প্রেক্ষিত বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

1

মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন

দক্ষিণ এশিয়া বরাবরই একটি উত্তেজনাপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের দুটি পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীর সীমান্তে নতুন করে সংঘর্ষ, উভয় দেশের রাজনৈতিক ভাষ্য এবং সীমান্তে বাড়তে থাকা সামরিক তৎপরতা গোটা অঞ্চলের জন্য এক অশনিসংকেত হয়ে উঠেছে। এ ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি শুধু ভারত ও পাকিস্তানকেই নয়, বরং এর প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়।
পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণরেখায় ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে এবং ২০২৫ সালের শুরুতে যে ধরনের গোলাগুলি ও হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাতে উভয়পক্ষের বেশ কিছু সেনা হতাহত হয়। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তানপন্থী বিদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছে ইসলামাবাদ। অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তে আগ্রাসন চালাচ্ছে। যুদ্ধোন্মাদনার এই পরিবেশে উভয় দেশই তাদের সামরিক বাজেট বাড়িয়েছে এবং নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো একটি মধ্যম আয়ের, শান্তিপ্রিয়, ঘনবসতিপূর্ণ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ একদিকে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী, অপরদিকে ইসলামি দুনিয়ার প্রতি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সংহতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গেও একটি মধ্যপন্থী অবস্থান রক্ষা করতে চায়।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তার সার্বভৌম কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা। কারণ যেকোনো একপক্ষের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ভারত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার, আবার মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় অংশ পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রভাবাধীন অঞ্চলে কর্মরত। যুদ্ধ বা উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও পড়তে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার স্থল ও আকাশপথের চলাচল বিঘ্নিত হলে আমদানি-রপ্তানিতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
যুদ্ধের ভয়াবহতায় খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বাড়তে পারে। রেমিট্যান্স প্রবাহে হঠাৎ পতন ঘটতে পারে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও এ ধরনের সংঘাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশে শরণার্থী সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি কাশ্মীর অঞ্চলে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু হয়, তাহলে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে ভারতে এবং ভারত থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে কিছু নির্যাতিত জনগোষ্ঠী পালিয়ে আসার সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। এই নীতির আলোকে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়া উচিত শান্তির পক্ষে, সংঘাত নিরসনের পক্ষে এবং জাতিসংঘ ও দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর মাধ্যমে কূটনৈতিক সমাধানচেষ্টার পক্ষে। এই উত্তেজনার পারিপার্শ্বিক প্রভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণ, সামাজিক উত্তেজনা ও মতপার্থক্যের সুযোগে বিভ্রান্তি ছড়ানোর আশঙ্কাও থাকে। এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক সংহতিকে অটুট রাখতে সরকার, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা কেবল সীমান্তের বাইরে নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরেও নানা ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন আরও সক্রিয় ও কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা। আঞ্চলিক সংহতি বজায় রাখতে শুধু ভারতের সঙ্গে নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও কৌশলগত যোগাযোগ রক্ষা করা জরুরি, যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। একইসঙ্গে, সার্ক ও বিমস্টেকের মতো আঞ্চলিক জোটকে সক্রিয় করার জন্য বাংলাদেশ একটি গঠনমূলক ভূমিকা নিতে পারে- যা এই উত্তেজনা নিরসনে সহায়ক হতে পারে।
বস্তুত, যুদ্ধ কেউ চায় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কখনো কখনো যুদ্ধ একটি কৌশল, একটি বিভাজন নীতি কিংবা বৃহৎ শক্তির স্বার্থে পরিচালিত নাটকের অংশ হয়ে ওঠে। ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্বও অনেকাংশে তেমন এক দীর্ঘস্থায়ী শীতল যুদ্ধের রূপ ধারণ করেছে, যেখানে মাঝেমধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে, আবার নিভেও যায়। কিন্তু এর ছায়া পড়ে তাদের প্রতিবেশীদের ওপর। বাংলাদেশ এই ছায়া এড়াতে চায়। সে চায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, আঞ্চলিক শান্তি, এবং কূটনৈতিক ভারসাম্য। বাংলাদেশ চায়Ñ ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রই আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসুকÑ সংঘাত নয়, সহযোগিতার ভিত্তিতে আগাক।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার এই সময়ে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এক বড় পরীক্ষার মুখোমুখি। এই সংকটে বিচক্ষণ নেতৃত্ব, বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং শান্তির পক্ষে দৃঢ় অবস্থানই পারে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাব্য বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বে একটি নৈতিক অবস্থানে দাঁড় করাতে।

লেখক : ব্যাংকার, কবি ও কলামিস্ট