কামরুল আহসান চৌধুরী (শিবলী)
জুলাই-আগস্ট ২৪ মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ড. নিয়াজ আহমদ খান সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ঐ আন্দোলনে ছাত্র আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া,মোঃ নাহিদ ইসলাম,শারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আবু বাকের মজুমদার, মাহিন সরকার, রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, আরিফ হোসেন এবং আরও অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আন্দোলনের সময় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ শাহাদাত বরণ করেন, অনেকে গুরুতর আহত হয়েছে। সার্কেল অ্যাডজুটেন্ট ছোট ভাই আমির হোসেন আমাকে জানতে চেয়েছেন চুনতি গ্রামের নবাগত ভিসি ড. নিয়াজ আহমদ খান (রানা)’কে আমি চিনি কিনা? সর্বপ্রথম সিএ আমিরের কাছ থেকে শুনলাম ড. খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত ভিসি হিসেবে যোগদান করেছেন।
ধন্যবাদ দিয়ে সিএ আমিরকে জানালাম নবাগত ভিসি সাহেব সম্পর্কে আমার মামা হলেও বয়সে আমার সাত বছরের ছোট। যোগদানের পর ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন শিক্ষক দলীয় হওয়ার কোন সুযোগ নাই। তিনি মনে করেন আমার একটি নিজস্ব রাজনীতি বিশ্বাস থাকতে পারে, কিন্তু সেই বিশ্বাস সেই চিন্তা আমি শিক্ষক হিসেবে আমাকে প্রভাবিত করতে পারবেনা। শিক্ষক বাই ডেফিনিশন দলীয় হওয়ার কোন সুযোগ নাই, বিশেষ করে তর্কীবাহক হওয়ার কোন সুযোগ নাই । সেটা কমিয়ে আনতে হবে।
ড. খান আরও বলেন বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের প্রতিষ্ঠান কারো একার প্রতিষ্ঠান নই, সার্বিকভাবে, জাতীয়ভাবে ক্যারিয়ার প্লানিং আমাদের নাই। দুর্ভাগ্যের কারণ হল সংকীর্ণতা, অস্বাভাবিক রাজনীতিকরণ তার পরেও তিনি আশাবাদী সেটা কমিয়ে আনা যাবে। শিক্ষার পরিবেশ ভাল করার জন্য তিনি আশাবাদী। যোগসূত্র তৈরী করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছেলে বা মেয়ে আমার হাত ধরে আসলে আমাকে বলতে হয় তোমার সামনে তিনটি পথ খোলা আছে, কোনটি নেবে তুমি নাও। এ রকম কোন সুযোগ আমি তাকে দিতে পারিনা। ক্যারিয়ার প্লানিং তৈরীতে মন খারাপ করার কোন কারণ নাই । ২২ লাখ শিক্ষিত ছেলে মেয়ে জব মার্কেটের জন্য প্রতি বছর তৈরী হচ্ছে। কিন্তু ছোট বড় সরকারি চাকুরির সুযোগ পাচ্ছে ১ লাখ ৫৬ হাজার জন। তিনি বলেন হতাশ হওয়ার কোন কারণ নাই ।
ইর্ষনীয় শিক্ষা জীবন : শিক্ষা জীবনে কখনো ২য় না হওয়া অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি গভ. হাইস্কুল থেকে (কুমিল্লা বোর্ড) মাধ্যমিক পরীক্ষায় (মানবিক বিভাগ) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।১৯৮৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণি প্রথম স্থান অধিকার করেন (কুমিল্লা বোর্ড)।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয়ই ৩ বোর্ডের মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করেন। যার কারণে বোর্ড মেডেল এওয়ার্ডপ্রাপ্ত হন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক এডমিনিস্টেশন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং মাস্টার্সে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং উভয় পরীক্ষাতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে শীর্ষস্থান ধরে রেখে ইর্ষনীয় ফলাফল করেন।
মাস্টার্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ফ্যাকাল্টির মধ্যে সর্বোচ্চ মার্ক নিয়ে শীর্ষ স্থান দখল করায় তাতে গোল্ড মেডেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
প্রফেসার খান যুক্তরাজ্যের ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসহ পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পাদন করার পাশাপাশি তিনি অসংখ্য প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন, যা বাংলাদেশের পরিমÐলে অন্য কোন অধ্যাপকের নাই বললেই চলে। জনাব খান পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে মোটা বেতনের অধ্যাপনার সুযোগ থাকা সত্তে¡ও একমাত্র দেশপ্রেমের কারণে টাকার মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারে নাই । দেশের মাটিতেই তিনি চলে এসেছেন।
ড. নিয়াজ আহমদ খানের বর্ণাঢ্য জীবনের পরিচয় : জীবনে কখনো কোনদিন কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় না হওয়া তিনি ড. নিয়াজ আহমদ খান।
পারিবারিক পরিচিতি : চট্টগ্রাম জেলা শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ডেপুটি বাজার থেকে পূর্বে চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা চুনতি গ্রামটি। ঐতিহ্যমন্ডিত প্রাচীন শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৬ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ডেপুটি বংশে ড. নিয়াজ আহমদ খান (রানা) জন্ম গ্রহণ করেন। খান বাহাদুর নাসির উদ্দিন খান অবিভক্ত ভারতের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর।
তার দৌহিত্র মরহুম কবির উদ্দিন আহমদ খান বি.এ (অনার্স) এম.এ (ইংরেজি) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার পিতা মরহুম তৈয়ব উল্লাহ খান নাসির উদ্দিন ডেপুটির ছোট ছেলে, তৈয়ব উল্লাহ খান পুলিশ ইনসপেক্টর ছিলেন। মরহুম কবির উদ্দিন আহমদ খান ডেপুটির ১৪ সন্তানের মধ্যে মরহুম ড. শফিক আহমদ খান ৬ষ্ঠ সন্তান বি.এস.সি (অনার্স) এম.এস.সি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম (বায়োকেমিস্ট্রি)। জনাব শফিক আহমদ খানের ৪ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে ড. নিয়াজ আহমদ খান প্রথম।
