প্রসঙ্গ: দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া

1

এমরান চৌধুরী

আমাদের দেশে সবচেয়ে অসহনীয় বিষয় হলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য জিনিসগুলোর দাম যখন শুধু বাড়তে থাকে তখন যত ক্ষোভ রোষ গিয়ে পড়ে ক্ষমতাসীনদের ওপর। কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনা যেমন থাকে তেমনি থাকে মুনাফালোভীদের কারসাজি। আর বাড়ে তো বাড়ে তা যেন লাগামহীন ঘোড়া। পাগলাঘোড়াই বলা যায়, যার লাগামটানা অতীতে কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। অপশাসনে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বিগত সরকারতো পারেইনি, আর বর্তমান সরকার, যাদের কাছে মানুষের আকাশসমান প্রত্যাশা তারা কতটুকু পারবে তার দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছড়া গতি নেই। অবশ্য বর্তমান সরকার আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ১ জানুয়ারি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক ভিডিও কনফারেন্সে ‘দেশের ৩১টি জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়ে কর্মকর্তাদের নিজ নিজ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা, সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বজায় রাখা, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, সার সরবরাহ ও শিল্প এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে নিবিড়ভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেন।’
মনে রাখা দরকার, অনৈতিক উপার্জন যাদের আছে তারা ছাড়া সাধারণ মানুষের আয় সীমিত। তাদের নিত্যদিনের হালহকিকত নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। সেখানে যদি চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস আর ডিমের দাম আজ এক দাম কাল একদাম হয় তাহলে তাদের দিন চলে কি করে? অতীতে সরকার প্রধানরা মূল্যবৃদ্ধির কথা বললে সাধারণ মানুষকে ব্যঙ্গ করত। বলত ‘ভাতের বদল আলু খান/ ভাতের ওপর চাপ কমান’। অন্যদিকে কাঁচা মরিচের দাম আকাশচুম্বি হলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল দাম কম থাকা অবস্থায় কাঁচা মরিচ সিদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দিতে। দেশের নি¤œবিত্ত মানুষের জন্য এটা রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিম্নমধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে এসব কথা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার দেওয়ার সামিল।
এদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাজের লোকের কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স। সেটা আবার সগর্বে যে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়ান তখন দেশপ্রমিক মানুষেরা লজ্জায় মুখ ঢাকেন। বিত্তবানরা কোটি টাকা খরচ করে ফ্ল্যাট কেনেন। বাড়ি বানান। অথচ সামান্য কিছু টাকার জন্য অনেক মানুষ তাদের ফান্ডামেন্টাল চাহিদা মেটাতে পারেন না। অতি দরকারি ঔষধপত্র কিনতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে মরেন। মানুষ মানুষের জন্য এই মানবিক আপ্ত বাক্যটি বর্তমান সমাজে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। তার ওপর যদি দুমুঠো ডাল-ভাতের দামও দুদিন পর পর বাড়তে থাকে তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?
সামনে রমজান। আমাদের দেশে রমজান আসন্ন হলে জিনিসপত্রের দাম শোল মাছের মতো লাফাতে থাকে। মজুদদার, আড়তদার আর মুনাফালোভীরা মোছে তা দেন। রমজান যেখানে সংযমের মাস, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের মাস, মানুষের উপকার করার মাস, হালাল উপার্জনে রোজা রাখার মাস, যাকাত প্রদানের মাস, উদার হস্তে দান-খয়রাতের মাস; সেখানে সমাজে ঘটে উল্টো। দ্বীনের বিধিনিষেধ বেমালুম ভুলে যার যেমন ইচ্ছে মুনাফার উদ্দেশ্যে জিনিসপাতির দাম বাড়িয়ে দেয়। কখনো সরবরাহের স্বল্পতা, কখনো সিন্ডিকেটের তলায় পিষ্ট হতে থাকে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ১২ কোটি মানুষ। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ধকলে চরম সংকটে পড়ে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। ব্যয়ের সাথে আয়ের সঙ্গতি না থাকায় শহরে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবারের। এমনকি যেসব পরিবারে একাধিক উপার্জনকারী আছে তাদের আয় মিলিয়েও মাসিক খরচ মিটানো অসাধ্য হয়ে পড়ে।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন যখন অবস্থা তখন বর্তমান সরকার সম্প্রতি ওষুধ, এলপি গ্যাস, মোবাইল ফোনের সীমসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক ও কর বাড়িয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উচ্চমুখি চাপে সাধারণ জনগণ এমনিতেই দিশেহারা। যা কিছু সঞ্চয় ছিল তা থেকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এখন তলানিতে, সে অবস্থায় এই ভ্যাট ও কর আরোপ দুর্ভোগকে বাড়িয়ে দেবে আরো কয়েকগুণ। গত ১১ জানুয়ারি স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলা হয়েছে,’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকার শুল্ক-কর বাড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে। আর এই পদক্ষেপে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খাতসংশ্রিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে গণবিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন রাজনীতিকদের কেউ কেউ। রাজধানীর মহাখালী এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকুরে তানভির জিলুই হতাশার সুরে বলেন, ‘সরকার শুধু কর বাড়ানোর তালে আছে, আয় বাড়ল কি না তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। একে তো মূল্যস্ফীতি দুই অংকের নিচে নামে না, এর মধ্যে আবার এই ভ্যাট বাড়ানোতে অবশ্যই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। (দৈনিক পূর্বদেশ, ১১.০১.২৫)
এ অবস্থায় আসন্ন রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের কী অবস্থা হবে তা সাধারণ মানুষকে এখন থেকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ সমস্যা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কঠোর হস্তে সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রমজান মাসে ব্যবহৃত পণ্য, যেমন ছোলা, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও খেজুরের মতো পণ্য আমদানিতে জোর দিতে হবে। যেহেতু দেশে ডলার সংকট রয়েছে সেহেতু রেমিটেন্সের একটি অংশ এ খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। রোজা শুরুর আগেই যাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করতে না পারে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। সে সাথে পবিত্র রমজান মাসে টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা থাকে, সেগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক