প্রাসঙ্গিক : ভিক্ষাবৃত্তি, দুর্নীতি

0

মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী

২১ রমজান দুপুর দুইটা’র দিকে সিএনজি অটো রিক্সাযোগে চট্টগ্রামের হযরত মিসকিন শাহ’র মাজার অতিক্রমকালে চালক ভিক্ষুকদের সারিবদ্ধ লাইন দেখে বলে উঠেন রমজান মাসে এতো ভিক্ষুক কোত্থেকে আসে? ওখানে কমপক্ষে শ’থেকে দেড়’শ ভিক্ষুক সারিবদ্ধভাবে ফুটপাতে বসে ছিল ভিক্ষার অপেক্ষায়। অনুমান করছি, চালকের বয়স সত্তুরের কাছাকাছি হবে। তিনি বলেন, আজকাল অনেক সুস্থ নারী পুরুষ ভিক্ষা করে। আমি তার কথায় সায় দিয়ে বল্লাম অসুস্থ বিকালংগ মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরকেই দান খয়রাত করা উচিৎ, এটাই ইসলামের বিধান। হয়তবা আমার কথায় উৎসাহী হয়ে তিনি বলে উঠেন একটা ঘটনার কথা বলি, একদিন বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারের সামনে দুই পা নেই এমন একজন ভিক্ষুক আমাকে বল্ল আমাকে কয়েকটা সিগারেট এনে দেন।আমাকে টাকা দিয়ে বল্ল, ব্যানসন সিগারেট আনবেন। আমি অবাক হলেও মনে মনে ভাবলাম হয়তবা মন চেয়েছে তাই ব্রান্ডেড সিগারেট চাইছে। এনে দেয়ার পরে পাশের আরেক ভিক্ষুক বলে উঠে আমাকে একটা সিগারেট দাও না।গতকাল না তোমাকে খাওয়ালাম। চান্দগাঁও’য়ে বাড়ি করে কিপটেমি কেন করছো? ভাবতে পারেন একজন দুই পা নেই ভিক্ষুকের চান্দগাঁও’তে বাড়ি আছে? গন্তব্যে পৌঁছাতে আরও সময় ছিল তাই সেই চালক আরেকটা ঘটনা বলেন, আমি যেখানে থাকি সেখানে এক দোকানদার এক পংগু ভিক্ষুকের নিকট থেকে বকেয়া টাকা নিচ্ছিল। চালক, দোকানীকে জিজ্ঞেস করেন এতো টাকা দিচ্ছে যে! দোকানী তখন বলেন দিনে ওর এক হাজার টাকার ওপরে চা’য়ের বিল হয়। শুধু কি তাই, সে দিনে আটশো/হাজার টাকার মদ কিনে খায়। কল্পনা করা যায় এরা ভিক্ষার টাকা দিয়ে মাদপান পর্যন্ত করে থাকে। আমার শোনার আগ্রহ দেখে চালক আরেকটা ঘটনা বলেন, একজন কুঁজো ভিক্ষুকের দেখা পেয়েছিলাম সেখানে আমার গ্রামের একজন মানুষ থাকে। সে জানায় এই ভিক্ষুকের দৈনিক আয় দুই হাজার টাকার ওপরে। আরও চমকপ্রদ এবং মজার বিষয় হচ্ছে সে বিয়ে করেছে তিনটি। এই হচ্ছে আমাদের দেশের কতিপয় পংগু বিকালংগ মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন সবল স্বাভাবিক সুস্থ বা অসুস্থ ভিক্ষুকদের দুঃখের সুখের এবং বিলাসী রকমারী জীবন কাহিনী যা নাটক সিনেমাকেও হার মানায়। এদের অনেকেই মাদকাসক্তি মাদকের বেচাকেনা বহুবিবাহসহ বিবিধ অনৈতিক অনৈসলামিক কর্মকাÐ ও অপরাধে জড়িয়ে আছে। তবে একথা অনস্বীকার্য, সব ভিক্ষুকদেরকে একই পাল্লায় মাপা কোনোমতেই উচিৎ হবে না। কেননা অনেকেই সত্যিকার অর্থে দু:স্থ গরীব অসহায় বৃদ্ধ পংগু বিকালংগ মানসিক শারীরিক এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানের নদী ভাঙ্গনে বাস্তুহারা পরিবারও আছে। তারা অনেক কষ্টে জীবন যাপন করছে। তবে গুটিকয়েক বিপথগামী ভিক্ষুকদের মতো অন্যরা মাদকাসক্ত অসৎ নোংরা অশ্লীল বিকৃত রুচির মন-মানসিকতা তারা অন্তরে ধারণ বা লালন করে বলে মনে হয় না। ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তিকে অনুমোদন দেয়া হলেও এটাকে খুব নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যারা সবল সুস্থ স্বাভাবিক তাদের অবশ্যই কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করা উচিৎ। পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেয়া মোটেই কাম্য হতে পারে না। কেননা মানুষের কাছে হাত পাতা কোনো পেশা হতে পারে না, ব্যবসা হতে পারে মাত্র। এ-পেশাটি ক্রমশ ভয়াবহ মারাত্মক সামাজিক ব্যাধির রূপ পরিগ্রহ করছে। সমাজকে এ-ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা অতীব জরুরি। কর্মের মাধ্যমে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত মার্জিত বনেদী ধনী অভিজাত প্রভাবশালী প্রতাপশালী দানবীর সসমাজসেবক শিক্ষানুরাগী এবং অসৎ রাজনীতিবিদদের অনেকেই যেভাবে দেশ জাতি রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির সম্পদ দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি প্রভাব প্রতিপত্তি সন্ত্রাস বাহুবল হুমকি হামলা মামলা শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে জবরদখল লুটপাট লুন্ঠন হরণ গ্রাস করছে সেখানে ভিক্ষুকদের এহেন কর্মকান্ডকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা যায়না। এসব নির্লজ্জ মানুষগুলোর শিষ্টাচার বহির্ভূত বুভুক্ষু আচার আচরণ নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত মন-মানসিকতা রুচিবোধ ধর্মের প্রতি বৃদ্ধাংগুলি প্রদর্শন ভিক্ষুকদের চেয়েও অধম জঘন্য ন্যাক্কারজনক এবং নিকৃষ্ট। ভিক্ষুক হাত পেতে খায় আর এরা জোর করে গ্রাস করে। পাশিপাশি বিভিন্ন পাবলিক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কতিপয় ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজ ও ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপ্যাল ভিসি’রা পর্যন্ত আজ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এসব শিক্ষকদের চারিত্রিক স্খলন নৈতিক ও মানবিক অধঃপতন জাতির জন্যে একটি বিরাট অশনি সংকেত। দুর্নীতিবাজ দুশ্চরিত্রের এবং অসৎ মানুষদের নিকট থেকে কিভাবে ভালো শিক্ষা উপদেশ আশা করা যায়! তাঁদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। দুর্নীতিবাজ আমলাদের দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে সেটি দেশের মানুষের কাছে অজানা নয় মোটেও। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হরিলুট এবং অন্যায় প্রভাবের কারণে দেশের আর্থিক-ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংকিং খাত আজ বহুমাত্রিক ভয়াবহ বিপর্যয় এবং হুমকির সম্মুখীন। ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা উত্তোলন করতে পারছে না।
নতুন নোট ছাপিয়েও তা সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অদ্যাবধি সম্ভব হচ্ছে না। যদিওবা সমাজের অসৎ দুর্নীতিবাজ মানুষগুলো মনের সুখ আনন্দ আর আর্থিক সংগতি নিয়ে আলিশান আকাশচুম্বি প্রাসাদে দেশে ও বিদেশ অবস্থান করছেন। এদের অন্তরে হৃদয়ে ন্যায় নীতি পাপ পূণ্যের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয়না। দেশের দুঃখী নিরহ মানুষের হক মেরে কতদিন আরামে আয়াসে থাকা যাবে? দেশে থাকতে না পারা বা দেশে ও দেশের বাইরে পালিয়ে থাকার যন্ত্রণার আগুনে ওদের অন্তর আর হৃদয় কি প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে না। তবে ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন অন্যায় অবশ্যই অন্যায়। মনে রাখা ভালো, ‘হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট’ (সুরা নিসা-আয়াত’৬ এর অংশবিশেষ)।আল্লাহ্ তায়লা অন্য জায়গায় ইরশাদ করেছেন, “আমি সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের কোন কোন ব্যক্তিকে ভোগ করার জন্য যা দিয়েছি আপনি তা লক্ষ্য করবেন না, তারা বিশ্বাসী না হওয়ার জন্য আপনি দুঃখিতও হবেন না, আপনি বিশ্বাসীদের প্রতি বিনয়ী হবেন।” (১৫:৮৮)“বলে দিন, নিশ্চয়ই আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী।” (১৫:৮৯)। আল্লাহ সুবাহানা তায়ালা আমাদের সকলকে তাঁর দেখানো সহজ সরল পথে পরিচালিত করুন এবং আখেরাতের হিসাব সহজ করে দিন।এবং পাপাচার থেকে মুক্ত রাখুন।

লেখক : প্রাবন্ধিক