ড. মো. রফিকুল ইসলাম
মানুষের আলোকিত জীবনের উপকরণ হচ্ছে বই। তাই জগতে শিক্ষার আলো, নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সবই জ্ঞানের প্রতীক বইয়ের মধ্যে নিহিত রয়েছে। মানবজীবন নিতান্তই একঘেয়ে দুঃখ-কষ্টে ভরা। কিন্তু মানুষ বই পড়তে বসলেই সে সব ভুলে যায়। তাই আজকের পৃথিবীতে বিনোদনের কত না কিছুই আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু বই পড়ার নির্মল আনন্দের কাছে সেগুলো সমতুল্য কখনো হতে পারেনি। তবে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক কোনো মজাদার বইয়ের বিষয়বস্তু বা ঘটনা মানুষ সহজে সব ভুলে যায় না। অন্যদিকে জীবনের অবসরের অফুরন্ত সময়গুলো বইয়ের নেশায় ডুবে থাকাই শ্রেয়। এতে জীবনের সকল সমস্যা ও ব্যর্থতা ভুলে থাকা যায়। বিশেষ করে পৃথিবীতে কোটি কোটি বইয়ের সমারহ ঘটছে। যা এক জীবনে সে সব বই পড়ে শেষ করা সম্ভব নয়। আবার সেরা বইগুলো না পড়ে পাঠকরা মরতেও চায় না। এ কথাটি সত্য যে বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। অর্থাৎ বই পড়তে পড়তে এক সময় বই চেনার চোখ ও মনন তৈরি হয়। সে সাথে ধীরে ধীরে রুচিবোধ ও প্রজ্ঞাও তৈরি হয়। তখনই একজন পাঠক বুঝেন কোনো বই পড়তে হবে।
উল্লেখ্য যে, ফিনল্যান্ডের একটি রাস্তায় ডুবন্ত মানুষের হাতে একটি বইয়ের ভাস্কর্ষের দৃশ্য সবাইকে আকৃষ্ট করছে। যার ক্যাপশনে লেখা ‘তুমি যদি ডুবে যেতে থাকো তবুও পড়ো।’ এ ক্যাপশনের মধ্যেই পড়ার অপরিসীম গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে। জীবনের যে পর্যায়েই থাকেন না কেন ? পড়ার সঙ্গে কখনো সম্পর্কে ছিন্ন করা উচিত নয়। আমাদের দেশে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর অর্থাৎ তরুণ বয়সেও নিবিড় পর্যবেক্ষণ, প্রক্রিয়া ও দর্শনের অভাবে পড়ার আগ্রহ অনেকটা কমে যাচ্ছে। এজন্য একমাত্র দায়ী তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। যা পাঠক সমাজকে ধ্বংসের দিকে দাবিত করছে। যা আমাদের জীবনে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সুইডেন শিক্ষা খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল। কিন্তু প্রযুুক্তি নির্ভর সুইডেনে শ্রেণিকক্ষে কম্পিউটার স্ত্রিন নিষিদ্ধ করছে। এ পদক্ষেপ আর সম্প্রসারিত করে ছয় বছরের কম বয়েসি সব শিশুর জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করার পরিকল্পনাও রয়েছে সুইডিশদের। এ বিষয়ে সুইডেনের স্কুলবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, সুইডেনের শিক্ষার্থীদের আরও বেশি বই দরকার। যা ছাপানো বই কিন্তু ডিজিটাল কপি নয়। এছাড়াও টাইপিংয়ের পরিবর্তে খাতা-কলমে অনুশীলনে উৎসাহিত করছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ফ্রান্সে এখন চাকরিতে নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর হাতের লেখার উপরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর এ হাতের লেখাই বলে দেয় প্রার্থীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তথা ব্যক্তিত্বের স্বরুপ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজ্যে হাতের লেখায় উৎসাহিত করার জন্য নানা প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উচ্চশিক্ষা মানুষকে পড়ার অভ্যাস তৈরিতে অভ্যস্ত করছে। এ প্রসঙ্গে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি ইভাল্যুয়েশন অব এজুকেইশনাল অ্যাচিভমেন্ট’ বিষয়ক বৈশ্বিক শিক্ষার মান যাচাইয়ের নিয়মিত গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। এর নাম ‘প্রোগ্রেস ইন ইন্টারন্যাশনাল রিডিং লিটারেসিং ষ্টাডি।’ এ গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, সুইডেনের শিশুদের পড়া বুঝতে পারার দক্ষতা উচ্চ থেকে মাঝারি পর্যায়ে নেমে আসছে। অথচ এ শতকের শুরুতে তাদের শিক্ষাকে মনে করা হতো ইউরোপীয় শিক্ষাঙ্গনের মানদন্ড। এ বিষয়ে সান্তিয়াগো দ্য কম্পোস্তেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইসাবেল ড্যান বলেন, শিক্ষানীতে কাগজ-কলমে লেখা ও ছাপানো বই পড়ার উপর গুরুত্ব দেয়ার একটি চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে স্পেনের স্কুলগুলোতে কাগজ-কলমের শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার দাবি উঠছে। কিন্তু তার মানে এ নয় যে শ্রেণিকক্ষ থেকে সব ধরনের প্রযুক্তি সরিয়ে ফেলতে হবে। তবে উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞানগুলো বিবেচনায় এনে শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে সচেতন ও সজাগ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আরও বেশি শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী হবে।
বিশেষ করে পৃথিবীর ৭৫টি দেশের জনসংখ্যা আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যার চেয়ে কম। এমন বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে যখন মানবসম্পদে রুপান্তরিত করতে হয়। তখন এর নিবিড় তদারকি ও পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। এর কারণ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর শিক্ষায় পদাপর্ণ, শিক্ষাগ্রহণ ও তাদের পাঠাভ্যাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুই আমাদের জাতীয় শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক। বিশেষত আমাদের দেশে সরকারি পর্যায়ে বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বিশেষ প্রয়োজন। একশ্রেণি অসাধু প্রকাশকরা নি¤œমানে বই সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও অসাধু প্রকাশকদের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারিরা মিলে নিম্নমানের বই সরবরাহ করে অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। কিন্তু পাঠক ঐ সমস্ত নিম্নমানের বই একদিনের জন্যও ব্যবহার করছে না। এতে করে জাতি ধ্বংস হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। অর্থাৎ একটি ভালো বই যে কোনো সময় যে কোনো মানুষের জীবনের আমুল পরিবর্তন করতে পারে। তার মানবিক সুকোমল বৃত্তিগুলো বিকশিত করে তাকে দায়িত্ব সচেতন, দেশপ্রেমিক ও বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিকে পরিণত করতে পারে। আর সে জন্য বই হচ্ছে মানুষের উৎকৃষ্ট বন্ধু। তাই পাঠর্চ্চা না থাকার কারণে সমাজে মানবিকতা, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যপ্রাতী বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকে বই পড়া থেকে দূরে সরে গিয়েই বিভ্রান্তির পথে হারিয়ে যায়। এজন্য পাঠচর্চার দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাই মানুষ বই পড়েই নিজেকে জানতে পারে। আর নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে। তাদের বুঝাতে হবে যে বই শুধু মানুষের মেধা ও প্রজ্ঞাই বৃদ্ধি করে না বরং বই পাঠে মানুষ হয়ে ওঠে কর্মোদ্যম, সহনশীল ও সহমর্মী। এতে পাঠক ও পাঠিকারা বেশি বেশি বই পড়ে জীবনের শুদ্ধতম আনন্দ খুঁজে নিতে পারে। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে একটি বিষয় অনুধাবন করা যায় যে, শিক্ষা না থাকলে কখনো কোনো জাতি আলোকিত হতো না। আর উন্নতির উচ্চ শিখরে অবতীর্ণ হতে পারতো না। এজন্য যে কোনো বই পড়ে তার মূল বিষয় অনুধাবন করার ক্ষমতাই হলো উচ্চশিক্ষার মাহাত্ম্য। বিশেষত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা মানুষকে ধর্মভীরু ও মহৎপ্রাণ করে তোলে আর চিত্রকে মুক্তি দেয় এবং মানবাত্নাকে জীবনবোধে বিকশিত করে। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন এবং পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তির জন্য অবশ্যই বই পড়া প্রয়োজন। আর পাঠক সমাজ নিজস্ব পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী বই নির্বাচন করে অগাধ জ্ঞানের রাজ্যের প্রবেশ করতে পারে। তাই সুন্দর ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে বই মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। যা মননশীলতার সম্প্রসারণ ও জ্ঞানের গভীরতা বাড়ায়। আর বড় মনের মানুষ হওয়ার জন্য সবাইকে বইয়ের সান্নিধ্যে আসতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ভ্লাদিমিরোভিচ নাবোকফ বলেন, ভালো পাঠক হওয়ার জন্য কিছু গুণের কথা বলছে। যেমন ভালো পাঠক মাত্রই বুক ক্লাবের সদস্য হবে। অর্থাৎ নির্দ্বিধায় বলা যায় ভালো বই চিনতে হলে ভালো পাঠক হতে হবে। এ প্রসঙ্গে জর্ডানের ভাষ্যমতে, কেউ যদি জাগতিক কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। সেক্ষেত্রে তার উচিত গল্পসমৃদ্ধ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা। এ বিষয়ে অ্যাপলের্য়াড বলেন, একজন মানুষের যদি ধৈর্য্য, জ্ঞানের প্রতি ম্পৃহা, অনুপ্রেরণা ও অনুসন্ধান করার গুণ থাকে। তবে সে দ্রুত পাঠক হয়ে উঠবেন। আর যুগ যুগ ধরে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষেরাই প্রগতির ধারা সৃষ্টি করবে। তাই দেশকে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশীল করে গড়ে তুলতে বই পড়ায় সচেষ্ট হতে হবে। আর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষিত হয়ে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। তাই শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে দেশকে আগামীর পথে এগিয়ে নিতে হলে পাঠক সমাজ ও তরুণ সমাজকে উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি, গঠনমূলক, শিক্ষামূলক ও উন্নতমানের বই পাঠক সমাজকে উপহার দিতে হবে। এতে করে পাঠক সমাজ আরও বেশি উপকৃত হবে।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