কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
ফেসবুক বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অনলাইন যোগাযোগের অন্য অনেক মাধ্যম থাকলেও ফেসবুক যেভাবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে তা অন্য মাধ্যমগুলো দ্বারা সম্ভব হয়নি। ফেসবুকের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি মানুষের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়। ফেসবুক যুগের শুরুর পর থেকেই এর কল্যাণে সারাবিশ্বের মানুষ এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রবাসি আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে যেকোন মুহূর্তে সব খবরাখবর জানা সম্ভব হচ্ছে। এখন শুধু যোগাযোগ নয় ব্যবসাসহ নানা কাজেও ফেসবুকের জুড়ি নেই। পাশাপাশি ভালো-মন্দ সব ধরনের ছবি, ভিডিও ভাইরাল হয় তাৎক্ষণিক। এতে অনেকসময় উপকারের পাশাপাশি সৃষ্টি হয় নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও। তিল থেকে তাল হয় ; হয় খুনোখুনি, মারামারি পর্যন্ত। সম্মানের পাশাপাশি অসম্মান আর বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়। ফেসবুক আইডি হ্যাক করে নানা বাজে পোস্ট করা ও অর্থ দাবি করে মানুষকে বিপদে ফেলা হয়। অনেকে নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণে ফেসবুক লাইভে এসে হুমকি-ধামকি এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে, ঘটছে। আরো কত কিসিমের যে অপরাধ হচ্ছে তা বলা মুশকিল।
যখন ফেসবুক ছিলনা তখন খবারাখবর ও নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য মানুষকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সময় লেগেছে অনেক। বিদেশের খবর কিংবা প্রবাসে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ করা ছিল কষ্টকর। চিঠি, ক্যাসেটের ফিতা প্রেরণ করে খবর আদান-প্রদান করতে হতো। এতে সময় লাগতো অনেক (প্রায় ২০/২২ দিন বা তারও অধিক সময়) এবং কষ্টকর। এরপরও চিঠি সময়মতো পৌঁছেছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যেতো না। পরে বাটন মোবাইলে কথা বলার সুযোগ হলেও তাতে সময় এবং আকাশচুম্বি কলরেট এর কারণে মানুষ বিরক্ত হতো। বাইরের দেশের খবারাখবরের জন্য বিটিভি, রেডিওই ছিল একমাত্র ভরসা। ফেসবুক আবিষ্কারের কারণে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। সেকেন্ডের মধ্যে যে কোনধরনের যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে। যা স্বপ্নের মতোই বলা যায়। যোগাযোগ যদিও সহজ হয়েছে কিন্তু ফেসবুক তথা অনলাইন মাধ্যম কেড়ে নিয়েছে দুরন্ত শৈশব, মানুষের আবেগ, অনূভূতি, ভালবাসা, স¤প্রীতি! বিশেষ করে টিকটক ভিডিওর নানা মন্দ প্রভাবে তরুণ, যুবকরা বিপথগামী হচ্ছে। ভিডিওর ভিউ ও অর্থ কামাই করতে গিয়ে অনেকের প্রাণহানিও ঘটেছে। কয়েকদিন আগেও ব্রাহ্মনবাড়িয়ার আখাউড়ায় টিকটক করতে গিয়ে ট্রেনের ছাদ থেকে ছিটকে পড়ে ২ যুবক মারা যায়। এর আগেও এধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে যা খুবই বেদনাদায়ক। এই ফেসবুক এখন গুজবের কারখানায় পরিণত হয়েছে। এডিট করে আগের-পরের নানা ছবি, ভিডিও পোস্টের কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এমনকি উত্তেজনাকর পরিবেশ তৈরি হয়। সেজন্য ভালো করে যাচাই-বাছাই ছাড়া খবর, ছবি, ভিডিও বিশ্বাস বা শেয়ার না করাই অধিকতর শ্রেয়।
একসময় মানুষ দলবেঁধে কোনও মাঠে বা দোকান, দেউরিতে বসে একে অপরের সাথে নানা সুখ-দুখের গল্প শেয়ার করতো। সমাধান করতো অনেক সমস্যারও। এখন এসব খুব একটা দেখা যায় না। এখন যেন মনে হচ্ছে সে সময়গুলোই ছিল সবচেয়ে সুন্দর, নস্টালজিক। কোন বিষয়ে প্রচুর চিন্তাভাবনা, আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিপক্কতার সুযোগ ছিল। স্মৃতিতে বাঁধানো সেই সুসময় মানুষের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। সববিছুতেই যেন কৃত্রিমতা, আর্টিফিশিয়াল! এখন দলবেঁধে ছাত্র-যুবক এমনকি বুড়োরাও ফেসবুক, টিকটকে মজে থাকে। খাবারদাবার ভুলে দিনরাত ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে। যে কারণে দিনকে দিন পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতার পরিবেশ বিলুপ্তির পথে। মানুষে মানুষে স¤প্রীতির বদলে সৃষ্টি হচ্ছে বিবাদ-বিসম্বাদের।
ফেসবুকের কল্যাণে অনলাইনে ক্লাস করার সুবিধা বেড়েছে। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে আয়ত্ব করতে পারছে তাদের পাঠ্যবইয়ের শিখন শেখানো কার্যক্রম। অবশ্য করোনার সময় থেকে এটির বিস্তৃতি বেড়েছে। কিন্তু এই অনলাইন ক্লাসের নাম করে অনেক ছাত্রছাত্রী বিপথে পা বাড়াচ্ছে। ক্লাস না করে দেখছে চরিত্রবিধ্বংসী নানা কন্টেন্ট। যা মোটেই সুখবর নয়। দীর্ঘক্ষণ মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখেও নানা রকমের সমস্যার সৃষ্টি হয়। আজকালকার ছোট শিশুদের অনেকসময় ধরে মোবাইল ব্যবহারের কােণে তাদের শারীরিক, মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
যেহেতু আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার কোন বিকল্প নেই সেহেতু এই ফেসবুক কিংবা অনলাইনের মন্দ প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ভালো কন্টেন্ট এর প্রতি যেন আগ্রহ বাড়ে তার জন্য কাউন্সেলিং এর পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় অনুভূতি তৈরি ও তা মেনে চলার পদক্ষেপ নিতে হবে। চরিত্র গঠনোপযোগী কন্টেন্ট তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই কন্টেন্টগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন সহজেই আকৃষ্ট করে। ফেসবুকসহ অনলাইন যোগাযোগ যেহেতু বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত সেহেতু তরুণ, যুবক, শিক্ষার্থীসহ সবাইকে সচেতন করার কোন বিকল্প নেই।
আমরা অনেকেই আছি যারা সবকিছুই এমনকি নিজের বেডরুমের খবরাখবর, ছবি, ভিডিও পর্যন্ত ফেসবুকে আপলোড দেই! যা মোটেও উচিত নয়। কোন্ পোস্ট করলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে বা মানুষ, আত্মীয়-স্বজন কী মনে করবেন তা চিন্তা করিনা। অথচ ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে অন্য অনেকের সাথে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবও যুক্ত থাকে। তাই এসব বিষয় আমাদের ভাবা উচিত বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এই ফেসবুক মাধ্যমটি আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠুক এবং আমরা ফেসবুক ব্যবহারে অধিকতর সচেতন ও যতœবান হই। মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হই; গড়ে তুলি স¤প্রীতি ও ভালবাসার নির্মল আনন্দময় পরিবেশ।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট