মোহাম্মদ মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বাংলাদেশের হালদার প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত। মে মাসের ৯ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে জো আছে। আর তখন মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা। এমতাবস্থায়, ‘দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে আবারও মা মাছ মরে ভেসে উঠেছে। গত ৪ মে’২৫ বেলা ৩টার দিকে নদীর রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট এলাকায় মাছটি ভেসে ওঠে। এর ওজন প্রায় ৫ কেজি বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। এর আগে গত বছরের জুন ও জুলাই মাসে ৬টি বড় মা মাছ ও ৩টি ডলফিন মরে ভেসে উঠেছিল। এরপর তেমন মা মাছ মরার খবর পাওয়া যায়নি। তবে ডলফিন মরে ভেসে উঠেছিল আরও ৩টি’ [সূত্রঃ প্র/আলো, ৫ মে’ ২৫]। যদিও এক মাস আগে থেকে হালদায় প্রজনন মৌসুমের শুরু হয়ে গেলেও অদ্যাবধি মা মাছেরা নমুনা ডিমও ছাড়েনি। পাশাপাশি সরঞ্জাম নিয়ে কয়েক শ ডিম সংগ্রহকারী মা মাছেরা কখন ডিম ছাড়ে সে অপেক্ষায় নদীতে দিনরাত অবস্থান করছেন।কিন্তু এই প্রজনন মৌসুমে মা মাছ মরে ভেসে ওঠা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যা নিয়ে নদী গবেষকেরা উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত। কেননা প্রজনন মৌসুম শুরু হয়ে গেলেও এখনো নমুনা ডিমও ছাড়েনি মা মাছেরা অন্যদিকে মা মাছের মরে ভেসে ওঠা। কারণ, হালদার একেকটা মা মাছের ডিম থেকে বিপুল পোনা উৎপাদন হয়ে থাকে। নিঃসন্দেহে হালদা নদী দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখে যাচ্ছে। হালদা বিশ্বের বিরল বৈশিষ্ট্যের একমাত্র জোয়ার–ভাটার স্বাদু পানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। নদীটির উৎপত্তি এবং সমাপ্তি দেশের ভেতরেই। হালদা থেকে রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদী বাংলাদেশের সাদা সোনার খনি কেননা হালদা নদী থেকে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হয়। হালদা মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও উৎস। ডিম থেকে উৎপাদিত রেণু, পোনা থেকে মাছ হিসেবে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাতে হালদা নদী চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। যুগ যুগ ধরে স্থানীয় জনসাধারণ বংশপরম্পরায় রুইজাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন করে দেশের মৎস্য খাতকে সমৃদ্ধ করছে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের দিকে ঝড়ো হাওয়া, বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হলে রুইজাতীয় মাছগুলো হালদা নদীতে জড়ো হয় এবং ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রহকারীরা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে ডিম সংগ্রহ করে। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পোনা হ্যাচারিতে উৎপাদিত মাছের পোনার চেয়ে অনেক মানসম্মত এবং দ্রুত বর্ধনশীল। ফলে হালদা নদীর মাছের পোনার চাহিদা বেশি। হালদা নদীতে রুইজাতীয় মাছ বছরে দুই থেকে তিনবার ডিম ছাড়ে। হালদা নদীতে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তারপরেও অবৈধ মাছ শিকারীরা
বড়শি ও বিষ দিয়ে অবৈধভাবে মাছ শিকার করে যা দেশের আইন এবং স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ড। হালদা নদী আমাদের জন্য আল্লাহ্র অশেষ রহমতস্বরূপ। বর্তমানে এই হালদা নদী মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন বলে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নদীতে পানি থাকে, কিন্তু প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর ৩০ কিলোমিটার এলাকায় পানি নেই। আছে বালুচর। কোথাও কোথাও পানির ধারা আছে। তবে বেশিরভাগ এলাকায় নদীর তলদেশে এখন বালুচর। কোথাও আবার ফাটল দেখা দিয়েছে। এই চিত্র ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থেকে শুরু করে নাজিরহাট এলাকা পর্যন্ত হালদা নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা এখন অনেকটা পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি সংকটের কারণ হচ্ছে রাবার ড্যাম, নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলন, চা বাগানে পানি নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এতে করে হুমকির মুখে পড়েছে মৎস্য সম্পদ। অন্যদিকে সেচের পানির জন্য নদীপাড়ের মানুষের মাঝে হাহাকার চলছে। স্থানীয় কৃষকরা জানান, যুগের পর যুগ ধরে নদীপাড়ের চাষিরা নদীর বিভিন্ন চরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সবজির পাশাপাশি বোরো ধানের আবাদ করে থাকেন।