল (সাবেক সিবিএ) এনসিটি প্রাইভেটাইজেশনের দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চারদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় বন্দর এলাকায় মশাল মিছিল করে। একইভাবে আগামী ২৪ মে সকাল ১০টায় বন্দর বয়েজ স্কুলের সামনে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ, ২৫ ও ২৬ মে সকাল ১০টায় বন্দর ভবনের সকল গেটে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন শ্রমিকরা।
জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বন্দর শাখার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখছে সিসিটি ও এনসিটি টার্মিনাল। এরকম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কোনো ব্যক্তি কিংবা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চট্টগ্রাম বন্দর। একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়বে। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসরা এখনো চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বন্দরের টার্মিনালগুলো বিদেশিকে দেয়ার জন্য তাদের চক্রান্ত থেমে নেই। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসলে আমরা বন্দর অচল করে দেওয়ার মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবো।
তিনি বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ অবশ্যই চাই। যদি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়, তাহলে চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। আপনারা এই সমস্ত জায়গায় বিদেশি বিনিয়োগ আনুন। এতে আমাদের কোন সমস্যা নেই। তাই সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ বন্দরের বিভিন্ন গুরুত্ব স্থাপনা বিদেশিদের দেওয়ার ষড়যন্ত্র বন্ধ করুন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বন্দর শ্রমিক সংগঠনগুলোর এক যৌথসভায় সিসিটি, এনসিটি টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিকে দেয়ার সরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে শ্রমিক-জনতার দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আন্দোলনরত বন্দর-ডক শ্রমিক সংগঠনসমূহের নেতারা।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, সিসিটিসহ টার্মিনালগুলোতে প্রতিবছর কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির রেকর্ড হচ্ছে। কমছে বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান। প্রতিবছর মুনাফাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা সত্তে¡ও এখানে বিদেশি অপারেটরের হাতে বন্দর পরিচালনা ছেড়ে দেয়া হলে বন্দরের স্বার্থ তথা জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি শ্রমিক-কর্মচারীরা চাকরি হারানোর প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এসময় শ্রমিক নেতারা এনসিটি পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পদক্ষেপ বাতিলের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানান।
এই যৌথসভায় চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ হারুনের সভাপতিত্বে বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে- বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল, বন্দর ইসলামী শ্রমিক সংঘ, স্টাফ ইউনিয়ন, ল্যাসিং আন-ল্যাসিং শ্রমিক ইউনিয়ন, স্টাফ হাউজ, ওয়াচম্যান শ্রমিক সংগঠন।
এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার বলেন, এনসিটি টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে বন্দরের শ্রমিক সংগঠনগুলো একযোগে সোচ্চার। এই ইস্যুতে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে নিতে একমত শ্রমিক নেতারা।
এছাড়া এনসিটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ‘চক্রান্ত’ এর বিরুদ্ধে পৃথকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে রয়েছে- বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, ১২ দলীয় জোট, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণসংহতি আন্দোলন। তাদের সবারই একই কথা হলো- দেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ এনসিটি টার্মিনাল কোনোমতেই বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চালু রয়েছে চারটি কন্টেইনার টার্মিনাল। এর মধ্যে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) সবচেয়ে বড়। গত বছর বন্দরের মোট কন্টেইনারের ৪৪ শতাংশ উঠানো-নামানো হয়েছে এই টার্মিনালে। এতে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কন্টেইনার জাহাজ ও একটি ছোট জাহাজ ভিড়ানো যায়। আর এনসিটিতে অত্যাধুনিক যন্ত্র ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ আছে ১৪টি। যা দিয়ে জাহাজ থেকে কন্টেইনার উঠানো-নামানো হয়। গত বছর এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে ১২ লাখ ৮১ হাজার কন্টেইনার উঠানো-নামানো হয়।
এছাড়া এনসিটি টার্মিনালের চেয়ে ছোট আরও তিনটি টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে নিউমুরিং টার্মিনালের পাশে চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) গত বছর ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থ বা জিসিবিতে ৩৭ শতাংশ কন্টেইনার উঠানো-নামানো হয়।