প্রসঙ্গ : বেসরকারি শিক্ষক

4

রতন কুমার তুরী

সারাদেশে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে প্রায় পাঁচ লাখ বেসরকারি শিক্ষক। যাদের জীবন মানের উন্নয়ন নিয়ে বিগত সরকারগুলো খুববেশি চিন্তা করেনি। পে-স্কেল দেয়ার সময় শিক্ষকদের অন্তর্ভূক্ত করলেও তাতে বাড়িভাড়ার বিষয়টি কখনই যুক্তযুক্তভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। আর তাই পেস্কেলে অন্তর্ভুক্তির পরও বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধার স্তরটিতে বেশ বড় ধরনের ফারাক রয়েই গেছে। বিগত সরকারগুলোর সময়ে যখনই শিক্ষকরা বিভিন্ন দাবী নিয়ে আন্দোলন করার জন্য মাঠে নেমেছে, তখনই আন্দোলনকে বিভিন্ন পক্ষ থেকে বিভক্তির দেয়ালে ভাগ করে তাদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। অনেক সময় সরকারগুলো শিক্ষক আন্দোলনকে পাত্তাই দেয়নি। এরকমও হয়েছে যে শিক্ষকরা মাসের পর মাস মাঠে আন্দোলন করে চলেছে, দাবি মানা তো দূরের কথা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি কিংবা মন্ত্রীরা তাদের দেখতে পর্যন্ত য়ায়নি। গেলেও কথা দিয়ে কথা রাখেনি। শিক্ষকদের আন্দোলনকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে বারবার। শিক্ষকরা দেশের এবং শিক্ষার্থিদের কোনো ক্ষতি চাইনি বলে তারা কখনও জ্বালাও পোড়াওয়ের মত আন্দোলন করতে চায়নি। বর্তমানে শিক্ষকদের মাসে মাত্র ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা দেয়া হয়। তাছাড়া মুল বেতনের মাত্র ২৫ ভাগ উৎসব ভাতা দেয়া হয় দুই ঈদে। পুরো চাকুরী জীবনে প্রমোশন বলতে কারো কারো ভাগ্যে সহকারী অধ্যাপক পদবী জুটলেও বেশিরভাগ শিক্ষককেই প্রমোশন ছাড়াই চাকুরী জীবন শেষ করতে হয়। চাকুরী জীবন শেষ করে শিক্ষকদেরই বেতন থেকে জমাকৃত অবসর সুবিধা এবং শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের টাকার জন্য বছর পর বছর বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয়। অনেক শিক্ষক এ টাকা পাওয়ার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। অথচ উপরিউক্ত সুবিধা সমূহ সরকারী চাকুরীতে ব্যাপক। সরকারি চাকুরীতে বাড়ি ভাড়া মুল বেতনের ৩৫ ভাগ থেকে কোথাও কোথাও ৪০ ভাগ পর্যন্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রমোশন রয়েছে ধাপে ধাপে। মূল বেতন সমান উৎসব বোনাস রয়েছে বছরে দুইটা। বছরে বছরে রয়েছে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি। পড়ুয়া সন্তান দুই জনের জন্য রয়েছে মাসিক শিক্ষা ভাতা। এর বাইরে রয়েছে ভবিষ্যৎ তহবিল থেকে বিনা সুদে ঋন নেয়ার সহজ সুযোগ যা তারা যেকোনো আপদকালীন সময়ে সহজেই নিতে পারে। ২০২৪ সালে ব্যাপক গণআন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক সরকারের পতন ঘটিয়েছে এবং তারা বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারকে নিয়ে সমাজে বৈষম্য দূর করতে কাজ করছে। তারা রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে কিছু মানুষকে সরিয়ে দিয়েছে এবং রাষ্ট্র সংষ্কারে হয়তো আরো কিছু মানুষকে সরাতে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। একটি ন্যায় সঙ্গত সমাজ এবং রাষ্ট্র বিনির্মানে দেশের অধিকাংশ মানুষ তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত বর্তমান অন্তর্বতীকলীন সরকারকে সর্বোতভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সে হিসেবে দেশের পাঁচ লাখ বেসরকারি শিক্ষকরাও তাদের দিকে তাকিয়ে। যুগের পর যুগ বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে যে তামশা করে সরকারিদের সাথে বৈষম্যের দেয়াল সৃষ্টি করা হয়েছে তা একটা সুষ্ঠু নীতির মাধ্যমে এখনই একটা গ্রহণযোগ্য সমতায় আনা খুবই জরুরি। এর জন্য এ অরাজনৈতিক এবং ছাত্র জনতার আন্দোলন গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায় রয়েছে। তারা যদি দেশের মোট শিক্ষার্থির ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থিদের পড়ানো এ পাঁচ লাখ শিক্ষককের কথা এবং তাদের সাথে জড়িয়ে থাকা তাদের পরিবার পরিজনসহ আরো দশ লাখ সর্বমোট পনের লাখ মানুষের কথা চিন্তা করে বেসরকারি শিক্ষকদের একটি গ্রহণযোগ্য বেতন কাঠামো করে দেয় তাহলে তাদের পরবর্তী সরকারগুলো এ নিয়ে তেমন একটা বাড়াবাড়ি করতে পারবেনা। একটা বিষয় লক্ষনীয় যে বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলো শিক্ষকদের যে সমস্ত আর্থিক সুবিধা দিয়েছে তা কখনও সহজ পথে দেয়নি। শিক্ষকদের দিনের পর দিন আন্দোলন করতে হয়েছে। তারপরও তারা যে সমস্ত সুবিধা দিয়েছে তা একেবারে নগণ্য এবং সরকারিদের সাথে মিল রেখে নয়। আর তাই সরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধার সাথে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধার আকাশসম
পার্থক্য রয়েই গেছে। আমি বলবোনা সরকারি শিক্ষকদের সাথে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা একই থাকবে তারপরও একজন সরকারি শিক্ষক যেখানে বাড়ি ভাড়া বাবদ তার মূল বেতনের ৪০ ভাগ পর্যন্ত আর্থিক সুবিধা পায় সেখানে একজন বেসরকারি শিক্ষককে মাত্র ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া প্রদান করা এটা কোন সভ্য সমাজের নিয়ম হতে পারেনা ? বাড়ি ভাড়াটা তো অন্ততপক্ষে গ্রহণযোগ্য এবং জীবন যাপন যোগ্য ভাগে উর্ণীত করা উচিত। ১০০০ টাকা দিয়ে আজকের পৃথিবীতে কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় ? এ বাড়ি ভাড়ার বিষয়টি খুব দ্রæত একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামোতে দাঁড় করাতে পারলেই অন্যান্য সুবিধাগুলো এমনিতেই যোগ হয়ে যাবে। এর বাইরে রয়েছে শিক্ষকদের উৎসব বোনাস এটি যেহেতু বছরে মাত্র দুইবার দেয়া হয় এটি চাইলে সরকার সরকারি চাকুরিজীবীদের মতো দিতে পারে। এতে করে উৎসবের সময় অন্তত বেসরকারি শিক্ষকদের ধারদেনা করতে হবেনা। এর পর রয়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকুরি জীবন শেষে তাদেরই জমানো অবসর এবং কল্যান ট্রাস্টের টাকাগুলো যাতে দ্রুত উত্তোলন করতে পারে সেবিষয়ে বর্তমান সরকারকে একটি স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাকা যেখানেই থাকুক সেখানে যাতে সৎ মানুষরা থাকে। একজন শিক্ষক ৩০ বছর চাকুরি করে সে যদি তার জমানো টাকাগুলো জীবদ্দশায় তুলে ভোগ করছে না পারে তাহলে তার পরিবার পরিজন কীভাবে চলে ? বিষয়গুলো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিবেচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য বেতন কাঠামো করে দিলে বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে এবং সাথে সাথে বেসরকারি শিক্ষকরাও শিক্ষাক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যাবে। মূলত বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি স্থায়ী বেতন কাঠামো এবং টেকসই পদক্ষেপই পারে সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে। আর এখনই সঠিক সময় বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য কিছু করার। আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে পাঁচ লাখ বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ বেতন কাঠামোসহ টেকসই পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। যে বেতন দিয়ে শিক্ষকরা অন্ততপক্ষে ভালো এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে জীবন কাটাতে পারে। মূলত বেসরকারি শিক্ষকরা ভালো থাকলে দেশের শিক্ষাও ভালোভাবে এগিয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, পেটে ক্ষুধা নিয়ে এবং পরিবারপরিজনকে কষ্টে রেখে শিক্ষকরা ছাত্রদের আনন্দদায়ক শিক্ষা কখনই দিতে পারেনা। তাই আমরা প্রত্যাশা করবো বর্তমান বেসরকারি শিক্ষকদের প্রাণের আকুতি বুঝবেন এবং এ বিষয়ে শিক্ষকবান্ধব একটি পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক