নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে দুটি অভয়ারণ্য ও একটি জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে বয়ে গেছে ২৭ কিলোমিটার রেললাইন। ‘দোহাজারি হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মায়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্রাক নির্মাণ’ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য ২০৭ দশমিক ১৩৭৫ একর বনভূমি ডি-রিজার্ভ করে বরাদ্দ দেয় বন বিভাগ। পরবর্তীতে রেললাইন তৈরিতে বরাদ্দকৃত বনভূমি থেকে কাটা পড়ে আট লক্ষ ৪২ হাজার ২৩৪টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এ প্রকল্পে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের প্রায় ২০১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হবে বলেও আগেভাগে মতামত দেয় বন বিভাগ। যে কারণে ২০১৯ সালের ২৩ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে চারটি শর্তে বরাদ্দকৃত বনভূমি আর সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে গণ্য হবে না মর্মে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এসব শর্তের তিনটিই মানা হয়নি বলে দাবি করছে বন বিভাগ। রেলওয়ে বলছে, শতভাগ শর্ত মানা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত চারটি শর্তের প্রথমটি হলো বরাদ্দকৃত বনভূমিতে যে গাছপালা ছিল সেগুলো বাবদ দশ কোটি ৮৭ লক্ষ ৪২ হাজার ৫৩০ টাকা রেলওয়ে কর্তৃক পরিশোধ করা। দ্বিতীয় শর্ত, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিপূরণ কল্পে যে পরিমাণ গাছের ক্ষতি হবে তার তিন গুণ গাছ বন অধিদপ্তরের তত্ত¡াবধানে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক রেললাইনের উভয় পাশে রোপণ করতে হবে। যা পরবর্তী দশ বছর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এ সকল রোপিত বৃক্ষের যাতে কোন ক্ষতি না হয় বন অধিদপ্তরের তত্ত¡াবধানে বাংলাদেশ রেলওয়েকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় শর্ত, বন্যহাতিসহ সকল বন্যপ্রাণীর নিরাপদ চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণের বিষয়টি রেলওয়ে নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থ শর্ত, রেলগাড়ির শব্দ বনাঞ্চলে থাকা বন্যপ্রাণীর যাতে কোন সমস্যা না হয় সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশে রেলওয়ে কর্তৃক সাউন্ড ব্যারিয়ার নির্মাণ করতে হবে। এরমধ্যে প্রথম শর্তটি ছাড়া বাকি তিনটি শর্তই অমান্য করেছে রেলওয়ে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ পূর্বদেশকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে বনাঞ্চলের ভেতর দিয়েই গেছে ২৭ কিলোমিটার ট্রেন চলাচল করে। রেলওয়ের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চারটি শর্তে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জায়গা ডি-রিজার্ভ করে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু গাছের ক্ষতি বাবদ টাকা পরিশোধ করা হলেও বাকি শর্তগুলো মানা হয়নি। এজন্য আমরা প্রকল্প শেষের আগেই বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে জানিয়েছি। সেখানে প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তিনগুণ গাছ লাগানোর কথা থাকলেও বন বিভাগের সাথে পরামর্শ করে সে পরিমাণ গাছ লাগানো হয়নি। এই বনাঞ্চলে যেখানে অর্জুন, চাপালিশ, আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, বৈলাম, ডমুরের মতো দেশীয় গাছ লাগানো প্রয়োজন ছিল। হাতি চলাচলে কিছু শর্ত ছিল সেগুলো না মানার কারণেই একটি হাতির মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য আমরা বলার পর এখন রেল ক্যামেরা বসিয়ে হাতির মুভমেন্ট মনিটরিং করছে। রেললাইনটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পূর্বদিকে হলে এই বনাঞ্চল বাঁচানো যেতো।’
বন বিভাগ জানায়, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ১০.৩ কিলোমিটার, চুনতি অভয়ারণ্যে ১৫.৮ কিলোমিটার ও মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে ০.৯ কিলোমিটার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন গেছে। এই বনাঞ্চলের বুক চিরে রেললাইন যাওয়ার কারণে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সাত লক্ষ ৪২ হাজার ৮৬৪টি এবং সৃজিত ৯৯ হাজার ৩৭০টি গাছের ক্ষতি বাবদ দাবিকৃত অর্থ যথাসময়ে পরিশোধ করা হয়। শর্তে যে গাছের ক্ষতি হয়েছে তার তিন গুণ অর্থাৎ ২৫ লক্ষ ২৬ হাজার ৭০২টি দেশীয় প্রজাতির গাছ বন অধিদপ্তরের তত্ত¡াবধানে রোপণের কথা থাকলেও সে পরিমাণ গাছ লাগানো হয়নি। বন বিভাগকে অবহিত না করেই সেখানে আকাশমনি, রেইনট্রি, মেহগনি গাছ রোপন করা হয়েছে। রোপিত গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণেও রেলওয়ের কোন উদ্যোগ নেই। বন্যহাতিসহ সকল বন্যপ্রাণীর নিরাপদ চলাচলে আন্তর্জাতিকমানের ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণের শর্ত থাকলেও সেটি নিশ্চিত করতে পারেনি রেলওয়ে। রেললাইনে যে ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো চলাচলরত হাতি ব্যবহার করে না। হাতিগুলোর মুভমেন্ট দেখার জন্য রেলকে বলা হয়েছে। হাতিগুলো যেদিকে যেতে চায় সেদিকেই যেতে দিতে হবে। সেটা নিশ্চিত না করে অপরিকল্পিভাবে ওভারপাস ও আন্ডারপাস করা হয়েছে। যে কারণে গত ১৩ অক্টোবর একটি হাতি রেললাইনে উঠে গেলে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। বনের ভেতর ট্রেন চলাচলে শব্দদূষণের বনাঞ্চলে থাকা বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে। বনের ভেতর রেলের হরণ বাজানো বন্ধ ও গাড়ির গতি ২০ কিলোমিটারের অধিক বাড়ানো যাবে না।
বন কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পটি বাস্তবায়নকালে বন বিভাগের সাথে ভালোভাবে যোগাযোগ রাখেনি। প্রথম থেকে এ প্রকল্প নিয়ে তাগাদা দেয়া হলেও তারা কর্নপাত করেনি। বন বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা তপন কান্তি দে’কে তারা বিশেষজ্ঞ হিসেবে রেখেই সব কাজ করেছেন। মূলত সাবেক ওই কর্মকর্তাকে ব্যবহার করে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করেছেন। এখনো প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বন বিভাগের পরামর্শ না নেওয়ার বিষয়ে বলা হলে তারা সাবেক ওই বন কর্মকর্তার কথা বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। সেসময় বন বিভাগের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো, ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করলে এমনটি হতো না।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সবুক্তগীন পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রকল্প কাজ প্রায় শেষের দিকে। আমি প্রকল্পে যোগদানের আগেই বেশিরভাগ কাজ শেষ। ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রকল্প শেষ হওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন সমাপনী রিপোর্ট রেডি হচ্ছে। বন বিভাগের সাথে আমাদের কোন জটিলতা নেই। যে চুক্তি হয়েছিল সে মোতাবেক সব হয়েছে। কোন ফাঁকফোকর নাই। কিছু ভুল বুঝাবুঝির কারণে জটিলতা বেড়েছে। আমরা ইতোমধ্যে যৌথভাবে প্রতিবেদনও দাখিল করেছি। শতভাগ শর্ত আমরা পালন করেছি। বিশেষায়িত বাগান করেছি। বন বিভাগ কিছু টাকা চায়, যা আমরা অফিসিয়াল চিঠি ছাড়া দেয়া যাবে না বলেছি। অফিসিয়াল চিঠি পেলেই সেটি চিন্তাভাবনা করবো। এই প্রকল্পে আমরা কি পরিমাণ গাছ লাগিয়েছি তা ভিডিও দেখলেই বুঝবেন। এ প্রকল্পের ১০০ কিলোমিটার বনাঞ্চলের ভিডিও সংরক্ষিত আছে। বলার জন্য কথা বললে হবে না। ভিডিও দেখলেই সব পরিষ্কার হবে।’
গত ১৩ অক্টোবর রেললাইনে কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনের ধাক্কায় হাতি মৃত্যুর ঘটনার পর ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটিতে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের দুইজন, রেলওয়ে অধিদপ্তরের তিনজন ও বন বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে রাখা হয়। একই সাথে রেলওয়ের পক্ষ থেকেও বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা চট্টগ্রামকে আহŸায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ইতোমধ্যে ট্রেন চালককে বরখাস্তও করা হয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প কাজ শুরু হয়।