এম. কামরুল হাসান চৌধুরী
বিশ্বের মুসলিম জাতির ইবাদত বন্দেগির অন্যতম একটি গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ পবিত্র স্থান মসজিদুল আকসা আজ আক্রান্ত হচ্ছে ইসরায়েলি ইহুদিদের আগ্রাসনে। মুসলিম জাতির কাছে মর্যাদাপূর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে প্রথমত পবিত্র মক্কা শরীফের মসজিদুল হারাম, দ্বিতীয়ত মদিনা শরীফের মসজিদে নববী এবং তৃতীয় স্থানে ফিলিস্তিনের এই মসজিদুল আকসার অবস্থান নির্ধারিত আছে। আবার মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল এই মসজিদুল আকসা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) এই মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন। স্বয়ং হযরত রাসুলে করিম (দ.) মিরাজ শরীফে গমন পবিত্র এই মসজিদুল আকসা থেকে হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ইসলামের সেই ঐতিহাসিক তীর্থস্থান পবিত্র মসজিদুল আকসা আজ ইহুদিদের বর্বরোচিত আগ্রাসনে বার বার হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বের কুখ্যাত সন্ত্রাসী কট্টর উগ্রবাদী ইহুদি জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা আজ ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ঐ জঙ্গি গোষ্ঠী হায়েনাদের ভয়াবহ আক্রমণে আজ গাজার শিশু কিশোর, তরুণ, যুবক, আবাল বৃদ্ধ নারী পুরুষ কেহই রেহাই পাচ্ছে না। প্রতিদিনই হাজার হাজার ফিলিস্তিন মুসলমানরা অকাতরে নির্মম ভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। তাদের বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকারে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অসংখ্য মানুষ। ইসরায়েলি ইহুদিরা ফিলিস্তিন মুসলিম নিধনের যেন এক নৃশংসতম হত্যা যজ্ঞে মেতে উঠেছে। গাজা এক ভয়ংকর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। বিগত প্রায় দেড় বছরের ও বেশি সময় ধরে জীবন যুদ্ধের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফিলিস্তিনের কয়েক লক্ষ মুসলমান। প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন নানা সংকটে পতিত হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশটি। এর মধ্যেই খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটের কবলে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে গাজাবাসী।
বিশ্ব বিবেক আজ নীরব! জাতিসংঘ নামক বিশ্ব সংস্থাটি বরাবরই সুবিধাজনক অবস্থান ধরে রেখেছে। শক্তের ভক্ত, নরমের যমের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ একটি কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আজ বাক শক্তিহীন প্রতিবন্ধী। আমেরিকা ও ইউরোপ সহ বিশ্ব পরাশক্তি রাস্ট্র সমুহ নীরব দর্শকের ভুমিকা রাখছে। বরং এই মহাদেশীয় পরাশক্তির রাষ্ট্রসমুহ ইসরায়েলের পক্ষে কৌশলগত সমর্থন জুগিয়ে ফিলিস্তিন ধ্বংসের পায়তারা করছে। মূলতঃ তারা জোটবদ্ধ হয়ে পৃথিবী থেকে মুসলিম নিধনের চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। মুসলিম দেশগুলো আজ দ্বিধাগ্রস্থ। সর্বকালের সকল জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার ফিলিস্তিনিদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার মতো কোন সভ্য ও মানবিক জাতি এখন আর পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয়না !
মুসলিম রাষ্ট্র গুলো অনৈক্য ও স্বার্থপরতার দোলাচলে প্রতিবাদী শক্তি হারিয়েছে অনেক আগে। যা খুবই দুঃখজনক। অথচ মুসলিম জাতির ইতিহাস সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অধিকার আদায়ের বীরত্বের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ। ইসলামের সেই ঈমানী চেতনা শক্তির দুর্বলতার কারণে পৃথিবীজুড়ে আজ সর্বাধিক মুসলমান নির্যাতিত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের মতো বৃহত্তর মুসলিম জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামি মানবেতর জীবন যাপনের কথা আমরা কখনও ভুলতে পারিনা। তাই সাধ্য মতো সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে ফিলিস্তিন মুসলমানের পাশে দাঁড়ানো এই মুহূর্তে বিশ্বের মুসলিম জাতির অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। এই কঠিন পরিস্থিতিতে যদি মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, তাহলে দুঃখজনক ভাবে পৃথিবী থেকে মুসলিম জাতি বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না! হয়তঃ এভাবে একদিন মুসলিম জাতি বিরল প্রজাতিতে পরিণত হবে ! তাই সময় থাকতে বিশ্ব মুসলিম জাতি ও গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈমানী চেতনায় বলীয়ান হয়ে ফিলিস্তিন মুসলমানদের রক্ষার সংগ্রামে বীরদর্পে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। অন্যথায় মানব জাতি হিসেবে একদিন সবাইকে শেষ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
তবে, ইসরায়েলিদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজ দেশে কোন সংঘাত সৃষ্টি করা কখনও কাম্য নয়। ফিলিস্তিনের প্রতি অতি কথিত দরদ দেখাতে গিয়ে দেশীয় নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও লুটতরাজ করা কখনও ইসলাম সমর্থন করে না। আমরা মুসলমান হিসেবে ফিলিস্তিনের জন্য অবশ্যই সহমর্মিতা থাকবে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। সম্ভব হলে ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। প্রয়োজনে ইসরায়েলের উৎপাদিত সকল পণ্য সামগ্রী বিশ্বের মুসলিম সমাজ বর্জন করবে, তা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে অহেতুক নিজ দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, বাটা জুতার শো রুমে হামলা ও লুটতরাজ করা এবং কেএফসি, ফিৎজা রেস্তোরাঁ কিংবা কোকাকোলা, পেপসি কোমলজাত পানীয় ধ্বংস কিংবা সাইনবোর্ড ভাংচুর করে কোন লাভ নেই ! এতে ফিলিস্তিন মুসলমানদের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনবেনা। বরং নিজের দেশের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়। গতকাল চট্টগ্রামের জিইসি মোড়, নাসিরাবাদ এলাকায় ঘটে যাওয়া সেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা গুলো অবশ্যই নিন্দনীয় অপরাধ। উগ্রবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। পৃথিবীব্যপী পবিত্র ইসলাম একটি মহান ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে সদা সর্বদা অধিক সচেতন থেকে সতর্কতা অবলম্বন করার গুরুত্ব অপরিহার্য।
সর্বোপরি ফিলিস্তিন মুসলমানদের বেঁচে থাকার আর্তচিৎকারে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হোক। মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের দরবারে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণ প্রাপ্তির মাঝে ফিলিস্তিন মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ, সমৃদ্ধশালী স্বাধীন জীবন কামনা করি।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক