এমরান চৌধুরী
বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন এবং বিদায়ী বছরের শেষদিনকে ঘিরে আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান আর রকমারি খাবারের। পহেলা বৈশাখের আয়োজন বাঙালির জনজীবনকে করে তোলে বর্ণিল। বাঙালির ঘরে, জনজীবনে এবং আর্থ সামাজিক সংস্কৃতিতে এরকম উৎসব তুলনাহীন। সমাজের সকল স্তরের মানুষের এই উৎসবের সঙ্গে যেমন যোগসূত্র স্হাপিত হয় তেমনই সম্মিলন ঘটে সকল সম্প্রদায়ের।
পহেলা বৈশাখের যে উৎসব আমরা পালন করি। নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠি তার আতুড়ঘর কিন্তু রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদে। নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় নতুন বঙ্গাব্দের জন্ম মোগল সম্রাট আকবরের আমলে। আকবরই বাংলা সন তথা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক।
বাংলাপিডিয়া যে তথ্য জানান দেয় তাহলো, দকৃষিকাজের সুবিধার্থেই মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সন চালু করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় ১৯৫৬ সাল থেকে। মানে পেছন থেকে। বাংলা সন চালু হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/ ১১ মার্চ। আর কার্যকর হয় ১৯৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। প্রধানত কৃষকদের খাজনাপাতি দেয়ার সুবিধার্থে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করা হয়। এ কারণে এই সনের আরেক নাম ‘ফসলি সন’। প্রথমে এই নামটিই প্রচলিত ছিল, পরে এর পরিচিতি দাঁড়ায় বঙ্গাব্দ নামে, যা আজও কার্যকর রয়েছে।
বাংলা নববর্ষ এর আগে এ অঞ্চলের মানুষেরা ঋতুভিত্তিক বিভিন্ন উৎসব পালন করত। বঙ্গাব্দ প্রবর্তিত হওয়ার পর বৈশাখের প্রথম দিনের উৎসব তাদের জীবনের অন্যতম আনন্দঘন দিন হিসেবে পরিণত হয়। বৈশাখের এ উৎসবকে সর্বজনীন উৎসব বলা হয়, কারণ এ উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের মানুষ সবাই যার যার মতো করে জীবন যাপন এবং নিজস্ব রীতিনীতি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ধর্মানুযায়ী আচার ও ধর্ম পালন করে।
বঙ্গাব্দের শুরু হয় প্রধানত কৃষকের সুবিধার্থে। কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলেই নিজেদের জীবনের আর্থিক বিষয় সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেন এই সনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ, বিশেষ করে খুচরো ও মধ্য পর্যায়ের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হিসাবের খাতা সংরক্ষণ ও কার্যকর রাখা হয় এই সনের দিন তারিখ ও মাসের সঙ্গে মিলিয়ে। কারণ এভাবে হিসাব রাখার ফলে তাদের বছরের শেষে গিয়ে পুরো বছরের ব্যবসার দেনা পাওনার গতিপ্রকৃতির স্বরূপ বুঝতে যেমন সুবিধা হয়, তেমনি বছর শেষে গিয়ে একটা বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে নতুন বছরের হিসাবের খাতা খুলতে সুবিধা হয়।
বাঙালি ব্যবসায়ীদের জীবনে হালখাতার প্রচলন শুরু হয় এ সনের বিদায়ী মাসের শেষের কয়েকদিন ও আগমনী বর্ষের শুরুর কয়েকটা দিনকে ঘিরে এবং এর মধ্যে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় পহেলা বৈশাখের দিনটা। যেটি বৈশাখী উৎসব হিসেবেই সকলের কাছে পরিচিত ও বিশেষভাবে আদৃত ও গৃহীত। হালখাতাকে ঘিরে এই যে আয়োজন ও উৎসব এটা প্রধানত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলেও এখানে সীমিত পরিসরে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে এবং বাস্তবিকই সেই ধরণের উপস্থিতি ঘটেও থাকে।
হালখাতা যে প্রথা সেটি শুরু হয়, মূলত সনাতন ধর্মের অনুসারী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। বাঙালি সমাজে ব্যবসার গোড়াপত্তনও হয় অবশ্য এদের হাত ধরে। সনাতন ধর্মের অনুসারীরা প্রায় সারা বছরই নানানধরণের উৎসবের রীতি মেনে চলেন। বারো মাসে তেরো পার্বণের যে প্রবাদ বাংলা ভাষা তথা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত, তা মূলত সনাতন ধর্মের অনুসারীদের পার্বন প্রথাকে কেন্দ্র করেই। এঁরাই যখন ব্যবসাকে আরও সহজ, ক্রেতাবিক্রেতা বান্ধব, এবং স্বচ্ছ ও লাভজনক করার চেষ্টার নিমিত্তে হালখাতা সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছিল সেখানে ঈপ্সিত লক্ষ্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়েই সেটাকে উৎসবমুখর করে তুলছিল। বর্তমানে হালখাতা সংস্কৃতি রীতিমতো একটা অংশগ্রহণমূলক আনন্দদায়ক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এই উৎসবের মূলে অর্থনীতির যোগসূত্র মূখ্য থাকলেও এটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যার অন্তরঙ্গে অর্থযোগ আর বহিরঙ্গে আনন্দযোগ মিলে উৎসবমুখর একটা উৎসবে পরিণত হয়।
খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বঙ্গাব্দের প্রবর্তন হলেও, বঙ্গাব্দ তাতে সীমাবদ্ধ থাকল না। কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলেই এই দিনটাতে নানারকমের উৎসবেও মেতে উঠতে থাকল। বাংলার সমাজ যেহেতু কৃষি প্রধান এবং এর অর্থনীতি আজও কৃষি নির্ভর। ফলে কৃষি সংশ্লিষ্ট রীতি নীতি ও উৎসব একক কোন বৃত্তে আটকে থাকল না। বিশেষ কোন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-সমাজ-গোষ্ঠীতে সীমায়িত না থেকে তা ছড়িয়ে পড়ল সকলের মাঝে। এখনও বাংলার ঘরে ঘরে সেই রীতি বহমান রয়েছে। এখনও পহেলা বৈশাখের দিন ধানের বীজ ছড়িয়ে কৃষকের বাড়ি আগমন ঘটে বরণের ডালি সাজিয়ে। উঠানে আগে থেকে রেখে দেয়া হয় পানি। তাতে দেয়া হয় কচি আম পাতা, দুর্বাঘাসসহ আরও নানাকিছু। উঠান লেপানো হয়। বাড়িতে আলাদা করে রান্নার আয়োজন থাকে। হালের গরুকে গোসল করানো হয়। ইত্যকার আয়োজনে পুরো দিন কেটে যায়।
পহেলা বৈশাখের আয়োজন এভাবে উৎসবের আমেজ ছড়াতে ছড়াতে এই অঞ্চলের, এই বঙ্গের মানুষের কাছে প্রধান উৎসবে পরিগণিত হয়েছে। লক্ষ্যণীয়, একদা যে উৎসব ছিল কেবল কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট মানুষের, যে উৎসব ছিল কেবলই অর্থের কারবার করা ব্যবসায়ী সমাজ ও তার বান্ধববেষ্টিত ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ সেই উৎসব নানা রূপে, নানা যোজন বিয়োজনের মধ্যে দিয়ে সকলের উৎসব হয়ে উঠেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এটাই একমাত্র উৎসব যেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরাও পহেলা বৈশাখের আনন্দোৎসব করেন। তারাও নিজেদের মতো করে নিজেদের স্বাজাত্যবোধ বজায় রেখে উৎসবের রঙ ছড়ান। সেখানেও লক্ষ্য করা যায় চমৎকার সব ভাবনার প্রকাশ । তাদের অন্যান্য উৎসব নিজেদের মধ্যে বৃত্তবন্দী থাকলেও পহেলা বৈশাখের উৎসব তেমনটা নয়। বিদায়ী বর্ষের চৈত্রসংক্রান্তির দিন এবং নতুন বর্ষের প্রথম দিনকে ঘিরে পাবর্ত্য জেলাসমূহে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবি’ উদযাপিত হয়। এর নামকরণ হয়েছে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই শব্দগুলোর আদ্যক্ষর থেকে। উল্লেখ্য, এ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক বলে অভিহিত করেন। পুরো পার্বত্য এলাকায় এর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বৈসাবি নামে।
পহেলা বৈশাখের সর্বজনীন রূপ নানানভাবে বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়ে সংহত এক অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এই সংহত রূপের প্রকাশ দেখতে পাই মঙ্গল শোভাযাত্রায়। এ বছর এ শোভাযাত্রার নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
রমনার বটমূলে ১৩৭২ বঙ্গাব্দ থেকে পহেলা বৈশাখের উৎসবের আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। গানে গানে তারা বৈশাখকে বরণ করে,
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি’ এ গানের ভেতর দিয়ে বাঙালি প্রতি বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে ।
দেশের প্রায় সকল বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে বঙ্গাব্দ নববর্ষের প্রথম দিনে জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজন করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় এই উৎসবের আয়োজন এত বেশি বর্ণাঢ্য হয়ে থাকে যে তা দেখার জন্য দেশের ভেতরের এক জায়গার মানুষ আরেক জায়গায় তো যায়ই দেশের বাইরে থেকেও অনেকেই আসেন। প্রবাসী বাঙালিদের কেউ কেউ দেশে বেড়াতে আসার ক্ষেত্রে পহেলা বৈশাখের উৎসবে যেন শামিল হতে পারেন, নতুন প্রজন্মকে যেন পহেলা বৈশাখের বর্ণময় উৎসবের সঙ্গে পরিচিতি ঘটাতে পারে সেদিকেও বিশেষভাবে খেয়াল রাখেন। কেননা, এই উৎসবকে ঘিরে গ্রামবাংলা ও নগর জীবন যেভাবে সেজে উঠে মেতে ওঠে তার কোন তুলনা হয় না।
বাঙালি জীবন বিবিধ সমস্যায় আকীর্ণ। এখানে আনন্দ যেমন আছে তেমনি আছে দুঃখ-বেদনা। জীবনের প্রকৃতিই এমন কখনও বন্ধুর কখনও সৌহার্দ্যপূর্ণ। বাঙালি এর মধ্যে বাঁচার স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়। নববর্ষ অতীতের দুঃখ-কষ্ট মাড়িয়ে আমাদের জীবনে নিয়ে আসুক সুখ ও শান্তির বারতা এই হোক সবার প্রত্যাশা
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক