
বাসুদেব খাস্তগীর
পথচারীদের হাঁটার জন্য ফুটপাত অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ। জনগুরুত্বপূর্ণ এই ফুটপাত শুধু হাঁটাচলা নয়, মানুষের নিরাপদ চলাচল বা যেকোনো দুর্ঘটনা রোধেও গুরুত্বপ‚র্ণ। এ বিষয়গুলো ছাড়াও শহর বা নগরের সৌন্দর্য বর্ধনেও ফুটপাত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। নগর পরিকল্পনাবিদরা সড়ক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখেন। ফুটপাত সড়কের সৌন্দর্য কিংবা নিরাপদে চলাচলের উপযুক্ত ক্ষেত্র তো বটেই, একটি প্রশস্ত ফুটপাত যানজট নিরসনেও সহায়ক। এখন দেশের নগর বা শহরগুলোতে গাড়ির এত চাপ বেড়েছে যে, সে অনুপাতে কিন্তু ফুটপাতের জায়গা আরও প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন। এখানে যানজট ও নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার পরিবেশ তৈরির জন্য ফুটপাত গুরুত্বপ‚র্ণ একটি অনুষঙ্গ। আজকাল বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোর দিকে তাকালেই তাদের সড়ক ব্যবস্থাপনার নান্দনিক সৌন্দর্য আমাদের চেখে পড়ে, সেখানে পরিচ্ছন্ন ফুটপাতও পাশাপাশি দৃশ্যমান। নগরায়নের জন্য শুধু ফ্লাইওভার, ওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসের মত বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে কাজ করলেই হবে না, প্রয়োজনে জনসংখ্যা ও জনচলাচলের দিক বিবেচনায় প্রয়োজনীয় প্রশস্ত ফুটপাতের ব্যবস্থাও চিন্তায় রাখতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ফুটপাত আছে কিন্তু তার যথাযথ ব্যবস্থাপনা নেই কিংবা ফুটপাত দখল করে ফুটপাতনির্ভর ব্যবসায় আমাদের ফুটপাতের গুরুত্বকেই খর্ব করে দিচ্ছে। জনজীবনের এ দুর্ভোগ এখন অসহনীয়। মানুষ এখন ফুটপাতে হাঁটতে পারে না। ফুটপাতে হাঁটতে না পেরে মানুষ এখন সড়ক পথ ধরে হাঁটে। ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন নিরীহ পথচারী। এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে ফুটপাত আমাদের সামনে দৃশ্যমান কিন্তু শান্তি বা স্বস্তিতে তা জনগণের ব্যবহারে কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবস্থা চলে আসছে। এই নিয়ে বহু আলোচনা সেমিনার বা লেখালেখিও কম হয়নি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কোনো সুরাহা হয়নি।
ফুটপাতনির্ভর ব্যবসার কারণে ফুটপাতের যে অব্যবস্থাপনা তার কারণের প্রায় জায়গাতেই ফুটপাত ভেঙেচুরে যেভাবে বিপজ্জনক অবস্থা ধারণ করে তার দিকে কারো নজর নেই। একারণে বাধ্য হয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে লোকজন সড়ক পথ ধরে হাঁটছেন কিংবা বাধ্য হয়ে ফুটপাতে হাঁটাচলা করতে গিয়ে নানা ছোটখাটো দুর্ঘটনারও শিকার হচ্ছেন। সঠিক নজরদারির অভাবে ফুটপাত মানুষের চলাচলের জন্য ধীরে ধীরে যেভাবে অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে তাতে মানুষের জীবন ঝুঁকিপ‚র্ণ ও নগর জীবন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। নগরীর যে কোনো জায়গায় যান দেখবেন ফুটপাত জুড়ে ছোট ছোট অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ অস্থায়ী দোকানপাট, দালান তৈরির নির্মাণ সামগ্রী ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের দোকানের ব্যবসার সামগ্রী ফুটপাতে সম্প্রসারণ করে রাখা হয়েছে। নানা ধরনের স্থাপনার বাধা ঠেলে পথচারীদের গন্তব্যে পৌঁছতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। আমাদের দেশের পার্কিং ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত নিম্নমানের। রাস্তার আশেপাশে ফুটপাত ঘেঁষে নানা ধরনের গাড়ি দাঁড়িয়ে পথচারী ও গাড়ি চলাচলে যে বিঘ্ন ঘটায় তার ভুক্তভোগী আমরা সবাই। আমাদের দেশে কিন্তু সেভাবে উন্নত ব্যবস্থাপনায় পাকিং ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। যার কারণে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। মার্কেট নির্ভর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পার্কিং ব্যবস্থাপনা কিছুটা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পার্কিং ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করা গেলে আমাদের ফুটপাতও নিরাপদ হতে পারে। এগুলো একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত। থাইল্যান্ডে বেশ কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম। সেখানকার শৃঙ্খলার অনেক দিকের মধ্যে পার্কিং ব্যবস্থাপনাটা আমার দৃষ্টি কেড়েছিল। বিশাল দালান জুড়ে পার্কিং। লিফটে পার্কিং করা গাড়ি উপরে তলায় উঠে যাচ্ছে। আবার সিস্টেমে তা নিচে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে এরকম বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশাল পার্কিং ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। ফলে ফুটপাতসহ জনজীবনে প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ যেন এ পরিস্থিতি মেনেই চলতে চলতে ক্রমাগত অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। কারণ সাধারণ মানুষের কোনো উপায় নাই। আবার কোথাও কোথাও ফুটপাতের পাশের দোকানের পণ্যসামগ্রী সামিয়ানা টাঙিয়ে রাখা হয় সামনের ফুটপাত দখল করে। ফুটপাতে ভাসমান ব্যবসায়ী, হকার, অবৈধ পার্কিং ইত্যাদি কারণে ব্যস্ততম রাস্তাগুলোতে দিনের বেশির ভাগ সময় লেগে থাকে যানজট। চারিদিকে দখল করার যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কে কোনদিকে দখল করে ফুটপাত যা আছে তার থেকেও ছোট করে ফেলবে তার অঘোষিত এক যুদ্ধ যেন আমরা দেখছি। তার ওপরে আছে দেখবেন আশপাশের বাড়ি দোকান নির্মাণের সামগ্রী ফুটপাতে রাখার প্রবণতা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা এটা মাসের পর মাস ফুটপাতে রয়ে গেছে। তারপর ফুটপাতে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার, ওয়াসার লাইন স্থাপনার কাজ, কোথাও কোথায়ও ডাস্টবিন স্থাপনের কর্মযজ্ঞতো আছেই। এ কাজগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ কারণে পথচারী ও যানবাহন চালকরা পড়েন বিপাকে। এ ভোগান্তির মধ্যে মাঝেমধ্যে ঘটছে দুর্ঘটনা। শহর বা নগর এলাকা ছাড়াও শহরের বাইরে যেখানে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে সেখানে অনেক জায়গায় এমনভাবে সড়ক তৈরি করা হয়েছে পথচারী হাঁটার জন্য কোনো ফুটপাতই রাখা হয়নি। মূল সড়ক বা রাস্তার পাশে হাঁটার জন্য সামান্য যে পরিমাণ জায়গা তা পথচারী হাঁটার জন্য মোটেও পর্যাপ্ত নয়। আর সেতুর পাশে পথচারী হাঁটার কোনো জায়গাও নাই কোনো কোনো সেতুতে। আর নগরের বাইরের অনেক বাজার সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন বসে। সেই বাজারবারের দিন দেখা যায় পুরো রাস্তার ওপর বাজার, আর একেবারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্রেতারা জিনিসপত্র ক্রয় করছেন। এটি যানজট সৃষ্টিতো করছেই, আর মানুষের জীবনও পড়ছে ঝুঁকির মুখে। মোটকথা মানুষের জীবন ঝুঁকিমুক্ত, নির্বিঘ্ন করার নিমিত্তে ফুটপাত দখলমুক্ত ও সংস্কার করার কোনো বিকল্প পথ নেই। এখানে ফুটপাত নির্ভর ব্যবসায় বাণিজ্যে অনেক পক্ষ জড়িত। দল, প্রশাসন, ফুটপাতের আশপাশের ব্যবসায়ীসহ অনেকেই এখানে আছেন। নিম্নবিত্ত শ্রেণির এক বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা এতে জড়িত। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখানে সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ফুটপাত নির্ভর ব্যবসার কারণে ফুটপাত হয়ে উঠছে অনিরাপদ। সংস্কারের অভাবে কোথাও কোথাও ফুটপাত মূল সড়কের সমান হয়ে পড়েছে, ফলে গাড়ি ফুটপাতে উঠে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। ফুটপাতে পথচারীদের নিরাপদে হাঁটার যে অধিকার তা যেন সবাই বোঝে তার পদক্ষেপ নিতে হবে। ফুটপাতে ব্যবসায় করা লোকজনরা অধিকাংশই স্বপ্ল শিক্ষিত। তারা ফুটপাতের গুরুত্ব তেমন বোঝেন না। আইনের প্রয়োগ থাকলে রাস্তা ও ফুটপাত দখল করা কোনো সাধারণ বিষয় হতে পারে না, কিন্তু আমাদের দেশে যেন তা অতি সাধারণ বিষয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ দরকার। ফুটপাত যে নাগরিকের জন্য সেটা নিশ্চয়ই প্রশাসন বোঝে, সুতরাং তা নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়াও প্রশাসনের দায়িত্ব। প্রশাসনিক অবহেলায় নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হতে পারে না। সাধারণের নিরাপদ চলাফেরা ও নগর জীবনের সৌন্দর্য বর্ধনে অপরাপর সব নান্দনিক উপকরণের সাথে সুন্দর ফুটপাতও অপরিহার্য। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, সকল পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগেই হতে পারে একটি সুন্দর নগরী।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ
প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক











