বদর দিবসের ঐতিহাসিক বিজয়

1

মাহমুদুল হক আনসারী

আজ ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ ও প্রথম বিজয়ের দিন আজ। পৃথিবীতে ইসলাম থাকবে কি থাকবে না- এ ফয়সালা হয় বদরের রণাঙ্গনে ঐতিহাসিক এ যুদ্ধের মাধ্যমে। জেহালতের তিমিরাচ্ছন্নতার অবসান ঘটিয়ে একাত্মবাদের ঝান্ডু নিয়ে শান্তি ও সফলতার চাদরে আচ্ছন্ন ঐশী নূরের আলোকে জগৎবাসীর জন্য ইসলামের মতো মহান পবিত্র নেয়ামতের সুশীতল ঝরনাধারা প্রবাহমান থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়েছিল বদরের প্রাঙ্গণ থেকেই; এ জন্যই মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে তাই মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বদর দিবসকে ‘য়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বস্তুত মহানবী (সা.) যুদ্ধপ্রবণ মানুষ ছিলেন না। কিন্তু তৎকালীন অমুসলিম শক্তির নানামুখী ষড়যন্ত্র, নির্যাতন আর ইসলামকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়ার অপপ্রয়াসের মোকাবিলায় রাসুলে পাক (সা.)-এর হাতে যুদ্ধ ব্যতীত আর কোনো বিকল্প ছিল না। তাওহিদ ও রেসালতের প্রতি আনুগত্যকারী মোহাজের ও আনসারগণের সমন্বয়ে অসম সাহসী সাহাবায়ে কেরামের এক প্রত্যয়দীপ্ত বাহিনী বিশ্বনবীর (সা.) নেতৃত্বে নজিরবিহীন বীরত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন বদরের প্রান্তরে। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের সাথী হয়েছিল মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত রহমত, মদদ ও সুসংবাদ সংবলিত বার্তাবলির অমোঘ শক্তিমত্তা। পবিত্র কোরআনের সুরা আলে ইমরানে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন- ‘ওয়ালাকাদ নাসারাকুমুল্লাহু বিবাদরিন ওয়া আন্তুম আযিল্লা’ অর্থাৎ সুনিশ্চিতভাবেই মহান আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে, যেখানে তোমরা ছিলে ক্ষীণ-শক্তির দুর্বল এক পক্ষ। মূলত মুসলমানদের সংখ্যা, যুদ্ধাস্ত্র, সমর উপকরণ, শক্তিমত্তা ও সমর-কৌশলের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো মহান প্রভুর সাহায্য ও রহমতের বিষয়; যার ওপর প্রতিটি মুমিন সর্বাবস্থায় ভরসা করবে, নির্ভরতা পাবে। আল্লাহপাক সেজন্যই বলেছেন- ‘ওয়া কানা হাক্কান আলাইনা নাসরুল মুমিনিন’ অর্থাৎ মোমেনদের সহযোগিতা প্রদান করা আমি আল্লাহর জন্য অবশ্য কর্তব্য।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিনের মাথায় মদিনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৮০ মাইল দূরত্বে অনুষ্ঠিত হয় বদরের যুদ্ধ; দিনটি ছিল দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান শুক্রবার। পরিসংখ্যানগত বিশ্নেষণে দেখা যায়, মুসলিম বাহিনীর চেয়ে অমুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যাই ছিল প্রায় তিন গুণ; অমুসলিমদের অন্যান্য রসদ ও উপকরণ ছিল আরও বেশি। অমুসলিম সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও অধিক, সঙ্গে ছিল ১০০ ঘোড়া, শতাধিক উট, ছয় শতাধিক লৌহবর্মসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র। পক্ষান্তরে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, সঙ্গে যুক্ত ছিল ৭০টি উট ও মাত্র দুটি ঘোড়া; কিন্তু মুসলমানদের ছিল বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্ব এবং মহান আল্লাহর সাহায্য। এই অসম যুদ্ধে কল্পনাতীত পরাজয় বরণ করে মহাসত্য অস্বীকারকারী কুফর প্রতিপক্ষ এবং অবিশ্বাস্য বিজয় লাভ করেন একাত্মবাদের পতাকাবাহী আল্লাহপাকের অনুগত মজলুম বান্দারা। কুফরি শক্তির ৭০ জন হত্যার শিকার হয়, ৭০ জন মুসলমানের হাতে বন্দি হয় এবং মানবেতিহাসে রচিত হয় মাআজ ও মোআওয়াজ নামের প্রত্যয়দীপ্ত দুই কিশোর সহোদরের এক অতুলনীয় বীরত্বগাথা! যেই কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাফেরদের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা আবু জেহেলের মৃত্যু; বদরের প্রান্তরে এই একটি হত্যাকান্ড ইসলামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা অধিক তাৎপর্যের দাবি রাখে। কেননা ইসলামকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া ও মহানবী (সা.)-কে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়েছে এই নিকৃষ্ট মানব আবু জেহেল। ইসলামের প্রথম যুদ্ধেই উপরোক্ত দুই কিশোরের হাতে তার জীবনাবসান ঘটে। ফলে ইসলাম এক দুর্ধর্ষ, চতুর ও অমানবিক পাষন্ডর অনিষ্ঠ থেকে রক্ষা পায়। মক্কি জীবনে রাসুল (সা.)-এর একান্ত অনুগত হাবশি বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ হজরত বেলালের সঙ্গে অমানবিক নিষ্ঠুুরতা প্রদর্শন ও নির্মম নির্যাতন করেছিল তার মুনিব উমাইয়া ইবন খালফ; বদরের রণাঙ্গনে এই পাষন্ড উমাইয়া তারই দাস নিপীড়িত ও মাজলুম হজরত বেলাল (রা.)-এর হাতেই নিহত হয়। হজরত উমর (রা.)-এর হাতে নিহত হয় তার আপন মামা; এভাবেই বদরের প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব থেকে শুরু করে অংশগ্রহণকারী সদস্য পর্যন্ত সবাই মহান প্রভুর সন্তুষ্টি বিধান, নবপ্রবর্তিত ইসলামের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা এবং তাদের প্রাণাধিক প্রিয় রাসুলে আকরাম (সা.)-এর নির্দেশনা বাস্তবায়নে নজিরবিহীন আনুগত্য ও বীরত্বের পরিচয় দেন। নবপ্রবর্তিত ইসলাম, মহানবী (সা.) ও মহান আল্লাহপাকের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কিছু মকবুল মানুষের বিশ্বাস, কর্তব্য-নিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতির বিস্ময়কর মঞ্চায়ন ঘটেছিল বদরের যুদ্ধে। ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার এ মরণপণ যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন নবীজির চাচা আমির হামজা (রা.), হজরত আলী (রা.) ও হজরত উবায়দা বিন হারেস (রা.)। যুদ্ধের সূচনাপর্বে ব্যক্তি পর্যায়ে এই তিনজন বীর সেনানীকে মোকাবিলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল প্রতিপক্ষের শায়বা, ওয়ালিদ ও ওতবা; ইসলামের মহান তিন বীর প্রচন্ড বিক্রমে এদের তিনজনকে শুরুতেই হত্যা করেন। এরপরই শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক যুদ্ধ; মহানবী (সা.) মুসলিম বাহিনীকে অমিত বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তেজদীপ্ত, উজ্জীবিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুফর বাহিনীর মাঝে চরম হতাশা, নৈরাশ্য ও পরাজয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে; তারা আর কোনোভাবেই টিকে থাকার শক্তি, সাহস ও রসদ খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে যুদ্ধের পরিণাম আরও স্পষ্টতর হয়ে যায়, এক পর্যায়ে সম্মিলিত কুফর বাহিনী করুণ পরিণতি বরণ করে; এর ফলশ্রæতিতে শুধু মক্কা-মদিনাতেই নয় বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলাম এক নতুন অভিনব শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং মুসলমানদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বলতর হয়, যা থেকে পরবর্তীতে তারা অধিকতর উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণামূলক অফুরান শক্তি লাভ করেন। মহান আল্লাহ ভবিষ্যতের জন্য তাওহিদবাদীদের এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সুরা আলে ইমরানে সুসংবাদ দেন যে, ‘বরং তোমরা যদি সবর এখতিয়ার করো, মহান আল্লাহকে ভয় করার নীতি অবলম্বন করে চলো, তবে বিপক্ষ শক্তি তোমাদের ওপর দ্রুত হামলা করলেও আল্লাহপাক তোমাদের ৫ হাজার ফেরেশতার এক সুবিন্যস্ত বাহিনী দ্বারা সহযোগিতা করবেন।’ মহান আল্লাহ প্রদত্ত ফেরেশতা বাহিনীর এই সহযোগিতার কথা সুরা আনফালেও এসেছে, ‘যদি তুমি দেখতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখমন্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এবং বলছে যে, তোমরা এবার দহন যন্ত্রণা ভোগ করো।
যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে মুসলিম বাহিনী তিন দিনের মাথায় মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মহানবী (সা.) যে সৎব্যবহার ও সুন্দর আচরণ করেছিলেন তা মানবেতিহাসের এক অনবদ্য নজির হয়ে আছে। সাহাবায়ে কেরাম বন্দিদের সঙ্গে নবীর নির্দেশনা অনুযায়ী সদাচার চালিয়ে যান। ইতোমধ্যে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে করণীয় বিষয়ে রাসুলের নেতৃত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়; হজরত উমর (রা.) সে বৈঠকে যুদ্ধবন্দি সবাইকে হত্যার পক্ষে মত দেন। অন্যদের মধ্যে বৈঠকে হজরত আবু বকর (রা.) যে বিজ্ঞজনোচিত মতামত প্রদান করেছিলেন, রাসুলে পাকের কাছে তাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল; সেটি ছিল, মুক্তিপণ নিয়ে বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া। সে মতে বৈঠকে মুক্তিপণ দিয়ে যুদ্ধবন্দিরা মুক্ত হতে পারবে, এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাসুল (সা.) ১ থেকে ৪ হাজার দিনার পর্যন্ত মুক্তিপণের অর্থ নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণের ব্যাপারে মহানবী (সা.) তার দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ চিন্তাধারার আলোকে এক শিক্ষাবান্ধব মনমানবের পরিচয় দিয়েছেন; সেটি হলো, বন্দিদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তারা মুক্তিপণ হিসেবে প্রতিজন মদিনার ১০ জন অশিক্ষিত ব্যক্তিকে শিক্ষাদানের শর্ত লাভ করেন। অবশ্য অপরাধীর ধরন ও অবস্থা বিবেচনায় রাসুলে পাক (সা.) বেশ কয়েকজন বন্দিকে কোনো প্রকার মুক্তিপণ ব্যতিরেকেই ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং নাদার ইবনে হারিস ও উকবা ইবনে আবু মুআইত নামে দু’জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দেন।
স্বল্পসংখ্যক প্রত্যয়ী, বিশ্বাসী ও আত্মনিবেদিত মানুষ যে বিশাল শত্রুপক্ষের মোকাবিলায় বিজয় লাভে সক্ষম হতে পারে, ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলাম বদরের সিঁড়ি বেয়ে এভাবেই মহান আল্লাহর রহমত ও মদদে অত্যন্ত দ্রুতবেগে সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছিল এবং পরিণত হয়েছিল জগতের সবচেয়ে দ্রæত বর্ধনশীল এক জীবনবিধান রূপে। আল্লাহপাকের বাণী- ‘নাসুরম্ মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব’ অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্য ও তোমাদের বিজয় অত্যাসন্ন, অতি নিকটে; ইতিহাস সাক্ষী, স্বল্পকালের ব্যবধানেই মহান রবের এ ঘোষণার পরিপূর্ণ সফল বাস্তবায়ন জগদবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল।
আমাদের প্রত্যাশা, ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রভাব, গুরুত্ব ও তাৎপর‌্য উপলব্ধি করে আমরা নিজেদের চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে শান্তি, কল্যাণ ও মানবতার ধর্ম ইসলামের মহানত্ব ও মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে তুলি। এই যুদ্ধে শহিদ সকল বীর সৈনিকের মাগফেরাত শান্তি কামনা করছি। আমিন।

লেখক : সংগঠক, গবেষক ও কলামিস্ট