পড়িয়াছে বীরবাহু বীর-চূড়ামণি

131

সম্ভবত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম বলেছেন; ‘তুমি মানুষের যতই উপকার করো কখনো তা মনে রাখবে না যদি কখনো একটি মাত্রও অপকার করেছ তো সারা জীবন সে তা ভুলবেনা এ হল মানুষের চরিত্র।’ ভেবে দেখলাম কথাটা শতভাগ সত্যি, আপনি কতটুক দেখেছেন জানিনা, আমি কিন্তু আপন ভাই-বোনকে চরম হিংস্র হতে দেখেছি। ভাইয়ের করা সারা জীবনের উপকারের কথা মুহূর্তে ভুলে গেছে! কথাটি মনে পড়ল সেদিন কারাগারে অমিত মুহুরী হত্যার ঘটনা দেখে। জানি সে বড় হিংস্র সন্ত্রাসী, ঠান্ডা মাথায় পাখি মারার মত সে মানুষ খুন করতে পারে তারপরেও ঘটনাটি শুনে মনে তার জন্য একটু দরদ এসেছিল। কারণ একদিন সে আমার সাথে হাত মিলিয়েছিল, ও খোদা কি বলতে কি বলে ফেলছি, হাত মেলানো বলতে ঐ হাত মিলানো না, স্রেফ হ্যান্ডশেক করেছিল মাত্র। বাবা গো বাবা খাল কেটে কুমির নিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম, অমিতের সাথে পরিচয়ের পর্বটা আমার প্রবন্ধ ‘ফিরে এলাম তীর্থ ঘুরে’তে লিখেছি। বাবা মাস্টার, ইয়াবা মাস্টার, গুটি মাস্টার, খুনের মাস্টার সোজা কথায় অল মাস্টার, সব আমি জানি তথাপি তার খুনের কথা শুনে মনটা একটু কেঁপে উঠল। ভাইয়া ভালো আছেন? বলে যে হাতটা মিলিয়ে ছিল আজো তা মনে আছে, আর তার গডফাদার কিনা স্বার্থে সামান্য ঘা লেগেছে তাতেই কাম ফিনিশ? সারাজীবন গডফাদার তথা বড়বাবার জন্য সে কি কম শ্রম দিয়েছিল? তার পুরস্কার এই, রাতের আঁধারে ঘুমের মধ্যে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া? হায়রে বাংলা মায়ের তরুণ সন্তানেরা কার পেছনে দৌড়াচ্ছিস তোরা, কেন শুধু মিথ্যা মোহে মরীচিকার পিছে ছুটছিস, কি পাস তোরা এই দানবদের কাছ থেকে? এত শ্রম দিলি, এত কষ্ট করলি, কত তেল মারলি বিনিময়ে পেলি মৃত্যু, লাভ কি হল? মা-বাবাকে কষ্ট দিলি সাথে মানুষের অভিশাপ নিলি, মনে হয় আমি ছাড়া কেউ তোর জন্যে ন্যূনতম অনুশোচনাও করেনি।
আসলে আমার মনটা মনে হয় একটু নরম, একটি চাটগাঁইয়্যা গান মনে পড়ে গেল; ‘সোনা দিলাম তোঁয়ারে রূপা দিলাম এতকিছু দি’ও তোঁয়ার মন ন ফাইলাম। মহিলা বলছেন, জীবন দিলাম তোঁয়ারে যৌবন দিলাম আর কি আছে বাকি হও আর কি দিতাম?’ অর্থাৎ মানুষের চাওয়ার শেষ নেই, যত পায় তত চায়। গানটিতে ছেলে বলছে, তোমাকে সোনা, রূপা সব দিলাম তারপরও তোমার মন পেলাম না। মেয়ে বলছে, তোমাকে জীবন, যৌবন সব দিয়েছি তাহলে দেওয়ার আর কি বাকি থাকে? অমিতেরও হয়েছে সে দশা, এত দেওয়ার পরও হয়নি শেষে জীবনটাই দিতে হল। হিন্দি সিনেমা শোলেতে গাব্বার সিংকে কালু বলছে; সর্দার তেরা নমক খায়া। সর্দার তখন বলছে; অব তু গুলি’ই খা। অমিতকেও সর্দার তেমনই বললেন; অব তু ইট খা। আসলে দেখতে ছেলেটা বড় সুদর্শন ছিল তাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, কেন যে সে এ পথে এলোÑ যাক দুঃখ অনেক করে ফেলেছি আর না। সেদিন দেখলাম স্টেশন রোডে প্রচুর ইয়াবা সহ কারারক্ষী ধরা পড়েছেন, মাশাল্লাহ্ জব্বর খবর। আবার দেখলাম কয়েদিকে হাগু করিয়ে ইয়াবা বেরকরছে, কি তামাশা। কারাগারে যে বাবা-ইয়াবার ছড়াছড়ি তা আমি আমার উল্লেখিত প্রবন্ধে লিখেছি, যে বাবার কারণে মানুষের কারাবরণ সে ইয়াবার তথায় অবাধ বিচরণ। অতএব বুঝা গেছে নিশ্চয় কারাগারের আচরণ, তবে খাবারের মান নাকি পরিবর্তন করা হয়েছে। আমার লিখাতে আমি খাবারের মান নিয়ে লিখেছি আশাকরি উন্নত করা হয়েছে, তবে যাচাইয়ের জন্য আল্লাহ্ যেন আর না ঢুকান, কেউ বের হলে না হয় জেনে নেব তার কাছে। ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায় তবে কথা হচ্ছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী, তাকে মারল কিনা রিপননাথ নামের নামধামহীন এক পাতি সেয়ানা? আল্লাহ্ জানেন আভ্যন্তরীণ তেলেসমাতি কি, রিপন পারার কথা না কারণ ভিতরেও অমিতের অনেক চেলা-চামুন্ডা ছিল, অতএব মেঘনাদবধ মনে পড়ে গেল।
বীরহিয়া, বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি অরিন্দম মেঘনাদকে বধ করিল শৃগালচিত্তসম তস্কর, চন্ডাল, ক্ষত্রকুল গ্লানি, পামর লক্ষণ। ঠিক তেমনভাবে টপটেরর অমিতমুহুরীকে বধিল পুঁচকে রিপন। তবে লক্ষণের সাথে ছিল বিভীষণ তাহলে রিপনের সঙ্গে থাকা বিভীষণটা কে? হাজতে অমিতের দীর্ঘদিনের সহনিবাসী বেলালকে নিশ্চয় বিভীষণ ভাবাটা ঠিক হবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে তার হাজতের সঙ্গীটির নাম বেলাল আর গডফাদারের নাম হেলাল, আজব বাদ এমন মিলে গেল কেমনে? বেলাল-হেলাল মাশাল্লাহ্, সেদিকে না যাই। অমিত মারা গেলে তার পিতা আহাজারি করে বলছিলেন, রিপন তো অমিতের বন্ধু তবে সে তাকে হত্যা করল কেন? ঠিক আছে পিতা যেহেতু অনেক ধারণা করবেন তিনি তবে ইতোমধ্যেই নানান জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, বিশেষজ্ঞ মন্তব্য, অনুমান-উপমান, ইত্যাদি শুরু হয়ে গিয়েছে, এ ঘটনা নিয়ে। সে ব্যাখ্যায় যাব না তা বিশ্লেষক আর বিশেষজ্ঞগণ করুন, আমার কথা হচ্ছে অমিতের বাবার প্রশ্নটি অন্য আরো অনেক বাবারও তো প্রশ্ন যে, অমিত আমার ছেলেকে কেন মারল সে তো তার প্রিয়বন্ধু ছিল। অমিতের বাবা তখন কি অমিতকে সেই প্রশ্ন করেছিলেন, সে তো তোর বন্ধু ছিল কেন তুই তাকে হত্যা করলি?
খেলিতে খেলিতে শিশু কাল গেল হাসিতে হাসিতে যৌবন, মরণেরকালে ভাবিছ কেমনে কবরে করিব ঢৌকন? ঠিক তেমন অন্যের ছেলেকে যখন হত্যা করছিল আপনার ছেলে আপনি হয়তো মনে মনে তখন রাবণের মতো বলছিলেন: ‘সাবাসি দূত তোর কথা শুনি কোন বীরহিয়া নাহি চাহেরে পশিতে সংগ্রামে, ডমরুধ্বনি শুনি কালফণী কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে? ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্রধারী।’ পুত্রের বীরত্বের কথা শুনে রাবণ সংবাদ প্রদানকারীকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন, কোন বীর যুদ্ধে যেতে চায় না, বাঁশির শব্দ শুনে কালসাপ কি কখনো গর্তে বসে থাকতে পারে? অবস্থা দৃষ্টে অমিতের পিতাও ছেলের পৌষমাসকে এমন করে উদ্যাপন করেছিলেন নইলে আজ তিনি ছেলের লাশের পাশে বসে যে প্রশ্নটি করলেন, সে প্রশ্নটি তিনি অমিতের বন্ধুর লাশের পাশে বসে করতেন। হায়, নিজের বেলায় বরাবর পরের বেলায় বেখবর।
অমিত বড় নিষ্ঠুর, নির্দয় একটি ছেলে কথায় কথায় মানুষ খুন করতে পারে অথচ সে কি সুদর্শন এক ছেলে। তার চেহারার সাথে এমন আচরণ যায় না, তাহলে সে কেন এমন হল? তার মাথায় এতগুলো পরোয়ানা, একাধিক খুনের মামলা সহ বিভিন্ন মামলা তার উপর হল একজন চেইনস্মোকার ও অতি দক্ষ ইয়াবা সেবক। এত কিছুর সংমিশ্রণ হয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে জেলখানাতে ঘুমাচ্ছে, আজব! আমরা একটা মামলার কারণে টেনশনে ঘুম আসে না, একটি মাত্র সিগারেট টানলে মাথা ঘুরতে থাকে সে কিনা গভীরঘুমে আচ্ছন্ন। এমন ঘুম একজন লোক ইট দিয়ে তাকে খুন করতে আসছে সে কিছুই টের পেলনা, কমপ্লিট টেনশন ফ্রি। অতএব সে বীর না কে বীর? এত কিছুর মাঝে যে মাথা পরিপূর্ণ ঠাÐা রাখতে পারে সে’ই তো প্রকৃত বীর। সুতরাং পড়িয়াছে বীরবাহু বীর-চূড়ামণি, চাপি রিপুচয় বলী, পড়েছিল যথা হিড়িম্বার ¯েœহনীড়ে পালিত গরুড় ঘটোৎকচ। রাক্ষুসী হিড়িম্বার আদরের পুত্র ঘটোৎকচ শত্রæদমন করে পড়ে ছিল যেখানে আজ বীরবাহুও সেখানে পড়ে আছে। আমাদের অমিত বীর-চূড়ামণিও তেমনি সেখানে পড়ে আছে। তার পিতা জেলখানার ঘটনাকে সাজানো আখ্যা দিয়েছেন, অঙ্গুলি পাতছেন গডফাদারদের দিকে। নিশ্চয় তিনি সেখানে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছেন যেমন দেখে ছিল রাক্ষসপতি। “অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃধিনী, শকুনি, কুক্কুর, পিশাচদল ফেরে কোলাহলে। দেখিলা রাজা নগর বাহিরে, রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা, বিষধর বিচিত্র কঞ্চুকভূষিত। হিমান্তে অহি ভ্রমে ঊর্ধ্ব ফণা ত্রিশূলসদৃশ জিহব্বা লুলি অবশেষে।” রাবণ দেখছে যুদ্ধক্ষেত্র শৃগাল, কুকুর, শকুনি, পিশাচদের বিচরণে বিচলিত। নদীতীর গুঞ্জরিত শত্রূবালিকাদের নিনাদে যেখানে সর্পরা বিচিত্র পোষাকে শোভিত। সেথায় পড়ে রয়েছে বীরবাহু তাই রক্ষঃপতি আজ সেই সাপ সদৃশ, যে সাপ শীত অন্তে ফণা তুলা ভুলে ত্রিশূলের ন্যায় জিহব্বাটি শুধু দোলাতে থাকে। পুত্র প্রতাপে প্রতাপী পিতা রাবণের ন্যায় আজ বাঘ বিড়াল হয়েছে পুত্রশোকে, অথচ পুত্র যখন ধরাকে সরা জ্ঞান করছিল তখন কি তিনি সাবধান করেছিলেন?
দেখা যায় ছেলে একটু সিয়ানা হয়ে উঠলে, শেঠগিরি ফলালে, নেতাগিরি দেখালে পিতৃমাতৃকুল পুলকিত হন, গৌরব অনুভব করেন মহিমান্বিত হন। অমিত যখন নিজের বন্ধুদের হত্যা করছিল তার পিতা অমন প্রশ্ন তুলেননি, গডফাদারদের দিকে অঙ্গুলিহেলন করেননি। পুত্রের সকল অন্যায় কাজ হর্ষচিত্তে গ্রহণ করলেন আর আজ যখন, ‘পড়েছে কুঞ্জরপুঞ্জ ভীষণ আকৃতি, ঝড়গতি ঘোড়া হায় গতিহীন এবে। চূর্ণ রথ অগণ্য, নিষাদী, সাদী, শূলী, রথী, পদাতিক পড়ি যায় গড়াগড়ি একত্রে। হৈমধ্বজ দন্ড হাতে, যম-দন্ডাঘাতে পড়িয়াছে ধ্বজবহ যন্ত্রদল মাঝে।’ অর্থাৎ হাতি পড়ে গেল, ঘোড়া তার গতি হারাল, সৈন্য-সামন্তগণ শেষ, যমের দন্ডের আঘাতে পতাকাধারী স্বর্ণপতাকা হাতে লুটিয়ে পড়ল তখন অমিতের পিতা বলছেন বন্ধু কেমনে বন্ধুকে হত্যা করে? দেখাচ্ছেন আঙ্গুল গডফাদারদের দিকে। যা তাঁর করা উচিৎ ছিল অনেক আগে, এখন অনেক দেরী হয়ে গেল। ছেলের দাপটে তখন দেহে হওয়া লাগিয়ে বেড়াতে বড় ভাল লেগেছিল। অতএব পাটকেল মারলে ইটটা তো খেতে হবেই, সুতরাং ইট খেয়েছে। রাবণের মতো এখন মনকে সান্ত¦না দিন: ‘যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে সদা। রিপুদলবলে দলিয়া সমরে, জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে? যে ডরে ভীরু সে মূঢ় শত ধিক তারে। তবু বৎস যে হৃদয়, মুগ্ধ মোহমদে কোমল সে ফুলসম। এ বজ্র-আঘাতে কত যে কাতর সে, তা জানেন সে জন, অন্তর্যামী যিনি; আমি কহিতে অক্ষম।’ এ কষ্ট বলার মত না, শুধুমাত্র যার গেছে সে বুঝে তাই সকল পিতামাতার নিকট অনুরোধ সন্তানদের নৈতিক ও আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করুন।
লেখক : কলামিস্ট