বাবুল কান্তি দাশ
ফাঁদ অর্থ – বিপদে ফেলবার গুপ্ত কৌশল; ছল, জাল। এই ফাঁদ সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবন চলনাকে প্রতিনিয়ত করে তুলছে দৃর্বিষহ। কৃষি, শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে ফাঁদ পাতা। নিত্য প্রয়োজনীয় ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য-সামগ্রী এবং জীবন বাঁচানোর ও জীবন সাজানোর প্রতিটি উপাদানে ফাঁদ পাতা। ভেজাল নকলের ছড়াছড়ি। সময় উত্তীর্ণ সামগ্রীর উপর নতুন করে সময় সাঁটানো স্টিকার। মানুষ দিন দিন উৎকর্ষতার দিকে ধাবিত হওয়ার কথা কিন্তু চারদিকের পরিবেশ জানান দিচ্ছে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব ধাবিত হচ্ছে পশুর দিকে। বলদেব মতো যার মাংস বাড়ে কিন্তু প্রজ্ঞা বাড়ে না। ফাঁদ পেতে আছেন সবাই সর্বক্ষেত্রে। ক্ষমতা, লোভ মোহের প্রচন্ড স্পৃহাজনিত ব্যাকুলতায় ফাঁদ পেতে আছেন দুষ্ট প্রকৃতির লোকগুলো। যারা প্রতিনিয়ত এই ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে যারা রয়েছেন তারা হয়তো ওজনে কারচুপি, মেয়াদ উত্তীর্ণ সামগ্রীর স্টিকার তুলে পুনঃ নতুন মেয়াদের স্টিকার সাঁটানো, ভেজাল করা, সিন্ডিকেটজনিত কারণে অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি, মজুদকরণসহ নানাবিধ ফাঁদ পেতে বসে আছেন এসকল মানুষ। চিকিৎসকের কাছে যখন যাওয়া হয় দেখা যায় অহেতুক কিছু বিড়ম্বনা। নির্দ্দিষ্ট ল্যাবে পরীক্ষা করা এবং ইনভেস্টিগেশন এর নামে অতিরিক্ত পরীক্ষার ফাঁদ। অনেক চিকিৎসক রয়েছেন যারা নিজেদের পছন্দমতো ল্যাবে পরীক্ষা করতে বলে এখানেও এক মহাফাঁদ। নির্দ্দিষ্ট ল্যাব ব্যতিরেক পরীক্ষা করা মানে চিকিৎসকের অবহেলার শিকার। এরপরও দেখা যায় রোগ নির্ণয়ে নির্ভুলতার অপারদর্শিতা। ঔষধ নির্বাচনেও চিকিৎসকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। থেকে যায় নানাবিধ ভুলভ্রান্তি। চিকিৎসকের চেম্বারে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রোগী এবং স্বজনরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে কতিপয় চিকিৎসকের আচরণ বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। সেবা পদদলিত হয়ে মাথাচাড়া দেয় ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। চিকিৎসকের কাছে রোগীর অসহায়ত্ব সর্বজনবিধিত। কোনো কোনো চিকিৎসকের সিরিয়াল নাম্বার নেওয়া আর এক বিড়ম্বনার করুন দৃশ্য। ফাঁদ পেতে আছেন ঔষধ কোম্পানিগুলো। দেওয়া নেওয়ার কুশলকৌশলী সক্রিয় প্রচেষ্টায় নি¤œমানের ঔষধ বাজারজাত করা, অকারণে ঔষধের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানাবিধ ফাঁদ। ফাঁদ পেতে আছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কতিপয় শিক্ষক। একদিকে শিক্ষাপোকরণের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে রয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কারসাজি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে গাইড বই পাঠ্য করে তা ক্রয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি। যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। কতিপয় শিক্ষকদের নিকট প্রাইভেট পড়ানোর চাপ। ব্যতিক্রমে শিক্ষার্থীদের উপর নেমে আসে অযত্ন অবহেলা। ক্ষেত্রমতে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের অবদমন। রয়েছে কোচিং সেন্টারের ফাঁদ। ভর্তি বানিজ্যের ফাঁদ। উচ্চ শিক্ষায় ফাঁদ। চাকুরীর ক্ষেত্রে ফাঁদ। অর্থাৎ সকল জায়গায় এই দুষ্ট ফাঁদ জনজীবনে মহাবিনষ্টির স্মারক। ভোগ আর ভোগ। চাওয়া আর চাওয়া। এহন মানসিকতাজনিত কারণে এই ফাঁদ উপড়ানো যাচ্ছে না। দেশে এখন সংস্কারের বন্যা। মানসিক সংস্কার ব্যতিরেক কোনো সংস্কারই সংস্কারে পর্যবসিত হবে না। দূর্বৃত্তায়নের যে মহাফাঁদ পাতা রয়েছে এবং মানব মস্তিষ্কে তা যেভাবে সেঁটে আছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো ফাঁদকেই আমরা বিনষ্ট করতে পারছি না শুধুমাত্র ভাগে-ভোগের দুর্দমনীয় স্পৃহার কারণে। ধর্ম বলি আর শিক্ষা বলি কোনোকিছুই আমাদের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে পারছে না। কেমনজানি মনে হয় নৈতিক অবক্ষয়ই আমাদের পরম লক্ষ্য। তারপরও আমরা নৈতিকতার কথা বলে গলা ফাটায়। কিন্তু মনে করি না যে, নিজে আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও এর মর্মার্থ। নৈতিকতা দাবী করার আগে নিজ জীবনকে নৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত করে তুলতে হবে। আর এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ঐ দাবীকে কবুল করবে। অন্যথায় তা প্রত্যাশা করা বিড়ম্বনা মাত্র। বহুল শ্রæত – পশু পশুত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু মানুষ মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তাঁকে তা অর্জন করতে হয়। এই অর্জনে মানুষ হয়ে উঠে মান-হুঁশ। মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচায়ক হচ্ছে -দুর্বলকে রক্ষা করা আর দুর্জনকে বিনাশ করা। কিন্তু মনুষ্যত্বের বিকাশে মনোযোগী না হওয়ায় এবং ব্যাহত হওয়ায় মানুষ মানুষের কাছে গৃহপালিত পোষা পশুর আদরও পায় না। প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্ব›িদ্বতা যেখানে তা প্রাকৃতিক নিয়ম কিন্তু তা আজ ক্ষমতার দাপট আর পেশীশক্তির কাছে ম্রিয়মাণ। দেহে ক্ষীণ বুদ্ধিতে হীন ব্যক্তিরা শত অনুগত থাকার পরও তা’দের উপর শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন ঐ সকল ক্ষমতাবান ও পেশীশক্তির আত্মপ্রসাদ লাভের উত্তম পন্থা। বুদ্ধিমানরা এদের ছলে বলে কৌশলে নিয়ত বিব্রত বিভ্রান্ত প্রতারণা করে যাচ্ছে। সমাজে শান্তিতে সহাবস্থান ঐসকল বুদ্ধিমান শক্তিমান ক্ষমতাবানদের চক্ষুশূল। বিভাজন বৈষম্য এদের সাধনা। সিদ্ধি তাই অস্থিরতা অরাজকতা বিশৃঙ্খলা। সমাজে এখন প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়ী অহং সচেতন এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের। যা সম্ভব প্রকৃত সুশিক্ষায়, সুশাসনে এবং বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায়।
মানবপ্রীতি সদাচার সহাবস্থান ব্যতিরেক সমাজ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা সংরক্ষিত হবে না। সহযোগে সহভাগে সপারিপার্শ্বিক পথচলা হোক মানবচরিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। সুবিধার ডাকে নয়, সত্যের ডাকে সাড়া দিই। আলোকিত হই। সমাজকে করি সমৃদ্ধ, দেশকে করি উন্নত। সুবিধা আজকের, সত্য চিরকালীন। সুবিধা সংকোচনের, সত্য স¤প্রসারণের। সুবিধাবাদী বিধ্বস্তি ও ধ্বংসের কারণ। সত্যবাদী সৃজন মননে সুন্দরে উদ্ভাসিত পথপ্রদর্শক। সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী সামাজিক অস্থিরতার কারণ। সত্যবাদী সামাজিক স্থিতিশীলতার দৃষ্টান্ত। সুবিধা’য় নয়, সত্যে নিমগ্ন হই। সার্থক করি মানবজন্মকে। স্থায়িত্ব দিই মানব সভ্যতার। প্রামাণিক হই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক