বছরজুড়ে আতঙ্ক ‘খাল-নালায় মৃত্যু’

187

ওয়াসিম আহমেদ

গত পাঁচ মাসে উন্মুক্ত খাল-নালায় পড়ে মারা গেছেন পাঁচ জন। এক জনের লাশ অবধি খোঁজে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া স্বামীর মোটরসাইকেলে করে কোচিং থেকে বাসায় ফেরার পথে গর্তে পড়ে ছিটকে পড়েন গৃহবধূ। তাতেই পেছন থেকে আসা লরি চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। বহদ্দারহাট ও আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পে ফাটল সদৃশের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ।
পারষ্পরিক দোষারোপ, চিঠি-চালাচালি, কমিঠি গঠন আর প্রতিবেদন দাখিলে পার হয়ে যায় পুরো অর্ধেক মাস। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এসব ফাটল বলে স্বীকৃত না হলে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে পথ চলতে এখনও আঁতকে উঠে নগরবাসী। উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে জননিরাপত্তা নিশ্চিতে অনীহা, সেবা সংস্থাগুলো লোক দেখানো কর্মকাÐের কারণে গ্রহনযোগ্যতা হারিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘অবহেলায় যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়’ নগরীর ডিটি সড়কে গতিরোধক ও সংস্কারের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে এ রকম প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত ৫ নভেম্বর এ মানববন্ধন হয়। এর মধ্যে ২২ দিন কেটে গেলেও তাঁদের সে দাবি মানার গরজ করেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এলাকাবাসীর আশঙ্কাই সত্যি হলো। কর্তৃপক্ষের অবহেলার খেসারত দিতে হলো কলেজছাত্রী সাদিয়া আফরোজকে। বেহাল সড়কের গর্তে পড়ে প্রাণ যায় তাঁর। গত ২৫ নভেম্বর সকালে স্বামীর মোটরসাইকেলে করে কোচিং থেকে বাসায় ফিরছিলেন সরকারি কমার্স কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া আফরোজ। পথে মনসুরাবাদ এলাকায় ডিটি সড়কের একটি গর্তে পড়ে যায় মোটরসাইকেল। ছিটকে পড়েন সাদিয়া। এ সময় পেছন থেকে আসা লরি চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দুই মাস আগে বিয়ে হওয়া সাদিয়ার। এ ছাড়াও ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের পোর্ট কানেক্টিং (পিসি) রোডে গর্তে পড়ে প্রাইম মুভার ট্রেইলর উল্টে সিএনজি অটোরিকশাকে চাপা দেয়। এতে সিএনজি আরোহী তিনজন মারা যান।
গত ২৫ আগস্ট মুরাদপুরে বৃষ্টির পানিতে নিখোঁজ হওয়া ছালেহ আহমেদের (৫০) খোঁজ আর মেলেনি। তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভান্ডার দরবার শরিফে যাওয়ার জন্য মুরাদপুরে এসেছিলেন। ওখান থেকে বাসে করে দরবার শরিফে যাওয়ার কথা ছিল। সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ নিখোঁজের ঘটনায় সিডিএ ও সিটি করপোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করেছিল তদন্ত কমিটি। শুধু কি মুরাদপুর, নগরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নালা আর খালগুলো ২০২১ সালে অন্তত পাঁচজনের প্রাণহানির সাক্ষী। কী বর্ষা, কী গ্রীষ্ম বছরজুড়ে রীতিমতো আতঙ্কে দিন পার করেছেন ভুক্তভোগীরা। চশমা খালেই পড়ে মৃত্যু হয় জনের। পথশিশু মোহাম্মদ কামালের ছবি হাতে চশমা খালের পাড়ে বিলাপ করছিলেন ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ বাবা কাউসার। কামাল বন্ধুর সঙ্গে প্লাস্টিকের বোতল কুড়াতে খালে নামে। একপর্যায়ে আবর্জনার স্তূপের নিচে তলিয়ে যায়। একজন উঠতে পারলেও কামাল শক্তিতে পেরে উঠেনি। তলিয়ে যায় সে। ষোলশহর ভূমি অফিসের পাশের চশমা খালে কামাল নিখোঁজ হলেও তিন দিন পর গত ৬ ডিসেম্বর ছোট্ট শিশুটির নিথর দেহ উদ্ধার করা হয় মুরাদপুরের মির্জা খাল থেকে। গত ৩০ জুন মেয়র গলি এলাকায় টিঅ্যান্ডটি কলোনির বাইলেন দিয়ে যাওয়ার সময় চশমা খালে পড়ে গিয়েছিল একটি সিএনজি অটোরিকশা। বৃষ্টির কারণে খালটি তখন ছিল পানিতে টইটম্বুর। পাহাড়ি ঢলের স্রোতও ছিল প্রচন্ড। সেই স্রোতে ভেসে যান চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)। পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
চশমা কিনে মামার সঙ্গে বাসায় ফেরার পথে গত ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে এক টন আবর্জনা পরিষ্কারের পর উদ্ধার হয় সাদিয়ার মরদেহ। ভাগনিকে উদ্ধারের জন্য মামা সঙ্গে সঙ্গে নালায় লাফ দেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। নালায় তরুণী পড়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। নালার বিভিন্ন অংশে খোঁজাখুঁজি করেন ডুবুরি দলের সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে নিখোঁজ হওয়ার স্থান থেকে ৩০ গজ দ‚রে ওই নালা থেকে নিথর মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। এরপর তা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
স‚ত্র জানায়, নগরে ৫৭টি খাল ও ছয়শ’ নালা রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্দতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের অধীনে রয়েছে বড় খাল ও বড় নালাগুলো। বাকি খাল ও নালা দেখভাল ও পরিষ্কারের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)। সিডিএ ও চসিকের সমন্বয়হীনতা, প্রকল্প এলাকায় বেড়া না দেওয়াসহ নানা কারণে খাল ও নালায় পড়ে মানুষ আহত এমনকি নিহতও হচ্ছে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়া, সিডিএর মাস্টারপ্ল্যান উপেক্ষা করা, সেবা সংস্থাগুলোর ইউটিলিটি সার্ভিসের পাইপ লাইনগুলো নালার মাঝ বরাবর নিয়ে যাওয়া, অপচনশীল প্লাস্টিক, ফোম, পলিথিনসহ গৃহস্থালি বর্জ্যে খাল ও নালা ভরে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে। জানা গেছে, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর অধীন বড় এই প্রকল্পটি গ্রহণের পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু হয়। একই সঙ্গে কালুরঘাট থেকে চাক্তাই পর্যন্ত সড়ক-কাম-বেড়িবাঁধ জলাবদ্ধতা নিরসনের অপর প্রকল্পটিও সিডিএ বাস্তবায়ন করছে। এই দুটি প্রকল্পের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীন নতুন খাল খননের একটি প্রকল্প এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরেকটি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে সিডিএর মেগা প্রকল্পের কাজ করার সময় নালার ওপর থেকে স্ল্যাব সরানো হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের অধীনে সিডিএ যেসব খালের কাজ করছে সেখানেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার জানান, চসিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছেন। উন্মুক্ত নালা-নর্দমায় স্ল্যাব বসানোসহ এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে জনগণকে রক্ষার জন্য তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে। চসিককে জরুরিভিত্তিতে সরকারের সহযোগিতা নিতে হবে। সিডিএ জলাবদ্ধতার বড় প্রকল্পটি বাস্তবায়নকাজ করলেও তাদের কাজে বিলম্বের কারণে নানা সমস্যা হচ্ছে। সিডিএ ও চসিক তাদের দায় এড়াতে পারে না।