ড. শফিক আহমদ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যাপনা করার পর পরবর্তীতে বিসিএস (বন) ক্যাডারে এসিএফ পদে চাকুরি নেন এবং তিনি বন সংরক্ষক থাকাবস্থায় চাকুরিকালীন সময়ে ইন্তেকাল করেন। জনাব খান সাহেবের পরিবারটি চুনতি এলাকার ডেপুটি বাড়ি হিসেবে বিখ্যাত ।
কর্নেল আরশাদ আহমদ খান, সাবেক পরিচালক, আনসার ও ভিডিপি খান সাহেবের চাচা, অন্যান্যদের মধ্যে ডেপুটি পরিবারে অসংখ্য ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, অধ্যাপক, জেলা ও দায়রা জজ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের মধ্যে ইসলামের ইতিহাসের পÐিত অধ্যাপক মরহুম ড. মঈন উদ্দিন আহমদ খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ভাষাসৈনিক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এড্ভোকেট মরহুম ফরমান উল্লাহ খান, লোহাগাড়া উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান বর্তমানে ডেপুটি এটর্নি জেনারেল। চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক আমির মোহাম্মদ খান বিএ (অনার্স) এমএ এই পরিবারের সন্তান। বাংলার অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং সাবেক ডিজি বাংলা একাডেমী জনাব খান সাহেবের আপন ফুফাত ভাই ।
বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কবি সুফিয়া কামালের স্বামী লেখক ও অনুবাদক মরহুম কামাল উদ্দিন খান উনার ছোট দাদা, চুনতি সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ (অব:প্রাপ্ত) আলহাজ আমিন আহমদ খান প্রকাশ জুনু মিয়া ভিসি মহোদয়ের আপন ছোট চাচা ।
কর্মজীবন : ড. নিয়াজ আহমদ খান (রানা) ২৬ আগস্ট ২০২৪ ইং তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ তম উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পেলেন। এর পূর্বে ২০০৬ সাল হইতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যায়ন বিভাগের জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আই ইউ বি) এর উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্ম জীবন ও শিক্ষা অভিজ্ঞতা গবেষণা ও প্রয়োগিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা এই দু’টি ধারার সমৃদ্ধ। তিনি বিশ্বের অন্যতম প্রধান ও খ্যাতনামা পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আই ইউ সি এন) এর বাংলাদেশ দপ্তরের প্রধান দেশীয় প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি এর পূর্বেও উন্নয়ন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। যেমন ইউএনডিপি বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম কো-অডিনেটর (পার্বত্য চট্টগ্রাম) এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক এডিপি এর বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বিকেএসএফ এর অপারেশন ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
বড় ধরনের প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের ব্যবস্থাপনায় ড. খানের অসাধারণ জ্ঞান রয়েছে। কারণ তিনি অধ্যাপনা ছাড়াও জাতিসংঘ এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এডিপি) আমেরিকান উন্নয়ন সংস্থা যুক্তরাজ্য সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপদেষ্টা ও পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন।
ড. খান সাহেব ১৭০টিরও বেশি গবেষণামূলক প্রবন্ধের রচয়িতা। অধ্যাপনা জীবনে তিনি নিয়মিতভাবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন কমিটি এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের সরব ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়াও তিনি বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক গবেষণা নির্দেশক ও শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে প্রধান জাতীয় প্রতিষ্ঠান সমূহ যেমন-ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমী, ফরেন সার্ভিস একাডেমী, সিভিল সার্ভিস একাডেমী, বাংলাদেশ আর্মি আর্টিলারি সেন্টার এন্ড স্কুল এবং বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি একাডেমীতে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কুনই এলিজাবেথ হউজে দক্ষিণ এশিয়ান ফেলো ওয়েলস ইউনিভার্সিটি রিসার্চ ফেলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনষ্টিটিউট অব টেকনোলজি এশিয়া রিসার্চ ফেলোর দায়িত্ব পালন করেন।
একজন সিনিয়র বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য এবং থাইল্যান্ডের বিভিন্ন পোস্ট গ্রাজুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয় স্যোশাল সায়েন্স, পরিবেশ প্রভৃতি গবেষণা তার অধ্যাপনা করার দীর্ঘ ২৫ বছরের অধিক অভিজ্ঞতা রয়েছে।
মিশরে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব কায়রোতে বিশেষ পরিদর্শন গবেষক হিসেবে একজন সম্মানিত ব্যক্তির মর্যাদা লাভ করেন।
৪ ভাই ১ বোনের মধ্যে জনাব খান সাহেব প্রথম সন্তান। দ্বিতীয় ভাই নাফিজ আহমদ খান লেফটেনেন্ট কমান্ডার বাংলাদেশ নেভী অব: বর্তমানে ইতালির রাজধাম এফএওতে কর্মরত। তৃতীয় ভাই শাহনূর আহমদ খান সুইডেন প্রবাসী। চতুর্থ নং ভাই জাহিদ আদনান খান, অফিসার, ব্র্যাক ব্যাংক। একমাত্র বোন রেহনোমা শাহনাজ জুয়োলজির মাস্টার্স, বর্তমান আমেরিকা প্রবাসী। ব্যক্তি জীবনে ড. খান সাহেব বিবাহিত, একমাত্র কন্যা ফাতিহা মুনজারিন খান ছিদ্দিকা, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত।
লেখক : উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিসার (অব:)