পূর্বদেশ ডেস্ক
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি শেষ হলো মোনাজাতের মাধ্যমে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি কামনায় করা এই বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেওয়া লাখো মানুষ কাঁদলেন গাজাবাসীর জন্য। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা, শিশু ও নারীদের মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকার করুণ বাস্তবতা হৃদয়ে নিয়ে ফিলিস্তিনপ্রেমী লাখো জনতা মোনাজাত করেন শান্তির জন্য।
গতকাল শনিবার বিকেল ৩টা ৫০ মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু হয়ে ৪টায় শেষ হয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক মোনাজাত করেন। মোনাজাতে বলা হয়, ইসরায়েল ফিলিস্তিনে যে নৃশংসতা চালাচ্ছে, তা মানবতার ওপর চরম আঘাত। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যেন তিনি নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষা করেন এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতার আলো দেখান।
একইসঙ্গে মোনাজাতে গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হওয়া, ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের উদ্ধার ও আহতদের সুস্থতা, শিশু ও নিরীহ নাগরিকদের জীবন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ, বিশ্ব নেতাদের বিবেক জাগ্রত হওয়া, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর অব্যাহত আগ্রাসনের বিচার চেয়ে দোয়া করা হয়েছে।
এর আগে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে কারী আহমদ বিন ইউসুফের কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশের আয়োজনে এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আব্দুল মালেক।
কর্মসূচির মূল মঞ্চে দাঁড়িয়ে এ ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ঘোষণাপত্রে অবিলম্বে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহবান জানানো হয়। এ ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের চুক্তি বাতিল ও সম্পর্ক ছিন্ন করতে মুসলিমবিশ্বের নেতাদের প্রতি আহবান জানান বক্তারা।
গতকাল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ গণজমায়েত থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যা ও চলমান হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানানো হয়েছে।এছাড়া ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করা, জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নিদের্শনা দেওয়াসহ বাংলাদেশের সরকারের প্রতিও দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
এর আগে বিশ্বব্যাপী ডাকা ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সোমবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও বিক্ষো করে, সে বিক্ষোভে সর্বস্তরের মানুষও যোগ দিয়েছিল।
‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির আয়োজক প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, এই প্রথম দেশের সকল রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সর্বস্তরের মানুষ এক কাতারে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণজমায়াতে উপস্থিত হয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করবে।
ইউরোপ-আমেরিকা সহ বিশ্বজুড়ে শান্তিপ্রিয় মানুষ রাজপথে নেমে এসে গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের উদ্যোগে গাজায় চলমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় এই কর্মসূচি হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট।
গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে মানুষের ঢল নামে। দুপুর ২টায় ‘মার্চ ফর গাজা’ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এর আগে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাঁচটি পয়েন্ট দিয়ে হাজার হাজার প্রতিবাদকারী শাহবাগের উদ্দেশে আসতে থাকে।
এই কর্মসূচি ঘিরে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে ‘ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন; জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’; ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’; ‘ইসরায়েলের কালো হাত, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে সোহরাওয়ার্দীদের জমায়েত মানুষ। এক পর্যায়ে জনারণ্য হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশেপাশের পুরো এলাকা।
এ সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পোস্টারে জুতা নিক্ষেপ করতে দেখা যায় অনেককে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনে জনতা ও নিরীহ শিশু হত্যার প্রতিবাদে প্রতীকি লাশ ও কফিন নিয়েও মিছিল করতে দেখা যায় অনেককে।
উদ্যানমুখী এই জনস্রোত বিকাল ৪টার পরও দেখা যায়। এর ফলে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যানজট লাগার খবর আসে।
লিখিত ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, আজ আমরা বাংলাদেশের জনতা-যারা জুলুমের ইতিহাস জানি, প্রতিবাদের চেতনা ধারণ করি, সমবেত হয়েছি গাজার মৃত্যুভয়হীন জনগণের পাশে দাঁড়াতে। এই সমাবেশ কেবল প্রতিবাদ নয়, এটি ইতিহাসের সামনে দেওয়া আমাদের জবাব, একটি অঙ্গীকার, একটি শপথ।
পদযাত্রা ও গণজমায়েত থেকে চারটি স্তরে বেশ কিছু দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের প্রতি যেসব দাবি জানানো হয়, সেগুলো হচ্ছে- ১. জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করা। ২. যুদ্ধবিরতি নয়; গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৩. ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করা। ৪. পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। ৫. ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করা। গণজমায়েতে মুসলিম উম্মাহর নেতাদের প্রতিও কিছু দাবি জানানো হয়েছে। দাবিগুলো হচ্ছে; ১. ইজরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও ক‚টনৈতিক সকল সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করা। ২. জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। ৩. গাজার মজলুম জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়ানো। ৪. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় ক‚টনৈতিক অভিযান শুরু করা। ৫. জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াকফ আইনে হস্তক্ষেপের মত রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নেওয়া।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যেসব দাবি জানানো হয়েছে; ১. বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘ঊীপবঢ়ঃ ওংৎধবষ’ শর্ত পুনর্বহাল করা এবং ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা। ২. সরকারের ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করা। ৩. রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। ৪. সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দেওয়া। ৫. জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানানো। ৬. পাঠ্যবই ও শিক্ষা নীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করা। নিজেদের জনগণের প্রতি বেশকিছু দাবি উত্থাপন করে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেগুলো হল। ৭. স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেসব পণ্য বয়কট করা যেসব পণ্য, কোম্পানি ও শক্তি ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখে। ৮. নিজেদের সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করা, যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সকল প্রতীক ও নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করবে। ৯. নিজেদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তোলা যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখন্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে। ১০. নিজেদের মধ্যে বিভাজন ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকা।
পরে ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য দোয়া করে মোনাজাত পরিচালনা করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মোহাম্মদ আব্দুল মালেক। বিকেল ৪টার দিকে জমায়েতের সমাপ্তি ঘোষণা করেন তিনি।
গণজমায়েতে সংহতি জানিয়ে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সালাহ উদ্দিন আহমেদ, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, জামায়াতের মিয়া গোলাম পরওয়ার, রফিকুল ইসলাম খান, নুরুল ইসলাম বুলবুল, মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম মাসুদ, হেফাজতে ইসলামের মাওলানা সাজিদুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিশের আহমেদ আবদুল কাদের, ধর্মীয় বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের শায়খ আহমাদুল্লাহ, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জু, এনসিপির হাসনাত আবদুল্লাহ, গণ অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাগপার রাশেদ প্রধান, নাগরিক নিরাপদ সড়কের ইলিয়াস কাঞ্চন।