বজ্রপাতে প্রাণহানি এবং আমাদের করণীয়

1

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

এখন ভয়ংকর দুর্যোগের নাম বজ্রপাত! এই বজ্রপাতে প্রাণহানি-আহতের সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৮ এপ্রিল সোমবার একদিনেই দেশে বজ্রপাতে কুমিল্লায় ২ শিক্ষার্থীসহ প্রায় ১৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বজ্রপাতের মাত্রা। পরিণত হচ্ছে জাতীয় সমস্যায়। প্রায় প্রতি বছরই বজ্রপাতে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার উদ্বেগজনক পরিস্থিতির অবসান হয়নি।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই এপ্রিল থেকে জুন মাসে সংঘটিত হয়। তবে এত প্রকল্প নেওয়া সত্তে¡ও বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমছে না। বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, বজ্রপাত বেশি হয় হাওর অঞ্চলে। বিশেষ করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায়। মৌসুম শেষে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে। শীতকালে সাতক্ষীরা, খুলনা ও পটুয়াখালী অঞ্চলে বজ্রপাতের হার বেশি। বজ্রপাতের নির্দিষ্ট সময়-স্থান নির্ধারণ কঠিন। আবহাওয়ার পরিবর্তনশীলতার কারণে একেক সময় একেক এলাকায় বজ্রপাতের মাত্রা বেড়ে যায়।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বজ্রপাতে ৪৯ শতাংশ মৃত্যু কৃষি ক্ষেতে ঘটেছে। ফোরামের পরামর্শ, পাঠ্যপুস্তকে বজ্রপাতবিষয়ক অধ্যায় যুক্ত করা, কৃষক ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সভা-সেমিনার আয়োজন, মাঠে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং বজ্রপাত পূর্বাভাস প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশের বজ্রপাত পরিস্থিতি এবং হতাহতের ঘটনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৪ হাজার ১৫৮ জনের। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২৯৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৩৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টাল থেকে সংগ্রহ করা তথ্য থেকে তৈরি ওই তালিকা অনুসারে, ২০২৪ সালে বজ্রপাতে ২৮৮ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ২০৭ পুরুষ, ৩৩ নারী এবং শিশু ৪৮ জন। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১২৩। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪ জন মারা গেছেন। এ মৃতদের মধ্যে ১৭ জনই কৃষক। সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল এক দিনের মারা গেছেন অন্তত ১২ জন। জাতিসংঘ বলছে,বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০০ জন বজ্রপাতে মারা যায়। বাংলাদেশে গাছপালা কেটে ফেলা বিশেষ করে খোলা মাঠে উঁচু গাছ ধ্বংস করে ফেলা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়া এবং অসচেতনতার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানোর জন্য তালগাছ লাগানোর প্রকল্প, লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর (সংকেতব্যবস্থা), লাইটনিং অ্যারেস্টার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা সফল হয়নি।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এটি জলবায়ুগত এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের পরিবর্তনের ফল। অন্য যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না।
২০২০ সাল থেকে দেশে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর রূপ দেখা দিয়েছে। সাধারণত এপ্রিল মাসকে বজ্রপাত শুরুর মাস হিসাবে ধরা হয়। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রপাত হয়। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল মাসেই বজ্রপাতে মারা গেছে কমপক্ষে ৭০ জন। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চার গুণ।
বজ্রপাতের ক্ষেত্রে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিল ২০১৬ সাল। ওই বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাত হয়। মারা যান প্রায় ২৬৩ জন মানুষ।
বৃষ্টিবাদলের দিনও মানুষকে কাজে বের হতে হয়। কোন উপায় থাকেনা। বিশেষ করে যারা ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন তারাই বেশি বজ্রপাতের শিকার হচ্ছে। এমনিতে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশ। এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ইতিপূর্বে বহু মানুষ মারা গেছে। গরু, ছাগলসহ বহু প্রাণিও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের ঘরবাড়ি। এখন নতুন করে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সতর্ক, সচেতনতা। পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের মাঝে বজ্রপাতের কারণ ও তা থেকে বেঁচে থাকার বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। বজ্রপাত প্রতিরোধে ব্যাপকহারে তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে।
আকাশে মেঘ দেখলেই ভয় লাগে। কখন আবার বজ্রপাত শুরু হয়। একসময় দেখতাম বর্ষাকালে বজ্রপাত ও বাতাসবিহীন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজত গোটা জনপদ। নির্ভয়ে মানুষ চলাচল করত। প্রয়োজনীয় কাজে মানুষ নি:সংকোচে বের হত। এখন দেখি বর্ষাকালেও বজ্রপাতযুক্ত বৃষ্টি হয়। বের হতে ভয় লাগে। আমি মনে করি, প্রকৃতির এমন আচরণ আমাদের হাতে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণেই। আমরাই ডেকে আনছি দুর্যোগ, সংকট। এ থেকে বাঁচার উৎকৃষ্ট উপায় আমাদেরকেই বের করতে হবে। নয়তো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমাদের পরবর্তি প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারবোনা বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত একটি পৃথিবী।
বজ্রপাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু উপায় বাতলে দিয়েছে স্বাস্থ্যঅধিদপ্তর। যেমন-
* বজ্রঝড় সাধারণত ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করুন। অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাবেন, এটি বজ্রঝড় বা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেবে।
* বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে যদি থাকেন তাহলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে।
* বজ্রপাতের আশংকা দেখা দিলে যত দ্রæত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের ছাদে বা উঁচু ভূমিতে যাওয়া উচিত হবে না।
* বজ্রপাতের সময় যে কোন ধরণের খেলাধুলা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে।
* খালি জায়গায় যদি উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ার থাকে, তার কাছাকাছি থাকবেন না। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকা বিপজ্জনক ।
* বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়াই উচিৎ হবে। সমুদ্রে বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
* যদি কেউ গাড়ির ভেতর অবস্থান করেন, তাহলে গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ রাখা যাবে না।
আসুন, আমরা বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সতর্ক ও সচেতন হই। মেনে চলি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট