কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
চাকরির শুরুতে ১১তম বেতন গ্রেড নির্ধারণসহ তিন দফা দাবিতে গত সোমবার থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেছেন দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের ডাকে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। যদিও গত ২৯ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের সঙ্গে বৈঠকের পর চলমান কর্মবিরতির কর্মসূচি আগামী ২৫ জুন পর্যন্ত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ। সংগঠনটি জানিয়েছে, প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতির দাবিতে ইতিবাচক পরিবর্তন প্রায় চূড়ান্ত। আর ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন কার্যক্রম চলমান এবং দ্রæততম সময়ে এই বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে বলে তারা আশা করছে। এ ছাড়া সহকারী শিক্ষকের শুরুর পদের বেতন ১১তম গ্রেডের প্রস্তাব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এবং খুব শিগগির শিক্ষকনেতাদের সমন্বয় করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করা হবে।
সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তিন দফা দাবি আদায়ে কর্মবিরতি কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে।
এর আগে তিন দফা দাবিতে ৫ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত এক ঘণ্টা, ১৬ থেকে ২০ মে পর্যন্ত দুই ঘণ্টা, ২১ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা।
আন্দোলনকারী সহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবি হলো প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করা পরামর্শক কমিটির সুপারিশের যৌক্তিক সংস্কার করে সহকারী শিক্ষক পদকে শুরুর পদ ধরে ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন ও প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতিসহ দ্রæত পদোন্নতি। যদিও দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড এক ধাপ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে সহকারী শিক্ষকদের শুরুর বেতন গ্রেড ১২তম এবং প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড হবে। এ উদ্যোগে সন্তুষ্ট নন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণ।
কিছুদিন আগে প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়ার রায় হয়েছে হাইকোর্টের আপিল বিভাগে। যা খুবই ইতিবাচক এবং শিক্ষক সমাজের জন্য সুসংবাদই বটে। দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের।
অন্যদিকে, দেশে প্রায় তিন লাখেরও বেশি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। যাদের মধ্যে অধিকাংশই স্নাতক-স্নাতোকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের বেতন বৈষম্য রয়েই গেছে। ১৩ তম গ্রেড প্রদানে সেই বৈষম্য নিরসন হয়নি। তাদের দাবি ছিল প্রধান শিক্ষকদের পরের স্কেলে বেতন পাওয়ার। অথচ সেটা হয়নি। করোনা পেন্ডামিকের আগে ঢাকায় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করতে চাইলেও সেখানে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন সহকারী শিক্ষকরা।
এর আগে শিক্ষকদের ১১ তম গ্রেডে বেতনস্কেল দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল সহকারী শিক্ষকদের! অথচ সেই আশ্বাস ছিল ফিকে। পাশাপাশি কিছু শিক্ষক নেতার লোভ-লালসাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে! বেতন বৈষম্য নিরসনের পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবেই তারা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখেন। তাছাড়া, মানুন কিংবা না মানুন বিদ্যালয়ে ক্লাস ও অন্যান্য কাজকর্মে সহকারী শিক্ষকরাই অনেক বেশি শ্রম দিয়ে থাকেন। এমনিতে যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশন হয়না অনেক সহকারী শিক্ষকের। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অবসরে যান। আমার নিজের চাকুরির বয়সও ২৫ পেরিয়েছে, এখনো পদোন্নতির আশা বুকে বেঁধে আছি। জানিনা আদৌ হবে কিনা! পদোন্নতি নিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। মামলা-মোকদ্দমা, রেষারেষি পাশাপাশি কচ্ছপ গতির কাজের কারণে মাঝখানে চলতি দায়িত্ব চালু হলেও তা আবারো বন্ধ রয়েছে। এসবের নিরসন জরুরি। যথাসময়ে পদোন্নতি হলে বঞ্চিত থাকবেননা যোগ্য শিক্ষকরা। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। বাড়ানো হয় নানা সুযোগ সুবিধা। ভিত্তি যেমন দুর্বল বা সুদৃঢ় না হলে দালানের কাঠামো নড়বড়ে হতে পারে তেমনি জীবনের শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন সঠিকভাবে না হলে পুরো শিক্ষাজীবনও সুদৃঢ় হবে না। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক।
বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে সরকার। দেয়া হচ্ছে পুরো সেট নতুন বই, উপবৃত্তি, মিড ডে মিল, নানা ধরনের শিক্ষাসামগ্রীসহ অনেক কিছু। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষকদের নতুন ও আধুনিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তাও নিয়োগ পেয়েছেন, পাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে। এতকিছু হচ্ছে, কিন্তু প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যসহ শতভাগ পদোন্নতি সমস্যা যৌক্তিকভাবে সুরাহার কার্যকর উদ্যোগ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়।
সবদেশেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে শিক্ষার ভিত্তিমূল ধরা হয় যা আমাদের দেশেও ব্যতিক্রম নয়। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারিকরণের কারণে সারাদেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হয়েছে। তাতে চাকরিরত রয়েছেন বহু শিক্ষক। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোকে ঢালাওভাবে সরকারি করার সাথে শিক্ষাবিদ, গবেষক সহ অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন।
প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার রায় হলেও সহকারী শিক্ষকরা থাকছেন তৃতীয়তেই। আমি মনে করি, এখন প্রাথমিকে প্রায় সব শিক্ষক যোগ্যতাসম্পন্ন। তাই সকলের পদমর্যাদা ২য় শ্রেণিরই হওয়া উচিত।
মূলত: নতুন বেতন স্কেলের মাধ্যমে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে শিক্ষকদের মাঝে চরম বেতন বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন প্রাথমিক শিক্ষকগণ। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে স্কেলের তফাৎ বিস্তর। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বেতনস্কেল ১১ তম গ্রেড নির্ধারণ করাসহ শিক্ষকদের অপরাপর দাবির বিষয়ে সহকারী শিক্ষকদের চাওয়া অবিলম্বে মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকদের দাবিসমূহ সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং মেনে নেওয়ার মতো।
আর কত উপযুক্ত সম্মানী থেকে শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হবে? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে কীভাবে শিক্ষকরা জীবন পার করছেন তা বলা খুবই মুশকিল। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য ধরে রাখতে হলে বিজ্ঞানসম্মত ক্লাশ রুটিন প্রণয়ন, শর্তহীন শতভাগ উপবৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসন করতে হবে। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেডে বেতন স্কেল নির্ধারণ, প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতি ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করা বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট