বইমেলা এবং বই পড়া

2

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

শুরু হয়েছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে এই মাসে বসবে একুশে বইমেলা। এবার ঢাকার একুশে বইমেলায় তুলে ধরা হবে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের নানা দিক। থাকছে জুলাই চত্বরও। মাসব্যাপী বইমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এবার মানসম্পন্ন বইয়েই গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলা একডেমি। নাশকতার শঙ্কা না থাকলেও মেলার নিরাপত্তা ঘিরে সতর্ক পুলিশ। ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানের বইমেলা জমে উঠবে। লেখক, পাঠকদের মিলনমেলায় গমগম করবে মেলার স্থান। অনেকেই বইমেলায় যাবেন, বই কিনবেন, ছবি তুলবেন, মোড়ক উন্মোচন করবেন। এখন অবশ্য মেলার পরিসর বাড়লেও বইক্রেতার সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। এর নানা কারণ হতে পারে। এই যেমন অনলাইনে বই পড়ার সুবিধা, বইয়ের মূল্য বেশি হওয়া ইত্যাদি। আবার বই পড়ার প্রতিও আগ্রহ যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ভালো মানের কিংবা জীবন পরিবর্তন করার মতো বই কম।
গতানুগতিক ধারার বই-ই সবচেয়ে বেশি। বই মেলার মাধ্যমে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর এই উদ্যোগকে শক্তিশালী করতে হবে। বাড়াতে হবে সরকারি, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। রাজনৈতিক মতাদর্শ, ব্যক্তিগত অভিলাষের বাইরে গিয়ে মানুষের মন এবং মননের বিকাশ সাধনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। পাঠক কী চান, কী ধরনের বই চান সেটা মাথায় রাখতে হবে।
বইমেলায় শিশুদের জন্য বিভিন্ন কর্তার, স্টল থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। কিশোর, তরুণদের জন্যও আলাদা বইয়ের স্টল থাকা জরুরি। এমনিতে তারা মোবাইল, ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে আছে। বইয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়াতে পারলে পরিবার, সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে। তরুণদের জন্য সচেতনতামূলক বই চাই। তাদের জীবনের মোড় ঘুরানোর মতো বই চাই। ধার্মিকতা সৃষ্টি এবং চরিত্রগঠন উপযোগী বই চাই। বইমেলার মাধ্যমে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো যেতে পারে। এমনিতে আমরা বই পড়িনা। আমরা অনেকে বই কিনে থাকি ঠিকই কিন্তু তা সেভাবে পড়া হয়না বা নানা ব্যস্ততার কারণে পড়া হয়ে উঠেনা। বই পড়া অনেকের কাছে একটি শখের বিষয়। শখের বশে বই পড়া ছাড়াও জানার জন্য, জ্ঞানের পরিসর বাড়াতে এবং জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।
বই পড়া মানসিক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখে। বই পড়লে মস্তিষ্ক চিন্তা করার খোরাক পায়, সৃজনশীলতা বাড়ে এবং তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। বই পড়লে মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক মনস্ক হয়ে ওঠে। মানব জীবনে বইয়ের গুরুত্বের কথা স্মরণ করে টলস্টয় বলেছেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই।’ জ্ঞানার্জনের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বই। জীবনকে সফলতার আলোয় আলোকিত করার প্রধান উপায় হচ্ছে বই। বই পড়েই জ্ঞানার্জন করতে হবে। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছেন, জগদ্বিখ্যাত সফল মানুষ হয়েছেন, তারাই বেশি বেশি জ্ঞান অন্বেষণে সময় দিয়েছেন। পৃথিবীর যে কোনো বরেণ্য মনীষীদের জীবন ইতিহাস ঘাঁটলে এ কথার সত্যতা ধরা পড়ে। বই হচ্ছে শেখার, জানবার ও জ্ঞানার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।
ছোট বেলা থেকে আমার বই পড়ার অভ্যাস ছিল। এখন যদিও নানা ব্যস্ততার কারণে সেভাবে বই পড়া হয়ে উঠেনা। অবশ্য লেখালেখির কারণে তথ্য জানতে বই পড়ার চেষ্টা করি। তবে আমি মনে করি একটি ভাল বই জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি করে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ভালো বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। কারণ, বই পড়ার অভ্যাস থাকলে মন্দ সকল কাজ ও চিন্তা থেকে দূরে থাকা যায়। তাছাড়া কাজে লাগে নানা সময়। এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায়না। তারা ইন্টারনেট এর নানা গেমস ও অনলাইন কন্টেন্ট নিয়ে পড়ে থাকে। খাবারদাবার পর্যন্ত ভুলে যায়। এ কারণে সমাজে দিন দিন নীতি-নৈতিকতার সংকট বাড়ছে। এসব কারণে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বইমেলার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি বইয়ের দাম পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ভালো লেখকের বই পড়ার মজাই আলাদা। নাওয়া খাওয়া ভুলে একসময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সিরিজ, গল্পের বই, ধর্ম ও বিভিন্ন সাহিত্যের বই পড়ার চেষ্টা করতাম। আমার সংগ্রহে অনেক বই ছিল। মাঝে বইগুলোর অনেকাংশ হারিয়ে ফেলি। আমার আরেকটি অভ্যাস ছিল। আর সেটা হলো লাইব্রেরিতে বা বইমেলায় গেলেই বই কেনা। সাধারণ জ্ঞান, গল্পসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই কিনতাম।
অনেকে আছে বইয়ের পোকা। তাদের মধ্যে কেউ আছে যারা পাঠ্যবই পড়ায় দিনরাত সময়টা দিয়ে দেয়। আবার অনেকে আছে যারা শুধু গল্প বা পাঠ্যবইবহির্ভুত বিভিন্ন বই নিয়ে পড়ে থাকে। আসলে বই পড়াকে নিজের সাথে মানিয়ে নিতে হয়। আমি মনে করি ব্যস্ততার মাঝেও কিছু সময় বের করা উচিত বই পড়ার জন্য। পাঠক বাড়ানো ও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরী হলেই বইমেলা সার্থক হয়ে উঠবে। আসুন বই পড়ি, বই কিনি, বই উপহার দিই। নিজেদেরকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট