প্লে-নার্সারি শিশুর সঠিক যত্নেই সুন্দর ভবিষ্যৎ

1

অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব

এক বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর থেকে শিশু হাঁটতে এবং আধো আধো কথা বলতে শুরু করে, শিখে। শিশু ৩ বছর বয়সে উপনীত হলে প্রাক-প্রাথমিক (প্লে-নার্সারি) শ্রেণিতে ভর্তি করানোর প্রস্তুতি নিতে হয়। অনেক পিতা-মাতা এই দুই শ্রেণিতে ভর্তির জন্য আগ্রহ দেখায় না। তাঁদের সন্তানকে এই বয়সে প্রস্তুত করার গুরুত্ব বোঝতে পারেন না। মনোযোগ দেয় না। ভর্তি করালেও সঠিকভাবে যত্ন নিতে না পারায় শিশুর মস্তিষ্ক বা মেধা-মননের আধারকে ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারে না। ভালো বীজ তলা তৈরি করতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কৃষক হতে হয়। কর্ষণ করলেই ভালো বীজ তলা হয় না। তেমনি শিশুকে ভর্তি করালেই তার ভবিষ্যৎ সুন্দর হয়ে উঠবে তা বলা যায় না। সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শিশুকে গড়তে হলে মা, বাবা ও শিক্ষককে শিশু শিক্ষায় বাড়তি মনোযোগ দিতে হয় ও দক্ষতা রাখতে হয়। দুঃখের বিষয় হলো আমরা অনেকেই সেই ক্ষেত্রে উদাসীন। সহায়তার অভাবে পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থী বিদ্যালয় খাপ খেতে পারে না, সহজে অভিযোজিত হতে পারে না। তাই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। মেধাবী হিসাবে গড়ে উঠতে পারে না। ঝরে পড়া কমাতে ও মেধাবী হওয়া নিশ্চিত করতে আমাদেরকে শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের ব্যবস্থাপত্র ও পরামর্শ অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা (প্লে, নার্সারি) বলতে বোঝায় ৩ থেকে ৬ বছরের শিশুর মধ্যে স্কুলে যাওয়ার মানসিকতা ও আগ্রহ তৈরি করার জন্য শিশুতোষ শিক্ষা দেয়া। যার জন্য শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ এ-র ব্যবস্থা করা। খেলাধুলা ও বিনোদন এর ব্যবস্থা রাখতে হয়। ভাষা ও সংখ্যার সাথে পরিচয় ঘটানোর জন্য আনন্দময় প্রেক্ষিত দিতে হয়, নানা রকমের, প্রেক্ষিতগুলো হতে হয় শিশুতোষ। এই জন্য সেবা-যত্ন, বেঁচে থাকা এবং বিদ্যালয়ে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে এই বয়সে শিশুকে স্কুলে ভর্তি করাতে হয়। এই ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুর শিক্ষার লক্ষ্যগুলো গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। প্রাক্-প্রাথমিক/প্লে-নার্সারি শিক্ষার লক্ষ্য- প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক লক্ষ্য হচ্ছে শিশুদের বিকাশ ও প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করা। শিশুর অধিকার পূরণ করে শিক্ষার সুযোগসমূহ থেকে সুফল অর্জন করা। এবং বুদ্ধি ও মেধা বিকাশে তাদেরকে উপযোগী ও সক্ষম করে তোলা। ক. প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য: প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে শারীরিক, ভাষাগত, সামাজিক ও আবেগগত উন্নতির জন্য অল্পবয়সী শিশুদের সব ধরনের যত্ন ও শিক্ষা প্রদান করা। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শ্ররে সফতলতায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। জরিপে দেখা গেছে যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধি, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ও একই শ্রেণীতে পূর্ণ ভর্তি হ্রাসে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসুচি সমূহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাছাড়া মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। মূলত প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ছোট ছোট শিশুদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিভিত্তিক, ভাষাগত ও সামাজিক বিকাশের ভিত্তি মজবুত করে। এই মজবুত ভিত্তি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ করে সকল শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে শিশুর সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হয়। শিশুর বিকাশ হচ্ছে একটি স্বাভাবিক, ধারাবাহিক ও সমষ্ঠিগত প্রক্রিয়া। জন্মগতভাবে মানব শিশু নতুন কিছু গ্রহণ ও অনুসন্ধানের জন্য প্রস্তুত। এর ফলে শিশুর মস্তিষ্ক ও শরীর ক্রমাগত পরিণত হতে থাকে, পরিপক্ক হতে থাকে। এই প্রক্রিয়া মূলত বিকাশমূলক। এই ক্ষেত্রে শিশুকে উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া না হলে এই বিকাশ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর সার্বিক বিকাশের কতগুলো ক্ষেত্র রয়েছে। এখানে বিকাশ মানে হলো ধারাবাহিকভাবে উন্নতির দিকে যাওয়া।
বিকাশের ক্ষেত্রগুলো হলো- ক. শারীরিক বা চলন ক্ষমতার বিকাশ খ. জ্ঞান বা বোধশক্তির বিকাশ গ. ভাষার বিকাশ ঘ. সামাজিক ও আবেগিক বিকাশ মূলত প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমকে সুনির্দিষ্ট, বাশ্রব ভিত্তিক করতে ও ব্যবহারিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে ফলাফলসমূহকে নির্ধারণ করা হয়। ফলাফলসমূহ হচ্ছে- ১. নিজের নাম, মাতাপিতার নাম, পরিবারের ঠিকানা এবং নিজের জন্ম তারিখ বলতে পারা ২. শরীরের বিভিন্ন অংশের নাম ও সেগুলোর কাজ বলতে পারা। ৩. সামাজিক রীতি অনুসরণ করতে পারা।শুভেচ্ছা জানাতে পারা। বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করা, ধন্যবাদ দেয়া, অনুমতি চাওয়া, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে উপযুক্ত সামাজিক মেলামেশায় নিয়োজিত হতে পারা। ৪. শিশুতোষ বিভিন্ন ছড়া আবৃত্তি করতে পারা। গান ও জাতীয় সংগীত গাইতে এবং গল্প বলতে পারা। ৫. একই ধরনের বস্তু বা জিনিস শ্রেণী অনুযায়ী সাজাতে এবং এক ধরনের নয়, এমন বস্তু বা জিনিস আলাদা করতে পারা। ৬. বৃত্ত, ত্রিভূজ ও আয়তক্ষেত্র আঁকতে পারা ও সেগুলোর নাম বলতে পারা। ৭. চারপাশের প্রাকৃতিক জিনিস, যেমন-ফুল, ফল, মাছ, পাখি, প্রাণী, সূর্য, চন্দ্র, গাছ, গাড়ি, ঘোড়া, আবহাওয়া, মাটি ও পানি ইত্যাদি চিনতে পারা। সেগুলোর নাম ও কাজ বলতে পারা। ৮. বক, মাটি, পাতা, কাগজ, কাঠি ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজের ইচ্ছায় বিভিন্ন বস্তু ও খেলনা তৈরি করতে পারা। এই সব তৈরি করার মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতা দেখাতে পারা। ৯. ০ থেকে ২০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো গণনা করতে পারা, চিনতে পারা, পড়তে পারা ও লিখতে পারা। ১০. ছোট ছোট যোগ ও বিয়োগ করতে পারা (১০ এর নিচের সংখ্যাগুলো নিয়ে) ১১. বাংলা অক্ষরগুলো চিনতে পারা, পড়তে পারা ও লিখতে পারা। ১২. দুটি বাংলা অক্ষর নিয়ে গঠিত শব্দসমূহ পড়তে ও লিখতে পারা। ১৩. ছবি দেখে ঘটনা বর্ণনা করতে পারা। ১৪. প্রথম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে দেয়া শব্দাবলী উচ্চারণ করতে পারা। ১৫. পরিচিতি শব্দের বিপরীত শব্দ চিনতে অথবা বলতে পারা। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় উল্লিখিত সুনির্দিষ্ট ফলাফলসমূহ শিশুকে অর্জন করতে হয়।
অর্জিত হলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা (১ম হতে ৫ম শ্রেণি) গ্রহণের জন্য শিশু প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরা হয়। প্লে-নার্শারি শ্রেণিতে উল্লিখিত ফলাফলগুলো অর্জনে প্রধান উপায় হলো শিশুর সাথে যোগাযোগে সফল হওয়া। শিশুদের সাথে যোগাযোগের (ওহঃবৎধপঃরড়হ) উপায়: শিক্ষাদান বা পাঠদানের সফলতা নির্ভর করে শিশুর সাথে শিক্ষকের সহজ ও সাবলীলভাবে ভাব বিনিময় করতে পারার উপর। তখনই সফল হয় যখন শিক্ষক/ অভিভাবকের ভাব বিনিময় সহজ ও সাবলীল হয়। ভাব বিনিময় দু’ভাবে হতে পারে। মৌখিক এবং সাংকেতিক। মৌখিক ভাব বিনিময়ের সময়ে মৌখিক এবং সাংকেতিক। মৌখিক ভাব বিনিময়ের সময়ে কিছু বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। যেমন: ১. খুব উঁচু স্বরে কথা না বলা। ২. খুব নীচু স্বরে কথা না বলা। ৩. সহজ ভাষায় সরাসরি ও ধীরে ধীরে কথা বলা। ৪. কথার ভাবের সাথে মিল রেখে কন্ঠস্বরের ওঠানামা ঠিক রাখা। ৫. শিশুদের কথা বলার মাঝখানে কথা না বলা। ৬. শিশুদের এমন প্রশ্ন করা যেখানে চিন্তা করার সুযোগ থাকে। সহজে জবাব দিতে পারে।
মৌখিক নয় এমন ক্ষেত্রে ভাব বিনিময়ের লক্ষণীয় দিকগুলো হল- ১. শিশুদের সাথে চোখে চোখে যোগাযোগ রাখা। ২. শিশুদের সাথে হাসিখুশি থাকা। ৩. শিশুদের সামনে আন্তরিকভাবে বসা। ৪. শিশুদের কাছাকাছি যাওয়া। ৫. হাত, মাথা ও নাড়াচাড়ার মধ্যে একটি সমন্বয় রক্ষা করা। কথার ভাবের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ঠিক রাখা।
শিক্ষায় শিশুর মেধা-মনন এর ক্ষেত্রকে সুরক্ষা দেয়। শিশুকে এমনভাবে মানসিক ভাবে তৈরি করে যাতে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনন্দ পায়, স্বস্তি পায়। অন্য কথায় উল্লিখিত লক্ষ্যের দক্ষতা অর্জনে উপযোগী হয়ে উঠে শিশু। ফলে বিদ্যালয়ের পরবর্তী শ্রেণিতে (১ম হতে ৫ম…) পাঠ গ্রহণে ও লেখা-পড়া করায় ভয় ভিতি থাকবে না। মানসিক চাপ ছাড়া শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। এতে শিক্ষা গ্রহণে শিশুর মনে কোন বিকার বা বিরূপতা দেখা যাবে না। তাই প্লে ও নার্শারি শ্রেণিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ফসল উপযোগী জমি তৈরিকে ও ফসলের বীজ সুস্থ হওয়াকে কৃষক যেমন ভালো ফলনের জন্য গুরুত্ব দিয়ে থাকে তেমনি। জমি তৈরির মত সন্তানের শিক্ষা গ্রহনের পরিবেশকেও সন্তানের উপযোগী করতে হবে। ভালো ও সুস্থ বীজের মত সন্তানের মানসিকতা গড়ে উঠার জন্য উপরে দেওয়া ১৫টি ফলাফল শিশুকে অর্জন করাতে হবে। তবেই আমাদের সন্তানরা সুস্থ ধারায় বিকাশ লাভ করতে পারবে। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা নিয়ে শিশুরা বড় হতে পারবে। এখানেই প্রয়োজন শিশু শিক্ষায় বাড়তি মনোযোগ দিয়ে উল্লিখিত পরামর্শ ও নির্দেশনা মতে শিক্ষায় শিশুর বিকাশে যত্ন নেওয়া। তবে শিশুদের ভবিষ্যত সুন্দর হওয়া নিশ্চিত হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট, অধ্যক্ষ-খলিলুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