আ.জ.ম. সামশুল হক
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে বিগত সরকার প্রধান চলে যাওয়ার পরে রাষ্ট্র কোনভাবেই অরক্ষিত থাকার কথা নয়। শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির ওপর ভর করে এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরাপত্তা বিধানে তিনদিন জনগণ চুপচাপ ছিল। তবে জনগণের দিন কেটেছে উৎকন্ঠার মধ্যে। চুরি -ডাকাতির মহড়া শুরু হয়েছিল, কোন কোন জায়গায়। তাতে খুব সফল হতে পারেনি। পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার পক্ষে এবং দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেনাবাহিনী প্রধান সরকার গঠনের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতির আহবানে সুপ্রিমকোর্টের সাড়া মেলে। সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের পক্ষ থেকে তড়িৎ পরামর্শনামা দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই মোতাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বলে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ৮ ফেব্রæয়ারী মহামান্য রাষ্টপতি শপথ বাক্য পাঠ করানোর মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। যাহা রাষ্ট্রের সংবিধানে অনুপস্থিত। শুধুমাত্র মহামান্য রাষ্টপতির আদেশ বলে এই সরকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যাহা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনার সাথে জনগণ ঐক্যমত পোষণ করেন এই মর্মে- জনগণের জীবন মান উন্নয়ন, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ব্যবসা- বাণিজ্য সম্প্রসারণ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ দেশের সার্বিক উন্নয়ন কাজে গতিশীলতা আনা। এক্ষেত্রে জনগণের অপেক্ষার পালা শুরু হলেও কবে শেষ হবে সেই নিশ্চয়তাটুকু ভাসমান অবস্থায় চলমান। এই সরকারের বয়স তিন মাস পার হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার গুরুত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসেনি বলা চলে। সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে শুনেছি। তবে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচিত সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত সবকিছু অনিশ্চিতের পথে। আমরা বিশ্বাস করি, এই সরকার গুণীজনদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জনগণ আশাবাদী, ভাল কিছু হবে। সরকারের সদইচ্ছা থাকলেও কতিপয় ছাত্রনেতার চাপের মুখে সরকারের অবস্থান এবং কর্মযজ্ঞ মাঝে মাঝে স্থবির হয়ে পড়ে। ছাত্রনেতাদের প্রতিবাদী কন্ঠ সরকারকে বিব্রত হতে হয়। সত্যিকার অর্থে যা সাংঘর্ষিক।
বর্তমান সরকার সংস্কারমূলক কাজগুলোর খসড়া নিয়ে প্রস্তাব আকারে নির্বাচিত সরকারের কাছে পেশ করবেন,তাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামীতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকার সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বদ্ধপরিকর। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে রাজনৈতিক ভাবধারায় এবং নির্বাচন হবে সব দলের অংশ গ্রহণে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সব দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবেনা। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক কোন দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি। ব্যক্তি হিসেবে যারা অপরাধ করেছে, তারা অবশ্যই শাস্তি পাবে। প্রত্যেক দলে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, লুটেরা, ভূমিদস্যু, টাকা পাচারকারী এবং সুযোগ সন্ধানী লোক থাকে। তারা জনগণের কাছে চিহ্নিত। তাদের ব্যাপারে আপস করবেনা জনগণ। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক, তাই জনগণ প্রত্যাশা করে। ৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে এবং ঘটেছে তা অবশ্যই আন্দোলন কেন্দ্রিক। তৎপরবর্তী সময়ের ঘটনাগুলো আন্দোলন বহির্ভূত। যেমন- নৈরাজ্য সৃষ্টি করা, অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, গণতান্ত্রিক কাজে তথা রাজনৈতিক মতাদর্শে বাধা প্রদান করা, সরকারি- বেসরকারি স্থাপনা ও জনগণের সম্পদ বিনষ্ট করা, আগুন দেওয়া, চাঁদাবাজি করা, কার ও কার ও ওপর চড়াও হওয়া ইত্যাদি নাশকতার পর্যায়ে পড়ে এবং প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমাদের জানামতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তিনজন দায়িত্ব প্রাপ্ত লোক এই সরকারে অধিষ্ঠিত আছেন। তাঁদের মাধ্যমে ছাত্রদের গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনা সরকার অবশ্যই জনগণের কল্যাণে গ্রহণ করবেন। ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারের মাঝে ছাত্রদের অবস্থান তৈরি করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ এবং তা হবে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং ১৫ আগস্ট মানুষের হৃদয়ে/ধমনিতে একাকার হয়ে আছে এবং আবহমানকাল ধরে জাগ্রত থাকবে। রক্তের আঁকড়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ মুছে ফেলতে চাইলেও মুছা যাবেনা। কেননা, বিশ্বদরবারে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং সনদপ্রাপ্ত দিকগুলো কখনও ইতিহাস থেকে বিলীন করা যাবেনা। অন্যদিকে ছাত্র – জনতার আন্দোলনে মাথায় জাতীয় পতাকা বেধে এবং জাতীয় সঙ্গীত বুকে ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে রক্তস্নাত ৫ আগস্ট ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় ও জাগরণের প্রতীক হয়ে থাকবে।
৫ আগস্ট পরবর্তী এই দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করতেছে। তা শুধু রাজনীতিতে নয়, জীবন-জীবিকার প্রশ্নে এবং অশান্তির কবল থেকে মুক্তি পেতে। দ্রবমূল্যের উর্ধ্বগতি দেশের মানুষের জন্য একটি অভিশাপ। কোনভাবেই মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হচ্ছেনা। অতীতে রেশনিং ব্যবস্থা ছাড়াও টিসিবি এর মাধ্যমে, এলাকা ভিত্তিক হাট বসিয়ে ভোগ্যপণ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সাধারণ জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাগবে অসহায়দের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, উপবৃত্তি এবং এককালীন ভাতাসহ কল্যাণকর অনেক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত ভাতাগুলো চলমান রাখলে, তারা বর্তমান সরকারকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। ভ‚মিহীনদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালু রাখলে অবহেলিত জনগোষ্ঠি দারুন উপকৃত হবে। জনগণ ক্ষমতার উৎস, এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এই সরকারকে সাধারণ জনগণের পাশে থাকা হবে উত্তম কাজ।
লেখক : প্রাবন্ধিক