হালদার পানির ওপর নির্ভর করে কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার কৃষকের জীবন ও জীবিকা। এক দশক আগেও নদীর গভীরতা ছিল। তখন নদীতে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির মাছ ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০০ বছরে হালদা নদীর অন্তত ১১টি বড় আকারের বাঁক কেটে সোজা করা হয়েছে। নদীর বাঁক কার্প জাতীয় মাছের প্রধান বসতি। বাঁক সোজা করে ফেলায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্র কমে গেছে। পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কৃষকদের ক্ষতি না করে হালদায় রাবার ড্যামের বিকল্প ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। ‘হালদা খালের উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ি ঝরনা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে নামকরণ হয় হালদা। এটি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িশ্চরে কর্ণফুলী নদীতে মিলিত হয়েছে। হালদার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণায় হালদা নদীর জন্য মানবসৃষ্ট ক্ষতিকর অন্তত ১০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফটিকছড়ির চা বাগানগুলোর জন্য নদীর পানি ব্যবহার, নদী থেকে প্রতিদিন চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উত্তোলন, মা মাছ নিধন, নদী থেকে নির্বিচারে বালু তোলায় এর মাটির গঠন নষ্ট হয়েছে। তীরে একের পর এক গড়ে ওঠা ইটভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে নদীর মাটি ও পানি। মানিকছড়িতে নদীর তীরে তামাক চাষ ও যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অস্বাভাবিক দূষণ ও দখলে হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের অস্তিত্ব ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।একদিকে অপরিকল্পিতভাবে হালদার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার দূষণ ও দখলে বিপর্যস্ত অন্যদিকে হালদায় যান্ত্রিক ও নৌযান ও ট্রলার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রায়শই ট্রলারের পাখার আঘাতে ডিমওয়ালা মা মাছের মৃত্যু ঘটছে। প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে হুমকির মুখে পড়েছে হালদা। দূষণ, অবৈধ বালু উত্তোলন, চরকাটা, ধুরুং খালের ওপর কংক্রিট ড্যামের কারণে হালদা ও এর বিভিন্ন শাখা খালগুলোতে পলি জমে ভরাটের কারণে হালদার স্বাস্থ্যব্যবস্থা তথা জলজ পরিবেশ বা জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন।
পাশাপাশি মা মাছ এবং ডলফিনে মৃত্যু হালদা বাস্তুতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ ও পানির গুণাগুণ রক্ষায় যা যা করণীয় সেসবের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। পরিকল্পনা করে আশপাশের সব কলকারখান সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। হালদা নদী ও খালের সাথে সংযুক্ত যেসব কলকারখানা সরিয়ে নেয়া সম্ভব না হলে সেসব কারখানায় অবশ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ইটিপি বাস্তবায়নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটি আবহাওয়া অনুক‚ল থাকলে মা মাছ নদীতে ডিম ছাড়তে পারে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী প্রাকৃতিক এবং মানব-সৃষ্ট ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে কারণে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। যা একদিকে দেশের অর্থনীতির জন্যে বিরাট অশনি সঙ্কেত পাশাপাশি মৎস্য খাতে মহাসংকট দেখা দিতে পারে বলে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।নানা কারণে প্রাকৃতিক এই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এখন ধ্বংসের পথে। সরকার এদিকে নজর না দিলে গুরুত্বপূর্ণ মাছের এ অভয়ারণ্যটি অচিরেই চোখের সামনেই নিঃশ্বেষ এবং বিলীন হয়ে যাবে। জাতির প্রত্যাশা সরকার হালদা নদী রক্ষার জন্যে দ্রæতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। মনে রাখা উচিৎ নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আর দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক