প্রসঙ্গ : শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষা ব্যবস্থা

1

বাসুদেব খাস্তগীর

অনেক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির ছায়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এটা কেউ অস্বীকার করবেন না। ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’- এ কথাটি বসের অফিসের দরজায় সুন্দর ঝকঝকে লেখাতেই সুন্দর। অনেক প্রতিষ্ঠানের ভিতরে তার যে কালি তা মোছনীয় নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। এটি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বা প্রশাসনিক ছত্রছায়াতেই গড়ে ওঠে। এটি একটি চক্র। কেউ এককভাবে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারেন না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে স্থান নিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে যোগসাজসে দুর্নীতিতে মত্ত হয়। এখানে উচ্চ মধ্য ও নিম্ন লেবেলের নানা পক্ষ আছে। এটি পুরানো সংস্কৃতি, আজকের নয়। দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মহড়া চলে, যা এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৫ ভাগেরই বেশি। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যদি হয় সেটা হয়তো অন্যভাবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এ সিংহভাগ অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় অনেকটা সরকারের তদারকি বহির্ভুতভাবে। তদারকির নামে যা আছে, তা যাচ্ছে তাই। ফলে অনেকেই দৌড়ে আসতে চায়। তবে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভালো মননশীল মানুষ যদি থাকে সেখানে কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবে অধিকাংশই এই দুষ্টু চক্রের বাইরে যেতে পারে না। প্রত্যেক ক্ষমতাসীন সরকার তার রাজনৈতিক ভিত্তিকে জোরদার করার প্রক্রিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। সব সরকার রাজনৈতিক দল কৌশল হিসাবে একে ব্যবহার করতে গিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের মৌলিক দাবিকে বারবার ‘এই সেই’ বলে বলে উপেক্ষা করে আসছে। সেই পরিণতির কুফল আমরা দেখছি। এখানে ওপর নিচের প্রায় সবাই সুবিধাভোগী।
মাঝখানে শিক্ষকরা কোথাও যেতে পারেন না। তারা কেউ কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে হোক বা যে কোনো কারণে নৈতিকতা বিবর্জিত কাজে জড়িয়ে পড়েন। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র ঐভাবেই তার কাঠামো তৈরি করে রেখেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। আপনি প্রতিষ্ঠান প্রধান হলে আমলাদের অফিসে দৌড়াদৌড়ি করলে বুঝবেন কত ধানে কত চাল, কত হাবভাব! একজন করণিক ও আমলার কাছে শিক্ষকের স্থান কী রকম তা আর নাই বললাম। রাষ্ট্র যেন একটি সিস্টেমে শিক্ষককে করুণার পাত্রই করে রেখেছে। আপনাকে পড়ালেখার চাইতে প্রশাসনিক কাজের দৌড়াদোড়ির ওপর রাখতে পারলেই কারো কারো পরম সন্তুষ্টি। এখন দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে বলুন, দেশের কোন সেক্টর ধোঁয়া তুলসীপাতা? ডাক্তারি পেশা, আইন, ভ‚মি, আমলাতন্ত্র সবাই এখন তেমন আলোচনায় নেই। আলোচনায় শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষক। যাদের ওপরে যাবার জায়গাও নাই, নিচেও নাই। সব সরকার তাদের নানা দাবিতে আন্দোলনে রেখে রেখে তাদের মর্যাদাকে ফুটপাতের পণ্যে পরিণত করেছে। শিক্ষকরা কিছু কথা বললে দশজন তার বিরুদ্ধে কথা বলতে আসেন। কারণ এ রাষ্ট্র তার অভিভাবক হয়ে উঠতে পারেনি। কোচিং বাণিজ্য, দলীয়করণসহ নানা অভিযোগের তীর তার দিকে। অস্বীকার করছি না? কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা তাকে ঐ পথে ধাবিত করেছে সেটা কেউ বলছে না? চিকিৎসা নৈরাজ্য, ডাক্তারের ফিস, অফিস আদালতে ঘুষ সব আজ গৌণ হয়ে গেছে শিক্ষকের মাথার থাপ্পড়ের কাছে। এক শ্রেণির মানুষকে বলতে দেখা যায়, কোনো আদর্শ ও নীতিবান শিক্ষক লাঞ্ছিত কখনই হন না, কিন্তু তাদেরকে অন্য পেশার দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য লক্ষ করা যায়নি। অপরাধকে আইনের গতিতে চলতে দেয়া উচিত। মাত্র ১২৫০০ টাকা দিয়ে পঞ্চগড় থেকে চট্টগ্রামে এসে শিক্ষকতা করা একজন স্কুল শিক্ষক কমিটি সভাপতির কাচারিতে গোলামি করে থেকে একবেলা খেয়ে না খেয়ে রয়, তার খবর কে রাখি! তার কাছে নানা কথাতো হজম করারই বিষয়! কারণ বাঁচতে তো হবে। দেশে দল থাকলে যে কেউ যে কোনো দলের বিশ্বাসী হতেই পারেন। কিন্তু শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতির বাইরে থাকা উচিত। তবে আমাদের রাজনীতি নির্ভর প্রশাসনে অনেকের এর থেকে বাইরে থাকার সুযোগ থাকে না। নিজের পদ রাখার ঐ দলের আদর্শে বিশ্বাসী না হয়েও বিশ্বাসের ভান ধরতে হয় চাকরির স্বার্থে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের চাবি শিক্ষকের হাতে নাই। আছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। কিন্তু তারা তা করেন না। মাঝখানে শিক্ষকরাই শিকার হন। দলে বিশ্বাসী কোন সেক্টরে নাই? প্রত্যেক সেক্টরে আছে। আমার দীর্ঘ চাকুরি জীবনে সব রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের শিক্ষকদের সাথে স¤প্রীতির সহিত চাকরি করেছি। এটা কমবেশি সবকালেই ছিল। এখন যেটা হচ্ছে সেটা নিছক কোনো লাঞ্ছনার বাইরেও অন্য কিছু। একটু বিশ্লেষণ বা গভীরে গিয়ে দেখলে দেখবেন শিক্ষকদের যে দাবির কথাগুলো- সেগুলো তাদের ব্যক্তিক কোনো কথা নয়, সেগুলো বাস্তবায়ন হলেই শুধুই শিক্ষকের কল্যাণ নয়, এর সাথে রাষ্ট্রিয় কল্যাণও জড়িত। কিন্তু একথা কেউ মানতে চান না। অনেকে এগুলোকে শিক্ষকদের ব্যক্তিক চাহিদার সাথে মিলিয়ে ফেলেন। অন্য সব পেশাকে পেশা বলা হলেও, শিক্ষকতাকে বলা হয় ব্রত। বুকে ক্ষত নিয়ে শিক্ষকতা ব্রত হয়ে ওঠে না। প্রত্যেক সরকারই নানা আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে আনা সিকি দিয়ে দিয়ে এটাকে এক ধরনের গুরুত্বহীন পেশাতে পরিণত করেছে। সেজন্য অনেকেই যা খুশি তা বলতে আসে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে শিক্ষকদের নিয়ে এভাবে বলা যায় কিনা জানি না। একটু খেয়াল করলে দেখবেন অনেক মেধাবী ছাত্র বেশ কয়েক বছর আগে থেকে এনটিআরসি এর মাধ্যমে নিয়োগ পেলেও তারা শিক্ষায় যোগদান করেনি। কারণ এখানে কী আছে তারা অনেক বিশ্লেষণ করেছে। ফলে আমরা মেধাবীদের এখন আর শিক্ষকতায় তেমন পাচ্ছিনা। আমার নিজের নিজের প্রতিষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র যোগদান করার কয়েকদিন পরেই ব্যাংকে জয়েন করেছে। এরপর আপনারা ভাবুন। সকল সরকারের আমলে নানা দাবি মানা হচ্ছে, হবে, প্রক্রিয়াধীন, বিবেচনাধীন বলতে বলতেই দিন শেষ। এক ধরনের অসুস্থ চর্চার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার দিনকাল যাচ্ছে। স্যোশাল মিডিয়ায় নানা নির্যাতনের ছবি দেখে শিহরিত হওয়া ছাড়া কী-ই বা করার আছে। কথা বললেই বিপদ। নানাজন নানাভাবে তেড়ে আসে। সেটা অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
শিক্ষকদের দ্বারাই শুধু নির্বাচনী দায়িত্ব নেয়া হয় না, আরো অনেকেই আছেন। কিন্তু শিক্ষকরাই সমাজে প্রচলিত কথার মত ‘গরিবের বউ সকলের ভাবী’-ই হয়ে গেলেন। এদেশের প্রেক্ষাপটে সময়ে সময়ে অসম্মানিত এক অফিসারের নাম প্রিজাইডিং অফিসার। বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় বদলি না থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধান ও এলাকার ক্ষমতার রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে যে স্বৈরাচারের রূপ ধারণ করেন তা অম‚লক নয়। যার কারণে রাজনীতির আবহে তিনি ভুলে যান সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থও। কারণ সাধারণ শিক্ষকরা রাজনীতি বা ক্ষমতার বলয়ের কেউ নন। তারা নিজের চামড়াকে গÐারের চামড়া মনে করে সব কিছু হজম করে কোনোমতে চাকুরি হতে অবসরেই চলে যান। দীর্ঘদিন এভাবে থাকতে থাকতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের চরিত্রের যে রূপ তা রাষ্ট্র কাঠামোই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে প্রধান সেখানে পুতুল মাত্র। প্রতিষ্ঠান প্রধানের বদলি ব্যবস্থা থাকলে অন্তত পরিবেশ এরকম থাকতো না। সব কিছুর মূলেই দুষ্টু ও অসুস্খ রাজনীতি। একজন শিক্ষকের মুখে শোনা কথা, ২০০০ টাকার ভোটের ডিউটির জন্য ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে একজন শিক্ষক ছুটে যান অফিসে। কারণ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য টাকা দরকার। ব্রতটাকে পরেই রাখেন। এদেশে এখনো এদেশে একশ্রেণির মানুষ আছে যারা এখনো একজন শিক্ষকের অবসর সময়ে হাতে লাঠি আর ছাতা দেখলে মনে তৃপ্তি পায়।
শিক্ষকের যেন গাড়ি বাড়ি থাকা নিতান্তই বেমানান। বৃটিশদের ‘বিভক্ত কর আর শাসন কর’ এই নীতি শিক্ষকদের কাছে প্রয়োগ করা গেছে সবসময়। অর্থই সেখানে নিয়ামক শক্তি। এক পক্ষ কিছু সুযোগ সুবিধা পেলে তারা আর সাধারণের কথা বেমালুম ভুলে যান। শিক্ষকদের মধ্যে বহুদা বিভক্ত সমিতি তারই প্রমাণ। এখন প্রযুক্তির যুগ। সবাই অবাধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতামত দিতে পারেন। অনেককেই দেখলাম ফেসবুকে বসেই শিক্ষকদের দোষী করে রায় দিয়ে দেন। এ দেশে শুধু কারিকুলাম পরিমার্জন আর পরিবর্তনের কত পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়. শিক্ষকদের জীবনের মানোন্নয়ন নিয়ে শুধু কথার বাহাসই থাকে। কেন যে কেউ বোঝে না অভাব মিটাতে পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদিু হয়, তা বিনিময় বণ্টন হয়, তারপর অভাবের পরিতৃপ্তি ঘটে। ব্যক্তিক অভাব পূরণের সাথে সাথে সমাজ ও ব্যবসায়ের উন্নয়ন ঘটে। মানুষের মধ্যে আবার নতুন অভাববোধ জাগ্রত হয়। এই অভাবের কারণে পণ্য ও দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করতে হয়। এটি চক্রাকারে ঘোরে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এক শ্রেণির মানুষের কাছে শিক্ষকদের উন্নয়ন ব্যক্তিক উন্নয়ন হিসাবেই থেকে গেছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহজে বের হওয়া যাচ্ছে না। বুঝতে হবে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণে মানুষের অভাবের পরিতৃপ্তি ঘটলে যেভাবে ব্যক্তিক উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটে সেভাবে শিক্ষকদের ব্যক্তিক আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটলে সামগ্রিক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটে। কারণ শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক,
বি এম সি ডিগ্রি কলেজ